বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় রচিত হতে যাচ্ছে গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। ক্ষুদ্রঋণ বিতরণে বৈপ্লবিক ভূমিকা রাখা এই প্রতিষ্ঠানে সরকারের অংশীদারিত্ব কমিয়ে আনা এবং গ্রাহকদের ক্ষমতায়নের যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা দেশের অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা ও দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গ্রামীণ ব্যাংক আরও বেশি গ্রাহককেন্দ্রিক ও স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা ও কর্তৃত্বে বড় পরিবর্তন
গ্রামীণ ব্যাংককে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সময়ে নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সরকারের অংশীদারিত্ব ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। আর বাকি ৯০ শতাংশ মালিকানা থাকবে ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণকারী উপকারভোগীদের হাতে। এই পরিবর্তনের ফলে ব্যাংক পরিচালনায় উপকারভোগীদের সরাসরি অংশগ্রহণ ও মালিকানা নিশ্চিত হবে, যা এই প্রতিষ্ঠানের মূল দর্শনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
Table of Contents
অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংককে গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে এখন থেকে ব্যাংকের কোনো নীতিমালা বা নতুন শাখা খোলার ক্ষেত্রে সরকারের পরিবর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হবে। এই পদক্ষেপ ব্যাংক পরিচালনায় আরও স্বচ্ছতা ও দক্ষতা আনবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এছাড়া ব্যাংকের পর্ষদে ১২ জন সদস্যের মধ্যে ১১ জন গ্রাহকদের ভোটে নির্বাচিত হবেন এবং পর্ষদ নিজেই চেয়ারম্যান মনোনীত করবে। এর ফলে সরকারের নিয়ন্ত্রণ কমে গিয়ে উপকারভোগীদের মতামত এবং সিদ্ধান্তকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
আইন সংশোধনের পটভূমি ও অধ্যাদেশের গুরুত্ব
১৯৮৩ সালে গ্রামীণ ব্যাংক গঠিত হয় ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্য নিয়ে। শুরুতে এটি ছিল একটি প্রকল্প, যা চট্টগ্রামের জোবরা গ্রামে শুরু হয় এবং পরে তা গ্রামীণ ব্যাংকে রূপ নেয়। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এর নেতৃত্বে এই ব্যাংক সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয় এবং ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করে।
পরবর্তীতে ২০১৩ সালে ‘গ্রামীণ ব্যাংক আইন’ প্রণীত হয় যা সরকারের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করে এবং মূল দর্শন থেকে অনেকটা সরে আসে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে আবারও মূল আদর্শের পথে ফিরে আসা হচ্ছে।
নতুন অধ্যাদেশ অনুযায়ী, ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন হবে ৩০০ কোটি টাকা। উপকারভোগীরা ধীরে ধীরে মূলধনে অবদান বাড়িয়ে মালিকানার ৯০ শতাংশ অধিকার করবেন। পর্ষদ কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্যাংক পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন।
নতুন অধ্যাদেশের সম্ভাব্য প্রভাব ও সমাজে প্রভাব
এই অধ্যাদেশ বাস্তবায়িত হলে গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম আরও বিস্তৃত হবে। ইউনিয়ন পরিষদের গণ্ডি ছাড়িয়ে সিটি করপোরেশন এবং পৌর এলাকাগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ফলে শহরাঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীও ক্ষুদ্রঋণের সুফল ভোগ করতে পারবে।
এই উদ্যোগের ফলে নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আত্মনির্ভরশীলতা, এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তির সুযোগ বাড়বে। এছাড়া ব্যাংকের পরিচালনা আরও গণতান্ত্রিক ও গ্রাহককেন্দ্রিক হবে।
একইসঙ্গে এই অধ্যাদেশ ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি বার্তা দেয়। যেসব প্রতিষ্ঠান বা শিল্পগোষ্ঠী আগে এককভাবে ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল, তাদের প্রভাব কমিয়ে এনে সাধারণ জনগণের স্বার্থ রক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।
আরো কিছু সংশোধনী ও প্রাসঙ্গিক অধ্যাদেশ
সরকারি হিসাব নিরীক্ষা অধ্যাদেশ
২০১৩ সালের আইনকে যুগোপযোগী করে ২০২৫ সালের সরকারি হিসাব নিরীক্ষা অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অডিট স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ করে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ
ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা আনার জন্য এবং প্রভাবশালী শিল্পগোষ্ঠীর একক নিয়ন্ত্রণ রোধে এই অধ্যাদেশ পাস করা হয়েছে। এতে করে আমানতকারীদের স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা আরও সুসংহত হবে।
রাজস্ব নীতি ও ব্যবস্থাপনা পৃথককরণ
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী রাজস্ব নীতি এবং রাজস্ব সংগ্রহকে পৃথক করার উদ্দেশ্যে রাজস্ব নীতি ও ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ অনুমোদিত হয়েছে। এতে করে রাজস্ব আদায়ের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়বে।
জনগণের প্রত্যাশা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
এই পরিবর্তনের ফলে দেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। বিশেষ করে গ্রামীণ নারীদের আর্থিক স্বাধীনতা, আত্মমর্যাদা এবং সামাজিক অবস্থান আরও দৃঢ় হবে।
একইসঙ্গে সরকারের এই পদক্ষেপের ফলে আন্তর্জাতিক মহলেও বাংলাদেশের আর্থিক সংস্কার এবং সুশাসনের অঙ্গীকার দৃশ্যমান হবে।
গ্রামীণ ব্যাংক-এর নতুন কাঠামো যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে তা একটি সফল মডেল হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রশংসিত হতে পারে।
এই গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংক তার মূল আদর্শে ফিরে আসছে এবং দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে আরও শক্তিশালী অবদান রাখতে যাচ্ছে।
📌 জিজ্ঞাসা ও উত্তর (FAQs)
গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা কেন পরিবর্তন করা হলো?
প্রতিষ্ঠানটির মূল দর্শন অনুযায়ী উপকারভোগীদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে ব্যাংক পরিচালনায় আরও স্বচ্ছতা আনতেই মালিকানা কাঠামো পরিবর্তন করা হয়েছে।
নতুন অধ্যাদেশে সরকারের ভূমিকা কী হবে?
সরকারের মালিকানা ১০ শতাংশে সীমিত থাকবে এবং ব্যাংকের শাখা খোলাসহ অন্যান্য সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদন প্রদান করবে।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক কিভাবে নিয়োগ পাবেন?
ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বাছাই কমিটির মাধ্যমে ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দেবে।
এই পরিবর্তনের ফলে গ্রাহকরা কীভাবে উপকৃত হবেন?
গ্রাহকদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ বাড়বে, তারা পরিচালনায় ভূমিকা রাখতে পারবেন এবং ব্যাংকের মুনাফার অংশীদার হবেন।
এই অধ্যাদেশের ফলে ব্যাংকের কার্যক্রমে কী কী নতুন সুযোগ আসবে?
শহর এলাকাতেও ব্যাংক শাখা খোলার সুযোগ তৈরি হবে এবং নতুন সংজ্ঞায়িত গ্রাহকরা ক্ষুদ্রঋণের আওতায় আসবেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।