সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, মূল্যবান এসব ধাতুর জন্ম পৃথিবীতে নয়, প্রাচীন কোনো নক্ষত্রের বুকে। তত্ত্ব হিসেবে বিষয়টা বিজ্ঞানীদের জানা ছিল। তবে এই প্রথম এই তত্ত্বের সপক্ষে পাওয়া গেল শক্তিশালী প্রমাণ। গত ৭ ডিসেম্বর সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে জানা গেছে এ কথা। গবেষণাপত্রের সহলেখক ম্যাথিও মামপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকো অঙ্গরাজ্যের লস আলামোস জাতীয় গবেষণাগারের তত্ত্বীয় পদার্থবিদ। তাঁর ভাষ্যে, ‘এই পদ্ধতিতে পর্যায় সারণির ভারী ভারী মৌল তৈরি হতে পারে এক সেকেন্ডের মধ্যেই।
নক্ষত্রের বুকে কেমন করে মৌল তৈরি হয়? এই প্রশ্নের জবাব অনেক খুঁজে বের করেছেন বিজ্ঞানীরা। সবার প্রথম ব্রিটিশ তাত্ত্বিক পদার্থবিদ আর্থার এডিংটন প্রস্তাব করেন, নক্ষত্রের বুকের ভেতরটা আসলে মহাজাগতিক চুল্লী। এই চুল্লীতে হাইড্রোজেন-হাইড্রোজেন ফিউশন বিক্রিয়ায় এক হয়ে তৈরি করে হিলিয়াম নিউক্লিয়াস। এর পরের ধাপ কী?
হিলিয়ামগুলোর কী হয়? ফ্রেড হয়েল, বিগ ব্যাং তত্ত্বের অন্যতম শত্রু এই গুণী বিজ্ঞানী জিওফ্রি বারবিজ ও উইলিয়াম ফাউলারের সঙ্গে মিলে দেখান, এর পরের ধাপে হিলিয়াম থেকে তৈরি হয় কার্বন। তবে সে জন্য নক্ষত্রগুলোর ভর হতে হয় বিপুল। ভারী নক্ষত্রের বুকে পরের ধাপে কার্বন থেকে নিয়ন ও ম্যাগনেশিয়াম, নিয়ন থেকে অক্সিজেন ও ম্যাগনেশিয়াম, অক্সিজেন থেকে সালফার ও সিলিকন—এভাবে ভারী ভারী মৌল তৈরি হতে থাকে। এই ধাপ গিয়ে শেষ হয় লোহায়। লোহার চেয়ে ভারী মৌল ফিউশন বিক্রিয়ায় সাধারণত তৈরি হতে পারে না। তাহলে, সেগুলো কীভাবে তৈরি হয়?
সুপারনোভা বা অতিনবতারার ভয়ংকর বিস্ফোরণের সময় এ ধরনের ভারী মৌল তৈরি হতে পারে। অথবা নিউট্রন নক্ষত্রের সংঘর্ষে তৈরি হতে পারে এ ধরনের ভারী মৌল, অর্থাৎ স্বর্ণ বা রূপা। তবে সবচেয়ে বড় টুইস্টটা হলো, এ ধরনের মৌলগুলো নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ায় তৈরি হয় না। তৈরি হয় নিউক্লিয়ার ফিশন বিক্রিয়ায়!
ফিশন বিক্রিয়া মানে, বড় বা ভারী কোনো মৌল ভেঙে হালকা মৌল তৈরি হওয়া। পারমাণবিক বোমা বা পরমাণুবিদ্যুৎ কেন্দ্রে যেমন ইউরেনিয়ামের মতো ভারী মৌল ভেঙে হালকা মৌল তৈরির সময় উৎপাদিত প্রচণ্ড শক্তি কাজে লাগানো হয়। এ ধরনের বিক্রিয়ায় ভারী মৌলের নিউক্লিয়াসকে আঘাত করতে হয় নিউট্রন দিয়ে।
উদাহরণ হিসেবে ইউরেনিয়াম-২৩৫ এর ফিশনের কথা ভাবা যাক। একটি নিউট্রন দিয়ে এর নিউক্লিয়াসে ধাক্কা দিলে ইউরেনিয়াম ভেঙে তৈরি হয় ক্রিপটন, বেরিয়াম, সিজিয়াম বা রুবিডিয়ামের মতো ছোট দুটি মৌল। সঙ্গে তৈরি হয় দুই থেকে তিনটি নিউট্রন এবং বিপুল শক্তি। এগুলো আবারও ইউরেনিয়ামের অন্য নিউক্লিয়াসকে ধাক্কা দেয়। সেগুলো তখন ভেঙে গিয়ে আবারও দুটি ছোট মৌল ও দুই-তিনটি নিউট্রন তৈরি হয়। এভাবে বিক্রিয়াটি চলতেই থাকে।
নক্ষত্রের বুকে এ ধরনের বিক্রিয়ায় ঘটতে সময় লাগে এক সেকেন্ডেরও কম। মুহূর্তের মধ্যে ভারী নিউক্লিয়াস বেশ কটি অভ্যন্তরীণ ধাপে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়, তৈরি হয় স্বর্ণ বা রূপার মতো ভারী মৌল। তত্ত্বীয় এই ধারণা কতটা সঠিক? তা বুঝতে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ৪২টি বহু বহু প্রাচীন নক্ষত্রের রাসায়নিক গঠন বিশ্লেষণ করে দেখেছেন বিজ্ঞানীরা। এগুলো সূর্যের মতো ভারী, জন্মেছিল বিগ ব্যাংয়ের ৫ থেকে ৯ বিলিয়ন বছর পরে। এই বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সত্যিই নিউক্লিয়ার ফিশন বিক্রিয়ায় এসব নক্ষত্রে তৈরি হয়েছে এ ধরনের মৌল।
লোহা থেকে ভারী, তবে ইউরেনিয়ামের মতো অনেক ভারী নয়। বরং এসব নক্ষত্রের বর্ণালি বিশ্লেষণে পাওয়া গেছে রোডিয়াম, রূপা, প্যালাডিয়ামের মতো (অর্থাৎ পারমাণবিক ভর ৪৫ থেকে ৪৭-এর মধ্যে) প্রচুর মৌল। সঙ্গে ইউরোপিয়াম, আর্বিয়ামের মতো ৬০-এর ঘরে পারমাণবিক ভর—এরকম মৌলও পাওয়া গেছে।
বিজ্ঞানী মামপাওয়ারের ভাষায়, এসব নক্ষত্রের একটি সঙ্গে আরেকটির কোনো সংযোগ নেই। তবু এগুলোতে একই ধরনের প্যাটার্ন পাওয়ার অর্থ একটাই হতে পারে—এগুলোতে একই ধরনের প্রক্রিয়ায় এসব মৌল তৈরি হয়েছে।
কিন্তু এমন কি হতে পারে না যে ভারী কোনো মৌল ভেঙে এরকম দুটি ছোট মৌল তৈরি হয়নি, বরং প্রতিটি মৌল আলাদাভাবে তৈরি হয়েছে ভিন্ন কোনো প্রক্রিয়ায় বা নিউক্লিয়ার ফিউশনে? গবেষণাপত্রটি বলছে, তা যদি হতো, তবে প্রাপ্ত পরমাণুদের অনুপাত হতো অনেকটা ভিন্ন। গবেষক দল যে ধরনের প্যাটার্ন পেয়েছে, তা সে ক্ষেত্রে পাওয়া যেত না।
ফিশন প্রক্রিয়ায় এই বিষয়টি ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা যায় বলে জানিয়েছেন কানাডার ট্রাই-ইউনিভার্সিটি মেসন ফ্যাসিলিটির গবেষক নিকোল ভাশ। তিনি বলেন, ‘এ পদ্ধতিতে আমাদের প্রাপ্ত ডেটার প্যাটার্নের সঙ্গে পুরো বিষয়টি মিলে যায়। তবে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টা বুঝতে হবে, তা হলো, এ ধরনের ফিশন কখনোই পৃথিবীতে ঘটে না।’
ডেনমার্কের ইউনিভার্সিটি অব কোপেনহেগেনের জ্যোতিঃপদার্থবিদ দারাচ জাফার ওয়াটসন এই গবেষক দলের অংশ নন। তবে এ গবেষণা প্রসঙ্গে লাইভ সায়েন্সকে দেওয়া এক বিবৃতিতে তিনি জানিয়েছেন, গবেষণাপত্রটির তথ্য-উপাত্ত ও বিশ্লেষণ বেশ শক্তিশালী ও সঙ্গতিপূর্ণ। তাঁরা ভাষায়, ‘এর কোনো বিকল্প ব্যাখ্যা আমি অন্তত পাচ্ছি না। শতভাগ নিশ্চিত না হলেও এটি যথেষ্ট শক্তিশালী ব্যাখ্যা বলেই বোধ হচ্ছে।’
অর্থাৎ শতভাগ নিশ্চিত না হলেও এ গবেষণা অনেকটাই নিশ্চয়তা দিচ্ছে আমাদের। বাকিটা জানা যাবে সময়ে। তবে ভাবার বিষয় হলো, স্বর্ণ বা রূপার গহনা যাঁরা পরেন, তাঁদের কি এই বোধ হয় যে ভিন্ন কোনো নক্ষত্রের উপাদান সঙ্গে নিয়ে ঘুরছেন? বিস্ময়কর বটে!
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।