নিজস্ব প্রতিবেদক, গাজীপুর: গাজীপুর জেলায় গত ২৩ বছরে বনভূমি ও জলাশয় কমেছে দুই তৃতীয়াংশ। উল্টো দিকে বেড়েছে বন দখল, জলাশয় ভরাট ও গাছ কর্তন। অর্থনৈতিকভাবে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জেলা গাজীপুরে নিয়ে এক গবেষণায় এমন তথ্য ওঠে এসেছে।
মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) সকালে গাজীপুর পিটিআই অডিটরিয়ামে পরিবেশ দূষণে বিপর্যস্ত গাজীপুর: উত্তরণ উপায় শীর্ষক আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে গবেষণা জরিপের ফলাফলে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়।
গবেষণা জরিপ পরিচালনা করেছে, রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি)। এতে সহায়তা করেছে, বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশন (বিআরএফ), বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) এবং প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন।
২০২৩ সালে গবেষণা জরিপ পরিচালিত হয়। এই গবেষণার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু নদী হলেও সংগত কারণেই এতে পরিবেশের অন্যান্য উপাদানগুলোর বর্তমান অবস্থা, ক্রম বিবর্তনের চিত্র উঠে এসেছে।
অনুষ্ঠানে বেলার ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী তাসলিমা ইসলামের সভাপতিত্বে এতে প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা প্রশাসক নাফিসা আরেফিন।
বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মো. মনির হোসেন পরিচালনায় জরিপ তথ্য উপস্থাপন করেন, রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারে চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ।
এছাড়াও প্যানেল আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আরেফিন বাদল, ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজের অধ্যাপক অসীম বিভাকর, গাজীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রফিকুল ইসলাম খান, গাজীপুর পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক নজরুল ইসলাম।
গবেষণা বলা আছে, ২০০০ সাল থেকে ২৩ বছরে এক সময়কার সবুজ শ্যামল গাজীপুরের পরিবেশের বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেছে। উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে বনাঞ্চল, জলাশয়, উন্মুক্ত জায়গা। উল্টো দিকে, বেড়েছে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও শহরায়ণ। ঘটেছে, বন দখল, জলাশয় ভরাট ও গাছ কর্তন।
জেলায় ২০১১ সালে মোট জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৩০ লাখের কাছাকাছি। ২০২২ সালে তা এসে ঠেকেছে ৫০ লাখের বেশি। দেশের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৮ হাজার ১২৬ জন বাস করছে।
পরিবেশগত সমীক্ষা বলছে, ২০০০ সালে জেলায় মোট জলাভূমির পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৪৬২ হেক্টর, যা মোট আয়তনের ৬ দশমিক ৭৩ শতাংশ। ২০২৩ সালে এসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৫৬৮ হেক্টর, যা মোট আয়তনের ৩ দশমিক ২৭ শতাংশ।
একটি জেলার মোট আয়তন অনুযায়ী অন্তত ৭ থেকে ১৪ শতাংশ জলাভূমি থাকতে হয়। অথচ গাজীপুর আদর্শ মান থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। তার ওপর জেলায় তুরাগ, বালু, বংশী, শীতলক্ষ্যা, চিলাইসহ নদ-নদীগুলো শিল্পবর্জ্যসহ নানামুখী মারাত্মক দূষণের শিকার। যার প্রভাব পড়ছে জেলার সার্বিক পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যে।
একটি জেলার মোট আয়তন অনুযায়ী ২০-২৫ শতাংশ বনভূমি থাকতে হয়। ২০০০ সালে গাজীপুরে বনভূমির পরিমাণ ছিল ৩৯ হাজার ৯৪৩ হেক্টর বা ২৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ। ২০২৩ সালে জেলায় বনভূমির পরিমাণ এসে ঠেকেছে ১৬ হাজার ১৭৪ হেক্টর বা ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশে। অথচ এই জেলাতেই অবস্থিত ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বনভূমি।
গাজীপুরে ২০০০ সালে আবাদকৃত মোট কৃষিজমির পরিমাণ ছিল ১৮ হাজার ২৭০ হেক্টর। ২০২৩ সালে এসে আবাদকৃত কৃষি জমির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৩০৭ হেক্টরে। জেলায় ২০০০ সালে মানব বসতি ছিল ৮৫ হাজার ৫৭৩ হেক্টর এলাকায়, যা মোট আয়তনের ৫০ দশমিক ২১ শতাংশ। ২০২৩ সালে এসে বসতিকৃত এলাকা বেড়ে হয়েছে এক লাখ ১২ হাজার ১৭৯ হেক্টর; যা মোট আয়তনের ৬৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ।
২০০০ সালে শিল্প এলাকা বিস্তৃত ছিল ৯ হাজার ৭৩৬ হেক্টর জমিতে। ২০২৩ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার ৮৭৭ হেক্টরে। ২০০০ সালে জেলায় খোলা জায়গার পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৪৩৬ হেক্টর। ২০২৩ সালে যা এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১ হাজার ৩১৬ হেক্টরে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র বিনষ্ট করে অনিয়ন্ত্রিত শিল্পায়ন এবং নগরায়ণের বিধ্বংসী প্রভাবের কারণে গাজীপুর এখন দেশের পরিবেশগত বিপর্যয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছে। এই জেলার পরিবেশগত অবস্থা বেশ উদ্বেগজনক। এখানে উল্লেখযোগ্য হারে বনভূমি জলাভূমি দখল করা হচ্ছে। বায়ু ও পানি উভয়েরই দূষণের মাত্রা অতি উচ্চ। যা ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলছে জনস্বাস্থ্যে।
এমন পরিস্থিতিতে বেলা, বিআরএফ, আরডিআরসি এবং প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরে। এরপর আগত বিভিন্ন দপ্তরের ও পেশার মানুষ তাদের মতামত দেন।
গাজীপুর জেলা প্রশাসক নাফিসা আরেফিন বলেন, ‘বন দখলের অভিযোগ প্রতিদিনই আমরা পাচ্ছি। আলোচনা ও সালিসও করতে হচ্ছে। তবে এসব দখলের বিরুদ্ধে আমাদের প্রত্যেকের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করতে হবে। এ বিষয়ে আমার সরকারি যে দায়িত্ব রয়েছে তার সর্বোচ্চ ব্যবহার করব।’
বেলার ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী তাসলিমা ইসলাম বলেন, ‘সমস্যা দেখে আমরা আশাহত না হই। আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। দখল দূষণ চাইলেও সরকার বা বেলা একা সমাধান করতে পারবে না। আমরা নগরায়ণ চাই, উন্নয়ন চাই, কিন্তু সেই উন্নয়ন চাই না যে উন্নয়ন আমাদের পরিবেশকে দেখে না।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।