সূর্য, বর্তমানে বলা যায়, একটা বুদ্বুদের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যে বুদ্বুদের ঘনত্ব আন্তনাক্ষত্রিক মাধ্যমের ঘনত্বের চেয়ে কম। এই বুদ্বুদকে বলা হয় স্থানীয় বুদ্বুদ (Local Bubble), যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৩০০ আলোকবর্ষ। এর গড় ঘনত্ব হচ্ছে প্রতি ঘনমিটারে মাত্র ৫০ হাজার পরমাণু।
যেখানে আন্তনাক্ষত্রিক মাধ্যমের গড় ঘনত্ব হলো প্রতি ঘনমিটারে পাঁচ লাখ পরমাণু। এর সঙ্গে একটা তুলনা দিই—আমি যদি আমার ঘরে দুই হাত একত্র করি, তাহলে এর ভেতরে প্রায় ১০০ বিলিয়ন বাতাসের অণু–পরমাণু আটকা পড়বে। সে অর্থে যেকোনো আন্তনাক্ষত্রিক মাধ্যম প্রায় শূন্যই বলা চলে। মনে করা হয়, গত এক কোটি থেকে দুই কোটি বছরে আমাদের আশপাশের সুপারনোভা বিস্ফোরণের ফলে এই স্থানীয় বুদ্বুদ তৈরি হয়েছে।
সূর্যের এই গতিমুখকে সৌর শীর্ষ (Solar Apex) বলা হয়। দ্বিতীয় ছবিটাতে আমরা দেখছি, ছায়াপথের ধনু বা স্যাজিটেরিয়াস বাহুটিকে, গ্যালাক্সির কেন্দ্র কোন দিকে, সেটিকেও নির্দেশ করা হয়েছে। এ ছাড়া বৃশ্চিক বা স্করপিয়াস নক্ষত্রমণ্ডল ও ধনু বা স্যাজিটেরিয়াস নক্ষত্রমণ্ডলও নির্দেশ করা হয়েছে।
এবার লক্ষ করুন, শ্রবণা বা আলটেয়ার তারাটি, এর ওপর দিকে অভিজিৎ বা ভেগা তারার কাছে হারকিউলিস নক্ষত্রমণ্ডলের একটি দিকে সূর্য সেকেন্ডে প্রায় ১৩ কিলোমিটার বেগে ছুটে চলেছে। দেনেব, অভিজিৎ, শ্রবণা—তিনটি তারা মিলে যে ত্রিভুজ তৈরি করে, তাকে গ্রীষ্মের ত্রিভুজ বলে। অভিজিৎ তারার কাছেই সূর্যের গতিমুখ দেখা যাচ্ছে।
কিন্তু সৌর শীর্ষই গ্যালাক্সির মধ্যে সূর্যের গতিপথ নয়। এই যে ১৩ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ডে সূর্যের গতি বলা হলো, সেটি হলো স্থানীয় তারাগুলোর গড় গতির তুলনায় সূর্যের গতি, অর্থাৎ Local Standard of Rest (LSR)–এর তুলনায়। এই LSR আবার গ্যালাক্সির কেন্দ্রের চারদিকে ঘুরছে।
এটাকে আমি এভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি—আমি একটি বড় জাহাজের ভেতরে ঘোরাঘুরি করছি, এক কেবিন থেকে আরেক কেবিনে যাচ্ছি, আমার কোনো ধারণাই নেই যে জাহাজটি সিঙ্গাপুর থেকে চট্টগ্রামে যাচ্ছে। এই সৌর শীর্ষটি হলো আমি জাহাজের মধ্যে যে কেবিনের দিকে যাচ্ছি, সেই দিক এবং পুরো জাহাজটি হলো LSR, সেটি গ্যালাক্সির কেন্দ্রের চারদিকে ঘুরছে। LSR-এর গতিবেগ হলো সেকেন্ডে ২২০ কিলোমিটার।
অর্থাৎ এই যে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে সেকেন্ডে ৩০ কিলোমিটার বেগে ছুটছে, কিংবা সূর্য হারকিউলিস মণ্ডলের দিকে সেকেন্ডে ১৩ কিলোমিটার বেগে ছুটছে, সেগুলো সবই LSR-এ নিমজ্জিত, অর্থাৎ LSR জাহাজ গ্যালাক্সির চারদিকে ঘুরছে। আর এই মুহূর্তে এটির গতিমুখ হচ্ছে সিগনাস বা হংস তারকামণ্ডলীর দিকে (ছবি ৩ দ্রষ্টব্য)।
৪ নম্বর ছবিতে বিষয়টি হয়তো কিছুটা স্পষ্ট হবে। এখানে LSR হচ্ছে বাক্সটা, আর এই বাক্স গ্যালাক্সির চারদিকে ২২০ কিলোমিটার সেকেন্ডে ভ্রমণ করছে। এর ফলে একবার কেন্দ্রের চারদিকে ঘুরে আসতে ২২৫ থেকে ২৫০ মিলিয়ন বছর লাগে এবং মনে করা হয়, সূর্যের জন্মের পরে সূর্য কেন্দ্রের চারদিকে ২০ থেকে ২৫ বার ঘুরে এসেছে।
গ্যালাক্সির চারদিকে সূর্যের গতির ব্যাপারে আরেকটা গতির কথা উল্লেখ করতে হবে—সেটা হলো, সূর্য আমাদের ছায়াপথ গ্যালাক্সির তলের ওপরে ও নিচে ওঠানামা করে (ওপর নিচ বলছি, যদিও ওপর–নিচ বলে কিছু নেই)। এর পর্যায়কাল হচ্ছে মোটামুটি ৮০ মিলিয়ন বছর, অর্থাৎ সূর্য যত দিনে কেন্দ্রের চারদিকে একবার ঘুরে আসে, তত দিনে তিনবার সে এই তলে ওঠানামা করে।
গ্যালাক্সির তল থেকে সূর্য সর্বোচ্চ ৩৫০ আলোকবর্ষ ওপরে ওঠে বা নিচে নামে। তবে আমাদের গ্যালাক্সির তলটা ঠিক কোথায়, সেটা আমরা জানি না, বর্তমানে সূর্য সেই তল থেকে কিছুটা ওপরে আছে, অনেকের মতে, আমরা তিন মিলিয়ন বছর আগে এই তল পার হয়েছি।
গ্যালাক্সির মধ্যে সূর্যের ভ্রমণ নিয়ে আর একটা কথা বলে শেষ করি। সূর্য যখন কেন্দ্রের চারদিকে ঘোরে, সে আসলে একটা বিন্দুকে কেন্দ্র করে ঘোরে আর এই বিন্দু গ্যালাক্সির কেন্দ্রের চারদিকে ঘোরে। এই বিন্দুকে আমরা LSR বলে ভাবতে পারি। এই বিন্দুর চারদিকে সূর্যের উপবৃত্তাকার পথের ব্যাস ১৫০০ আলোকবর্ষ মতো হতে পারে এবং কেন্দ্রের চারদিকে একবার ঘোরার সময় সূর্য এই বিন্দুর চারদিকে ১.৩৫ বার ঘুরে আসে। কিন্তু ঘুরে একই বিন্দুতে আসে না। কাজেই গ্যালাক্সির কেন্দ্রের চারদিকে সূর্যের ভ্রমণপথ বেশ জটিল।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।