আহমেদ তোফায়েল : ব্যবসার খরচ বাড়লেও উদ্যোক্তাদের দেয়া ঋণের চলতি মূলধনের (ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল) সীমা বাড়াচ্ছে না বেশিরভাগ বানিজ্যিক ব্যাংক। উদ্যোক্তাদের চাহিদা অনুযায়ী বাড়তি ঋণের চাহিদা থাকলেও তা দিতে অপরাগতা জানাচ্ছে তারা। সব মিলে ঋণের লিমিট না বাড়ার কারণে বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ী উদ্যোক্তরা।
তারা বলছেন, শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত সকল ধরনের কাঁচামালের দাম বেড়েছে। জাহাজ ভাড়া বেড়েছে দ্বিগুন। অভ্যন্তরিন পরিবহন খরচও বেড়েছে একই হারে। বিদ্যুতের যোগান না থাকায় উদ্যোক্তাদের বাড়তি খরচের ডিজেল পুড়িয়ে উৎপাদন চালিয়ে রাখতে হচ্ছে। এ অবস্থায় ব্যাংকের চলতি মুলধনের সীমা বাড়ানো না হলে উৎপাদন চালিয়ে রাখা কঠিন হবে।
বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। সম্প্রতি সংগঠনের পক্ষ থেকে চলতি মূলধন ঋণ সীমা অন্তত ৪০ শতাংশ বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংককে বিশেষ অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেয়া হয়। চিঠিতে এফবিসিসিআই জানায়, বিরাজমান কোভিড ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালসহ অন্যান্য পণ্যের মূল্য ও জাহাজ ভাড়া প্রতিনিয়ত বাড়ছে। কাঁচামাল, শিপিং, যাবতীয় লেনদেন চার্জসহ অন্যান্য খরচ বাড়ার কারণে দেশের উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এছাড়াও আমদানি করা পণ্যের দাম বাড়ার কারণে কর আপাতন বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যসহ সকল ধরনের পণ্যের দাম ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়ার কারণে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনায় ব্যাঘাত ঘটছে। সংগঠনটির মতে, কাঁচামালের দাম বাড়ার কারণে ব্যবসায়ীদের ঋণ সীমা উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। ফলে আমদানিকারক ও রপ্তানিকারক উভয়ই স্বাভাবিক ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করতে পারছেন না। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় মূলধন সীমা বাড়ানোর বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ চেয়েছে এফবিসিসিআই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি’র সাবেক চেয়ারম্যান মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান গতকাল বলেন, লিমিট যে বাড়াচ্ছে না এটি সব ব্যাংকের ক্ষেত্রে সঠিক নয়। কেউ বাড়াচ্ছে আবার কেউ বাড়াচ্ছে না। এটি দুটো কারণে হচ্ছে প্রথমত, যেসব ব্যাংকে পর্যাপ্ত মূলধন নেই বা নগদ টাকার সংকট রয়েছে তারা গ্রাহকের লিমিট বাড়াতে পারছে না। অর্থাৎ সব ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা এক নয়। আরেকটি কারণ হলো- ডিবিএস (ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশন সিস্টেম) হয়ে যাওয়ার কারণে জটিলতা আরো বেড়েছে।
ব্যাংকাররা বলছেন, কোম্পানির নিরীক্ষা প্রতিবেদনের স্বচ্ছতা ও যথার্থতা যাচাইয়ের জন্য দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) উদ্যোগে ডিবিএস নামে ২০২০ সালে একটি সফটওয়্যার চালু করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআর। যার মাধ্যমে এনবিআরের কর্মকর্তারা নিরীক্ষিত প্রতিবেদনের সত্যতা যাচাইয়ের পাশাপাশি জাল প্রতিবেদন শনাক্ত করতে পারে। ডিবিএস ব্যবহার করে আয়করের পাশাপাশি মূল্য সংযোজন করের (ভ্যাট) তথ্যও যাচাই করতে পারে ভ্যাট কর্মকর্তারা। অভিযোগ আছে, সহজে ব্যাংক ঋণ পেতে অনেক প্রতিষ্ঠান ভুয়া অডিট রিপোর্ট তৈরি করে মুনাফা বেশি দেখায়। এ ধরনের জালিয়াতির পথ বন্ধ হওয়ার কারণে অনেকে আবার ব্যাংক ঋণ লিমিট বাড়াতে পারছে না।
ব্যবসায়ীদের মতে, সাম্প্রতিক বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালসহ বিভিন্ন উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি এবং পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ঋণগ্রহীতাদের অনুকূলে তফসিলি ব্যাংকগুলোর ইতোমধ্যে মঞ্জুরীকৃত চলতি মূলধন ঋণ সীমার সর্বোচ্চ ব্যবহার সত্ত্বেও চাহিদা মোতাবেক প্রয়োজনীয় কাঁচামালের মূল্য পরিশোধসহ উৎপাদন কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে উৎপাদন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে আমদানি-রপ্তানিসহ চলমান অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের গতিশীলতা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যদিও ২০২২ সালের ২৭ এপ্রিলে চলতি মূলধন ঋণ সীমা বাড়ানোর নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে এ ঋণ সীমা বাড়ানোর কথা বলা হয়। কিন্তু এ নির্দেশনা বেশিরভাগ ব্যাংক মানছে না।
এবিবির বর্তমান চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হুসাইন গতকাল বলেন, কোনো ব্যাংক লিমিট বাড়াচ্ছে বা বাড়াচ্ছে না সেটি ওই ব্যাংকের নিজস্ব ব্যাপার। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক এ ক্ষেত্রে লিমিট বাড়ানোর সুযোগ দিয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে তার পরামর্শ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর উচিত হবে কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ ও ব্যাংক গ্রাহক সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে নতুন উপযুক্ত লিমিট তৈরি করে দেয়া।
টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস খাতের উদ্যোক্তা এবং বিজিএমইএর সাবেক সহ-সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু অবশ্য বলেছেন, ঋনসীমা বাড়ানোর বিষয়টি নির্ভর করে ব্যাংক এবং গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে। ব্যাংক যদি ঋনসীমা না বাড়ায় তাহলে ব্যবসায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। তিনি বলেন, ঋনসীমা বাড়লে তা ব্যাংকেরও লাভ। বাড়তি ঋন থেকে ব্যাংক বাড়তি কমিশনও পায়। তবে তিনি বলেছেন, ব্যাংকগুলো যে ঋনসীমা একেবারে বাড়ায়নি তা নয়। অনেক গ্রাহক ইতিমধ্যে তাদের ঋনসীমা বাড়িয়ে নিয়েছেন। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে ব্যাংকগুলো সিদ্ধান্ত নেবে বলে তিনি আশা করেন। সূত্র : ইত্তেফাক।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।