জুমবাংলা ডেস্ক : কোটা সংস্কার ও সরকার পতনের একদফা আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট অস্থিতিশীল পরিস্থিতির প্রভাব এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি রপ্তানি খাত। কার্যক্রম চালু হলেও চট্টগ্রাম বন্দরের পরিচালনা এখনো ফেরেনি স্বাভাবিক ছন্দে। গতকাল পর্যন্ত ৫৫ হাজার ৭৮৭ টিইইউএস (২০ ফুট সমমানের) কনটেইনার জমেছে বন্দরে।
একদিকে আমদানি করা পণ্যের জট, অন্যদিকে রপ্তানিমুখী পণ্য জাহাজীকরণেও বিপত্তি দেখা দিয়েছে। সে কারণে রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনারের স্তূপ বাড়ছে চট্টগ্রামের বেসরকারি ১৯টি ডিপোতেও। সেখান থেকে দৈনিক রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার জাহাজে তুলে দেওয়া হলেও জট কমছে না। এতে সময়মতো পণ্য রপ্তানি নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।
ব্যবসায়ীদের দাবি, চলমান পরিস্থিতিতে এমনিতেই বড় ক্ষতির মুখে পড়েছেন তারা। কারখানাগুলোতে স্বাভাবিক হয়নি উৎপাদন। কারণ আমদানি ব্যাহত হওয়ায় কাঁচামালেরও সংকট দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে বন্দরের কার্যক্রম স্বাভাবিক ছন্দে না ফেরায় পণ্য জাহাজীকরণে জট দীর্ঘ হচ্ছে। এতে শিডিউল বিপর্যয়েরও শঙ্কা রয়েছে। সঙ্গে কারখানাগুলো ও পণ্য পরিবহনের নিরাপত্তা নিয়েও দুশ্চিন্তা বাড়ছে। বন্দরে পণ্য খালাস হলেও তা পরিবহন হচ্ছে না। সব মিলিয়ে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের।
বেসরকারি কনটেইনার ডিপো সমিতির হিসেবে, গেল ৮ আগস্ট সকালে চট্টগ্রামের ১৯টি ডিপোতে রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনারের সংখ্যা ছিল ১৩ হাজার ১৮৭। যেখানে স্বাভাবিক সময়ে ৬-৭ হাজার কনটেইনার থাকে। অর্থাৎ এখন সংখ্যাটা দ্বিগুণ। এ ছাড়া ডিপোগুলোতে ২ হাজারের বেশি রপ্তানি পণ্যবাহী কাভার্ড ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে।
জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে রপ্তানি হওয়া পণ্যের ৯০ শতাংশেরই ব্যবস্থাপনা করে সেখানকার বেসরকারি ২০টি ডিপো। রপ্তানিকারকরা কারখানা থেকে পণ্য কাভার্ড ভ্যানে করে ডিপোর ছাউনিতে রাখেন। সেখানে কাস্টমসের শুল্কায়ন প্রক্রিয়া শেষে রপ্তানিকারকের প্রতিনিধিরা বিদেশি ক্রেতার প্রতিনিধি ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার প্রতিষ্ঠানের কাছে পণ্য বুঝিয়ে দেন। তারা পণ্য কনটেইনারে বোঝাই করে বন্দর দিয়ে জাহাজে তুলে দেয়। এ ছাড়া খালি কনটেইনারও সংরক্ষণ করা হয় ডিপোগুলোতে। আবার ৩৮ ধরনের আমদানি পণ্য বন্দর থেকে ডিপোতে এনে খালাস করা হয়।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফা) সহসভাপতি খায়রুল আলম কালবেলাকে বলেন, কোটা সংস্কার ও সরকার পতনের আন্দোলন ঘিরে অনিশ্চয়তার কারণে রপ্তানি পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাহত হয়েছে। নতুন সরকার গঠনের পর আশা করছি, খুব দ্রুত এ জট নিরসন হবে। সে জন্য রপ্তানি কার্যক্রমে যুক্ত সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
তবে খাত-সংশ্লিষ্টরা জানান, রপ্তানি পণ্যের এ জট আরও বাড়তে পারে। কারণ, কয়েক দিন বন্ধ থাকার পর গত বৃহস্পতিবার থেকে পোশাক কারখানা খুলেছে। সড়কে রপ্তানি পণ্য পরিবহনে অনিশ্চয়তার কারণে অনেক মালিক পণ্য পাঠাননি ডিপোতে। কারখানায় আটকে থাকা এসব পণ্যও এখন ডিপোতে আসতে শুরু হয়েছে।
তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। ফলে কারখানাগুলোয় পুরোদমে কাজ চলছে। তবে ডিপোতে যেহেতু পণ্যের চাপ বেড়েছে, সেজন্য বন্দরের বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
কনটেইনার ডিপো সমিতির দুদিনের হিসাবে দেখা যায়, ডিপো থেকে বন্দর দিয়ে রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার জাহাজে তুলে দেওয়ার হার কমছে। অন্যদিকে কারখানা থেকে ডিপোতে কাভার্ড ভ্যানে পণ্য আনার হার বেড়েছে। গত ৬ আগস্ট ডিপো থেকে বন্দরে রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার পাঠানো হয়েছে ২ হাজার ৩১২টি। পরদিন তা কমে দাঁড়ায় ২ হাজার ৩টিতে। অন্যদিকে একই দিন কারখানাগুলো থেকে পাঠানো কাভার্ড ভ্যানের সংখ্যা ১ হাজার ৫০৯টি। পরদিন তা বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ১০২টিতে।
জানতে চাইলে কনটেইনার ডিপো সমিতির মহাসচিব রুহুল আমিন সিকদার বলেন, জট কমাতে হলে বন্দরে কনটেইনারবাহী জাহাজ আগের তুলনায় বাড়ানো দরকার। তবে সেক্ষেত্রে আমদানি কনটেইনারের চাপ বেড়ে যেতে পারে। সেটিও সামাল দেওয়া যাবে, যদি এক মাসের জন্য আমদানি পণ্যভর্তি কনটেইনার ডিপোতে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়।
ডিপোর মতো বন্দরও এখন কনটেইনার ও জাহাজজটে পড়েছে। জেটিতে ভেড়ানোর জন্য সাগরে অপেক্ষমাণ জাহাজের সংখ্যাও বাড়ছে। গত কয়েক দিনে গড়ে ১৫টির মতো জাহাজ অপেক্ষা করছে বহির্নোঙরে। আবার জেটিতেও আমদানি পণ্যবাহী কনটেইনারের স্তূপ। বন্দরে আমদানি পণ্যবাহী কনটেইনারের সংখ্যা ৪০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর পোর্ট অ্যান্ড শিপিং স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান তরফদার মো. রুহুল আমীন বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সরবরাহ ব্যবস্থা অনেকটাই ভেঙে পড়েছিল। তবে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর ব্যবসায়ীদের মধ্যে স্বস্তি ফিরেছে। বর্তমানে বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং টার্মিনাল অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেক আমদানি কনটেইনার ডেলিভারি ও রপ্তানি কনটেইনার জাহাজীকরণের জন্য প্রস্তুত আছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সহায়তা চান তিনি।
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় পণ্য খালাসের হার বাড়ছে। ব্যবসায়ীরা খালাসের হার আরও বাড়ালে পরিচালন কার্যক্রম দ্রুততর হবে।
বাংলাদেশ প্লাস্টিক গুডস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিজিএমইএ) সভাপতি শামীম আহমেদ বলেন, প্লাস্টিক খাতের রপ্তানি এমনিতেই কমছে। গত জুলাইয়ের শেষভাগে রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশি। দ্রুত কনটেইনার জট না কাটলে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বাড়বে।
বাংলাদেশ জুট গুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেজিইএ) চেয়ারম্যান আহমেদ মজুমদার বলেন, রপ্তানি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে বৈদেশিক মুদ্রার আয় ব্যাপকভাবে কমে যাবে। বিদেশি ক্রেতারাও মুখ ফিরিয়ে নেবে। এরই মধ্যে অনেক ক্রেতা হারিয়েছি আমরা। তাই রপ্তানি চেইন দ্রুত স্বাভাবিক করায় গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তার জন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়া জরুরি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।