মোহাম্মদ মতিউর রহমান: বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই ক্রীড়াপ্রেমী। বাংলাদেশে দলের খেলা যখন শুরু হয় তখন দলবল নির্বিশেষে সকলের একটাই চাওয়া থাকে আমাদের দেশ জয় লাভ করুক। দেশের জয়ের জন্য দেশের মানুষের ভালোবাসা প্রয়োজন। দেশের মানুষ যে ক্রীড়াপ্রেমী তা যান্ত্রিক শহরে কম পরিলক্ষিত হলেও গ্রামে গেলে সেটা বুঝা যায়। গ্রামের মাঠে যদি কোনও ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে দর্শকদের জায়গা দেওয়া যায় না। একজন খেলোয়াড়ের সবচেয়ে অনুপ্রেরণার জায়গা হল দর্শক, দর্শকদের হাত তালি এবং দর্শকদের ভালোবাসা। যেটা আমাদের দেশের খেলোয়াড়রা সব সময় পেয়ে থাকে।
একজন খেলোয়াড়কে ভালো খেলোয়াড় হিসেবে তৈরি করতে একদল দক্ষ, সুকৌশলী ও সুদূর প্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে কাজ করতে হয়। তাদের মধ্যে থাকেন একজন কোচ, প্রশিক্ষক, ডাক্তার, ফিজিওথেরাপিস্ট ও সাইকোলজিস্ট। আমাদের দেশের ক্লাবগুলোতে কিংবা ফেডারেশনগুলোতে সবগুলো ব্যক্তির সমন্বয় পরিলক্ষিত হয় না। বিশেষ করে একজন স্পোর্টস সাইকোলজিস্টের অনুপস্থিতিই বেশি লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু একজন খেলোয়াড়কে শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি কিভাবে মানসিক সুস্থ থেকে নিজের পারফরমেন্স ভালো করা যায় এবং ভালো পারফর্মেন্স ধরে রাখা যায় সে বিষয়ে পরামর্শসহ বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতা করতে পারেন একজন ক্রীড়া মনোবিজ্ঞানী।
মনোবিজ্ঞানের বিশেষায়িত ক্ষেত্র সাম্প্রতিক বছর গুলিতে দ্রুত বিকাশ লাভ করেছে । কোচিং এবং স্বাস্থ্য সেবা দলের একটি অবিচ্ছেদ্য সদস্য হিসেবে ক্রীড়া মনোবিজ্ঞানের গুরুত্ব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্রীড়া মনোবিজ্ঞানীরা খেলোয়াড়দের শেখার ক্ষেত্রে মানসিক প্রক্রিয়া, প্রতিযোগিতার সময় মানসিক চাপ মোকাবিলা করতে, ভালো পারফরমেন্সের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ এবং সচেতনতার মাত্রাকে সুরক্ষিত করতে সহায়তা করে থাকেন।
অনুশীলনের সময় কিংবা প্রতিযোগিতার সময় ক্রীড়াবিদদের মানসিক সমস্যা যেমন চাপ, হতাশা, উদ্বেগ হওয়াটা স্বাভাবিক। একজন স্পোর্টস সাইকোলজিস্ট খেলোয়াড়দের কিভাবে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে সঠিক আচরণ করতে হয় সেসব বিষয়ে কাউন্সিলিং করে থাকেন।
ক্রীড়াবিদদের আত্মবিশ্বাস, সংবেদনশীল নিয়ন্ত্রণ, প্রতিশ্রুতি, কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি ও সফল পারফর্মেন্সের জন্য একজন স্পোর্টস সাইকোলজিস্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া অ্যাথলেটদের প্রতিযোগিতামূলক পারফর্মেন্স পরিচালনায় সহায়তা করার জন্য সহজ মনস্তাত্ত্বিক দক্ষতা বৃদ্ধিকরণে পরামর্শ প্রদান করে থাকেন। যেমনঃ প্রগতিশীল শিথিলকরণ, ধীর , গতিশক্তি নিয়ন্ত্রিত, গভীর পেটে শ্বাস বা অটোজেনিক প্রশিক্ষণ, সমস্ত মনোযোগ শৈলীর উপর দক্ষতা অর্জন, স্ব-আলাপ, প্রতিযোগিতার আগের দিন ভালোভাবে ঘুমানো এবং প্রতিযোগিতার দিন তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠে মানসিক প্রস্তুতি নেওয়া প্রভৃতি বিষয়ে দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকেন একজন স্পোর্টস সাইকোলজিস্ট।
আহত অ্যাথলেটরা সাধারণতঃ কমপক্ষে তিনটি সংবেদনশীল প্রতিক্রিয়া অনুভব করে। যেমন বিচ্ছিন্নতা, হতাশা এবং মেজাজের ব্যাঘাত। কোচ ও চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে স্পোর্টস সাইকোলজিস্ট খেলোয়াড়কে শারীরিক ও মানসিক ভাবে প্রস্তুত করে খেলায় অংশগ্রহণে সহায়তা করে থাকেন।
এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, মনস্তাত্ত্বিক ক্ষমতাগুলো ব্যক্তির শরীরবৃত্তীয় ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। মনোবিজ্ঞান শরীরবৃত্তীয় সক্ষমতা যেমন শক্তি, গতি এবং নমনীয়তা ইত্যাদি বিকাশে অনন্য ভূমিকা পালন করে। খেলাধুলায় শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে প্রেরণা ও উদ্দীপনা যোগাতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন একজন সাইকোলজিস্ট।
ক্রীড়া মনোবিজ্ঞান মোটর দক্ষতা শেখার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করে। মোটর দক্ষতা শেখার পৃথক প্রস্তুতির স্তরের উপর নির্ভর করে, যেমন- শরীরবৃত্তীয় প্রস্তুতি এবং মানসিক প্রস্তুতি। শিশুদের শরীরবৃত্তীয় প্রস্তুতি হলো প্রয়োজনীয় শক্তি, নমনীয়তা এবং ধৈর্য্যরে পাশাপাশি বিভিন্ন অঙ্গের বিকাশ, যাতে তারা বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপে প্রয়োজনীয় মোটর দক্ষতা সম্পাদন করতে পারে। মনস্তাত্তি¡ক প্রস্তুতি শিক্ষা মনের অবস্থার সাথে সম্পর্কিত। খেলোয়াড়দের মোটর দক্ষতা বৃদ্ধি ও মনস্তাত্তি¡ক প্রস্তুতি গ্রহণে একজন স্পোর্টস সাইকোলজিস্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
একজন স্পোর্টস সাইকোলজিস্ট ক্রীড়াবিদদের আচরণ বুঝতে কোচদের সহায়তা করে থাকেন। কোচরা ক্রীড়াবিদদের আগ্রহ, শারীরিক কার্যকলাপের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, প্রবৃত্তি, ড্রাইভ এবং ব্যক্তিত্বও জানতে পারে। এটি কেবল তাদের বোঝার ক্ষেত্রেই ভূমিকা পালন করে না বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে।
ক্রীড়া মনোবিজ্ঞান অনুশীলন ও প্রতিযোগিতার সময় ক্রীড়াবিদদের আবেগ নিয়ন্ত্রণে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাধারণত, এই সংবেদনগুলো ক্রীড়াবিদদের আচরণে স্বতঃস্ফূর্ত পরিবর্তন আনতে পারে। এগুলো হল রাগ, ঘৃণা, ভয়, নেতিবাচক চিন্তাভাবনা ইত্যাদি। যদি এই সংবেদন গুলো সময়মতো ভালভাবে নিয়ন্ত্রণ না করা হয় তবে পারফরমেন্স হ্রাস পেতে পারে। স্পোর্টস সাইকোলজিস্ট ক্রীড়াবিদদের এই সব আবেগ নিয়ন্ত্রণের কৌশল শিখানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে।
প্রতিযোগিতার জন্য মানসিক যৌক্তিকভাবে অ্যাথলেটদের প্রস্তুত করতে ক্রীড়া মনোবিজ্ঞানীরা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। জয়ের ইচ্ছা জাগ্রত করার জন্য প্রতিযোগিতার আগে ও পরে ক্রীড়াবিদ বা দলের খেলোয়াড়দের মনস্তাত্তি¡ক পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
আমরা একটি ক্রিকেট দলকে তখনই ভালো ক্রিকেট দল হিসেবে স্বীকৃতি দিই, যখন সেই ক্রিকেট দলে ভালো ব্যাটসম্যান, ভালো বোলার ও ভালো ফিল্ডার থাকে। অর্থাৎ সবার Good combination and good contribution থাকে। তদ্রুপ, একটি দলকে পরিপূর্ণ ভালো দল হিসেবে গড়ে তুলতে সবার যৌথ প্রচেষ্টার দরকার। সেখানে একজন কোচ থাকবেন, একজন প্রশিক্ষক থাকবেন, একজন ডাক্তার থাকবেন, একজন ক্রীড়া মনোবিজ্ঞানী থাকবেন এবং একজন ফিজিওথেরাপিস্ট থাকবেন। সবার Good combination and good contribution এ একটি দল হবে পরিপূর্ণ এবং শক্তিশালী দল। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, আমাদের দেশের একমাত্র ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিকেএসপি (সাভার ) ছাড়া অন্য কোথাও এদের পরিপূর্ণ উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না। সেকারণেই আজ ক্রীড়াঙ্গনে বিকেএসপির খেলোয়াড়রাই বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিনিধিত্ব করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের খেলার মান ও মর্যাদাকে আরও বেশি উন্নত করতে ক্রীড়া মনোবিজ্ঞানীসহ সকলের অবদান নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
লেখক একজন স্পোর্টস সাইকোলজিস্ট
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।