ফারুক তাহের, চট্টগ্রাম: দ্বাদশ সংসদীয় নির্বাচনী মাঠে চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের বিপরীতে শক্ত কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থী না থাকলেও কোনো কোনো আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বেশ শক্ত অবস্থানে রয়েছেন। বিশেষ করে চট্টগ্রাম মহানগরীর চার আসনের মধ্যে তিন আসনেই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবার সম্ভানা রয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গে।
প্রতীক বরাদ্দের পর বিভিন্ন মাজার জিয়ারত, কর্মিসভা, অফিস উদ্বোধন, উঠোন বৈঠক ও গণসংযোগে নেমে পড়েছেন দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মূলত আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত নেতা হওয়ায় নির্বাচনী আমেজে চাঙ্গাভাব বিরাজ করছে।
চট্টগ্রাম-৯ কোতোয়ালী আসনে এবারও আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী মহিউদ্দিন চৌধুরীর পুত্র মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থী নেই। ফলে এই আসন থেকে মহিবুল হাসানের দ্বিতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য হওয়াটা অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে আছে।
চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং-হালিশহর ও পাহাড়তলী) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. মহিউদ্দিন বাচ্চুর বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন সাবেক মেয়র মনজুর আলম মন্জু ও চট্টগ্রাম নগর যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহবায়ক ফরিদ উদ্দিন মাহমুদ।
মনজুর আলম দীর্ঘদিন আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে যু্ক্ত থাকলেও ২০১৮ সালের চট্টগ্রাম সিটি মেয়র নির্বাচনে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিনের বিপরীতে বিএনপির সমর্থন নিয়েও হেরে যান। কিন্তু দলীয় সমর্থনের বাইরে একজন দানশীল ও সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে তার যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। ফলে একদিকে বিএনপি-জামায়াত সংশ্লিষ্ট ভোট ও আওয়ামী লীগের একাংশের ভোটও তার ব্যালটে পড়তে পারে বলে ধারণা করছেন এলাকার সাধারণ লোকজন।
ভেতরে ভেতরে আওয়ামী লীগ চট্টগ্রাম মহানগর নেতৃবৃন্দের বড় একটি অংশ মনজুরের পক্ষে কাজ করছেন বলে বিশেষ একটি সমর্থনযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। সংসদীয় এলাকায় তার দীর্ঘদিনের পদচারণা থাকায় মানুষের কাছে পৌঁছুনো অনেকটা সহজ হয়ে ওঠেছে।
অপরদিকে মহিউদ্দিন বাচ্চু তিনমাস আগে চট্টগ্রাম-১০ আসনে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় তার একটি দলীয় কর্মী বাহিনি তৈরি হয়েছে। এবারও দলীয় প্রার্থী হওয়ায় দলের তরুণকর্মীরা তার পক্ষেই রয়েছে। নির্বাচনী কাজ পরিচালনার অফিস উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে নির্বাচনী প্রচার শুরু করেছেন তিনি। নগরীর দামপাড়ায় এই অফিস উদ্বোধনের সময় সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনসহ নগর আওয়ামী লীগের নেতারা ছিলেন।
ফুলকপি প্রতীকের প্রার্থী মনজুরুল আলম মনজু নির্বাচনকে অর্থবহ করার জন্য সরল মনে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে প্রার্থী হয়েছেন বলে এক কর্মীসভায় উল্লেখ করেছেন। তবে ভোটারদের নিরাপত্তা বিধান ও স্বাধীনভাবে ভোট প্রয়োগের পরিবেশ দাবি করেন তিনি।
প্রতীক বরাদ্দ পেয়ে চট্টগ্রাম-১০ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক যুবলীগ নেতা ফরিদ মাহমুদ নগরীর গরীব উল্লাহ শাহ মাজার জেয়ারত এবং তার মায়ের কবর জেয়ারত করে লালখান বাজার ওয়ার্ডের গরীব উল্লাহ শাহ হাউজিং সোসাইটি, কুসুমবাগ আবাসিক এলাকায় গণসংযোগ করেন। ফরিদ মাহমুদ ও মহিউদ্দিন বাচ্চু একই গুরুর শিষ্য হিসেবে পরিচিত হলেও গত কয়েক বছর ধরে তাদের ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব ও রাজনৈতিক আধিপথ্যের কারণে বিশাল দূরত্ব তৈরি হয়েছে। মহিউদ্দিন অনুসারী এই দুই নেতার মধ্যে এখন বৈরিতা চলছে।
পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে ফরিদ মাহমুদের সর্বত্রই একটা গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। রাজনীতির পাশাপাশি একজন লেখক হিসেবেও তার পরিচিতি গড়ে ওঠেছে কবি-সাহিত্যিক ও সাংবাদিক মহলে। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশা করেছিলেন। এবারও চেয়ে বঞ্চিত হওয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী মাঠে রয়েছেন। ফলে এই আসনে ত্রিমুখী লড়াই হবে বলে আগাম পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
গণসংযোগকালে কেটলি প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী ফরিদ মাহমুদ বলেন, ‘প্রার্থী সম্পর্কে তথ্য নিন, ভালো মানুষকে সমর্থন দিন। যারা ক্লিন ইমেজের অধিকারী, নম্র, ভদ্র, বিনয়ী, সাধারণ মানুষের সেবক হয়ে কাজ করবে, তাদের জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচন করুন।’
এদিকে চট্টগ্রাম ১১-(বন্দর পতেঙ্গা) আসনেও আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়নের পাশাপাশি শক্তিশালী আওয়ামী লীগ নেতার স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় চমক দেখা যেতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত।
এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন গত তিনবারের সংসদ সদস্য এম এ লতিফ। নির্বাচনি প্রচার শুরুর প্রথম দিনে তার অনুসারীরা নগরীর মাদারবাড়িতে গণসংযোগ করেন। তার পক্ষে আওয়ামী লীগের প্রথম সারির কোনো নেতা মাঠে কিংবা নেপথ্যে না থাকায় সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এবার পরিবর্তন আসতে পারে বলে মনে করছেন খোদ আওয়ামী লীগের দলীয় নেতা-কর্মীরা। জামায়াত সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তার পিছু না ছাড়লে বিগত সংসদ নির্বাচনগুলোতে দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীর সুযোগও ছিল না। ফলে তিনি সহজেই পার পেয়ে যান।
এবার চট্টগ্রামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ্ এই আসনে আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা ও স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর জিয়াউল হক সুমন কেটলি প্রতীক বরাদ্দ পেয়েই ঢোলবাদ্য বাজিয়ে নেতাকর্মীদের নিয়ে গণসংযোগে নেমে যান। নগরীর আগ্রাবাদ কমার্স কলেজ এলাকা থেকে জনসংযোগ শুরু করেন তিনি।
এ সময় কেটলি প্রতীকের প্রার্থী জিয়াউল হক সুমন বলেন, ‘আমার একটাই কথা, প্রধানমন্ত্রীকে আমরা আবারও ক্ষমতায় দেখতে চাই। আমি তৃণমূলের কর্মী। নেতাকর্মীদের সুখে-দুঃখে সবসময় ছিলাম, সবসময় আছি। ইনশল্লাহ আমি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাব।’
মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী এই নেতার পেছনে নগর আওয়ামী লীগের পুরো কমিটিই গোপনে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে বলে চাওর হয়ে গেছে। চট্টগ্রাম বন্দরে ব্যবসায়িক হিস্যা ও নানা কারণে লতিফের পক্ষে না থেকে আ জ ম নাছির উদ্দিনও সুমনের পক্ষে রয়েছেন বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। এমনকি নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি মাহতাব উদ্নি চৌধুরীও অনেকটা প্রকাশ্যে তার পক্ষে মাঠে কাজ করা শুরু করেছেন। ফলে এই আসনে এবার পরিবর্তন আসতে পারে।
চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও) আসনে আওয়ামী লীগ দলীয় মনোনয়ন দিয়েছিল মাত্র ৬ মাস আগে উপনির্বাচনে নির্বাচিত এমপি নোমান আল মাহমুদকে। কিন্তু জোটগত হিসাব-নিকাশের কারণে তাকে প্রত্যাহার করে এই আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয় জাতীয় পার্টির একক প্রার্থী সোলায়মান আলম শেঠকে। এর বিপরীতে শক্ত স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে অনড় রয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা ও দীর্ঘ ১০ বছরের চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম।
আবদুচ ছালামের স্থায়ী নিবাস ওই আসনের হওয়াতে এবং দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈকি সংগঠনের ব্যানারে এলাকায় জনসেবামূলক কাজ করে আসছিলেন তিনি ও তার পরিবার। ফলে এবার দলীয় কোনো প্রার্থী না থাকায় এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেও তার একটি রাজনৈতিক পরিচিতি থাকায় জয়লাভের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
সোলায়মান আলম শেঠের আবাস হচ্ছে চট্টগ্রাম ৯ আসনকেন্দ্রিক। জাতীয় পার্টির প্রভাবশালী এই প্রেসিডিয়াম সদস্য তার ‘ক্যারিশমেটিক’ কর্ম-পরিকল্পনা দিয়ে আওয়ামী সমর্থন ও স্থানীয় সাধারণ ভোটারের মন জয় করতে পারলে ভাগ্যে এমপি পদটা জুটে যেতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে। এছাড়া বিএনপি ও জামায়াত ভোটার টানতে পারলেও তার পক্ষে ইতিবাচক ফল দেবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।