জাহিদ ইকবাল: বাংলাদেশের ইতিহাসের এক ধূম্রজালের আবর্তে আজ যেন মহাকালের সূর্য অস্তমিত। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার প্রয়াণ কেবল একজন ব্যক্তির বিদায় নয়—এটি একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম, একটি রাষ্ট্রনায়কসুলভ অধ্যায় এবং কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার এক গভীর সমাপ্তি। তিনি ছিলেন এমন এক নেতৃত্বের প্রতীক, যাঁর জীবন ব্যক্তিগত বেদনা থেকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে উত্তরণের এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক শূন্যতার সৃষ্টি হয়। সে সময় রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও বেগম খালেদা জিয়া সেই শূন্যতায় প্রবেশ করেন শুধুমাত্র স্বামীর উত্তরাধিকার হিসেবে নয়, বরং গণতন্ত্রপন্থী শক্তির এক অনিবার্য নেতৃত্ব হিসেবে। ব্যক্তিগত শোককে রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তর করে তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন আপসহীন, দৃঢ়চেতা ও সাহসী নেত্রী হিসেবে। রাজপথের আন্দোলন, স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রাম এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে তিনি হয়ে ওঠেন সাধারণ মানুষের ভরসার প্রতীক—‘দেশনেত্রী’।
১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদলের নাম। দীর্ঘ নয় বছরের সামরিক ও স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে সেই নির্বাচনের মাধ্যমে বেগম খালেদা জিয়া দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর নেতৃত্বেই রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থার পরিবর্তে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ছিল কেবল একটি সাংবিধানিক পরিবর্তন নয়, বরং জনগণের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত।
রাষ্ট্র পরিচালনায় তাঁর সরকারের অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার ছিল শিক্ষা। মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত মেয়েদের অবৈতনিক শিক্ষা ও উপবৃত্তি চালু করে তিনি নারী শিক্ষায় যে বিপ্লবের সূচনা করেন, তার ফল আজও বাংলাদেশের সামাজিক অগ্রগতিতে দৃশ্যমান। গ্রামবাংলার অসংখ্য কিশোরী প্রথমবারের মতো বিদ্যালয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর সুযোগ পায়। বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে নিরক্ষরতা দূরীকরণে তাঁর ভূমিকা ছিল যুগান্তকারী। আজ বাংলাদেশের মানবসম্পদ উন্নয়নের যে ভিত্তি, তার একটি বড় অংশ নির্মিত হয়েছিল সেই সময়েই।
অবকাঠামো উন্নয়নেও তাঁর অবদান ছিল সুদূরপ্রসারী। যমুনা বহুমুখী সেতু নির্মাণের মাধ্যমে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে যোগাযোগের যে ঐতিহাসিক সেতুবন্ধন সৃষ্টি হয়, তা জাতীয় অর্থনীতিতে নতুন গতি আনে। কৃষিখাতে ডাল-ভাত কর্মসূচি, সামাজিক বনায়ন, মৎস্য ও পশুসম্পদ উন্নয়ন—এসব উদ্যোগ গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে সহায়তা করে। একই সময়ে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পের বিকাশে তাঁর সরকারের নীতিগত সমর্থন বাংলাদেশকে বৈশ্বিক বাজারে একটি শক্ত অবস্থানে নিয়ে যায়।
পররাষ্ট্রনীতিতে বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন আত্মমর্যাদাশীল ও ভারসাম্যপূর্ণ। আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদারে তিনি সার্কের প্ল্যাটফর্মকে গুরুত্ব দেন, তবে জাতীয় স্বার্থ ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে ছিলেন আপসহীন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে তিনি পরিচিত করিয়েছিলেন একটি মর্যাদাবান ও দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হিসেবে।
ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর ত্যাগ ও দৃঢ়তা রাজনীতির ইতিহাসে বিরল। ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী সংকটকালে দেশত্যাগের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়েছিলেন—এই দেশই তাঁর একমাত্র ঠিকানা। দীর্ঘ কারাবাস, রাজনৈতিক নিপীড়ন, শারীরিক অসুস্থতা ও বার্ধক্যের যন্ত্রণা—সবকিছুর মধ্যেও তাঁর মনোবল কখনো ভেঙে পড়েনি। তিনি ছিলেন ধৈর্য, সহনশীলতা ও আত্মবিশ্বাসের এক জীবন্ত প্রতীক।
আজ বেগম খালেদা জিয়া নেই, কিন্তু তিনি রেখে গেছেন একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক উত্তরাধিকার, একটি আদর্শিক দর্শন এবং গণতন্ত্রের জন্য আত্মত্যাগের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের যে বীজ তিনি রোপণ করেছিলেন, তা এ দেশের রাজনৈতিক চর্চায় দীর্ঘদিন প্রভাব ফেলবে। সময়ের স্রোতে মানুষ চলে যায়, কিন্তু ইতিহাসে থেকে যায় তাঁদের কর্ম।
বাংলাদেশের মানচিত্র যতদিন থাকবে, বেগম খালেদা জিয়ার নাম ততদিন এই দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অবিচ্ছেদ্য অধ্যায় হয়ে উজ্জ্বল থাকবে।
লেখক পরিচিতি: সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।


