ফারুক তাহের, চট্টগ্রাম: স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগের তিন হেভিওয়েট প্রার্থী মনোনয়ন ফিরে পাওয়ায় চট্টগ্রাম নগর ও উত্তর-দক্ষিণ জেলার নির্বাচনী হাওয়ায় ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দিয়েছে।
দলীয় টিকিট না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া এই তিন নেতা হলেন-চট্টগ্রাম-১ (মীরসরাই) আসনের মোঃ গিয়াস উদ্দিন, চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী ও নগরীর একাংশ) আসনের আবদুচ ছালাম এবং চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনের এম এ মোতালেব।
আপিল শুনানিতে তারা মনোনয়ন ফিরে পাওয়ার খবরে চট্টগ্রামে তাদের সমর্থক ও অনুসারীদের মধ্যে খুশির আমেজ এসেছে।
রবিবার (১০ ডিসেম্বর) ঢাকায় নির্বাচন কমিশনে অনুষ্ঠিত আপিল শুনানির পর তিন জনের মনোনয়ন পত্র বৈধ ঘোষণা করা হয়। নির্বাচন কমিশন মিলনায়তনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল ও চার কমিশনার আপিল শুনানি করেন। দাখিল করা এক শতাংশ ভোটারের সই ত্রুটিপূর্ণ থাকার অভিযোগে তাদের মনোনয়নপত্র বাতিল করেছিলেন রিটার্নিং কর্মকর্তা।
চট্টগ্রাম-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের ছেলে মাহবুব রহমান রুহেল। মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছিলেন উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের ডাকসাইটে নেতা গিয়াস উদ্দিন। স্বতন্ত্র প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মনোনয়ন ফিরে পাওয়ার পর সোচ্চার হলেন তিনি ও তার অনুসারীরা। ফলে মীরসরাইয়ে মোশাররফপুত্র রুহেলের সঙ্গে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকছেন গিয়াস।
২০০৯ সালে তিনি মীরসরাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। এক সময় মোশাররফ ও গিয়াসের মধ্যে ‘গুরু-শিষ্যের’ সম্পর্ক থাকলেও ২০০৯ সালের পর তাতে ভাঙন ধরে। দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও পরিচ্ছন্ন রাজৈনীতিক হিসেবে গিয়াস উদ্দিনের যে সুনাম রয়েছে, তা কাজে লাগানোর চেষ্টায় বদ্ধ পরিকর মীরসরাইয়ের মাঠের নেতা-কর্মীরা।
অন্যদিকে, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন একই আসন থেকে ৭ বারের নির্বাচিত এমপি ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে দক্ষতার সঙ্গে যে দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ার গড়ে তুলেছেন, পুত্র রুহেলের নির্বাচনী মাঠে তা সুপ্রসন্ন হয়ে ওঠবে বলে মনে করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের বৃহত্তর একটি অংশ।
প্রার্থিতা নিয়ে শঙ্কা কেটে যাবার পর গিয়াস উদ্দিন মুঠোফোনে জুমবাংলাকে বলেন, ‘আমি হয়রানির শিকার হলেও ন্যায়বিচার পেয়েছি। আমি চাই, ভোটের মাধ্যমে মানুষ তাদের জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করুক। দলীয় মনোনয়ন না পেলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছি মীরসরাইয়ের মানুষের ভালোবাসা ও তাদের অনুরোধে। যারা দলকে ভালবাসেন তারা আমাকেও ভালোবাসেন বলে আমি বিশ্বাস করি। মানুষের রায়ে আমি জয়ী হবো ইনশাল্লাহ।’
এদিকে চট্টগ্রাম-৮ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নোমান আল মাহমুদ। এ আসনে ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন নগর কমিটির কোষাধ্যক্ষ ব্যবসায়ী আবদুচ ছালাম। কিন্তু জোট রাজনীতির কারণে আসনটি ছেড়ে দেওয়া হয় জাসদের মঈন উদ্দিন খান বাদলকে।
ওই আসনের এমপি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমেদ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে মারা গেলে নোমান আল মাহমুদ উপনির্বাচনে মনোনয়ন পেয়ে জয়ী হন। অর্থ-বিত্তের অধিকারী না হলেও রাজনৈতিক জীবনে অনেক দিনের ত্যাগ রয়েছে আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী এই নেতার।
২০০৮ সাল থেকে প্রতিটি সংসদ নির্বাচন এবং দুই দফা উপনির্বাচনে মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হন আবদুচ ছালাম, যিনি ১০ বছর সিডিএ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আওয়ামী লীগের কিংবদন্তী নেতা মহিউদ্দিন চৌধুরীর সময়ে তিনি চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষের পদেও ছিলেন দীর্ঘদিন। এবার স্বতন্ত্র প্রার্থিতা উন্মুক্তের সুযোগে তিনি নির্বাচনের মাঠে নামেন। অর্থ-বৈভবের অধিকারী এই নেতার সঙ্গে আওয়ামী লীগ প্রার্থী নোমান আল মাহমুদ পেরে উঠবেন কিনা তা নিয়ে শুরু হয়েছে হিসাব-নিকাশ।
মনোনয়ন ফিরে পাওয়া আবদুচ ছালাম মুঠোফোনে জুমবাংলাকে বলেন, ‘আমরা পারিবারিকভাবে সবসময় মানুষের সঙ্গে ছিলাম, এখনও আছি। আমি সিডিএ চেয়ারম্যান ছিলাম। আমার নেত্রী শেখ হাসিনা আমাকে এ দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আমি চট্টগ্রাম শহরের কী কী উন্নয়ন করেছি, সেটা নগরবাসী জানেন। তাই এলাকার জনগণ আমার সঙ্গে আছেন। তাদের ভোটেই ইনশল্লাহ আমি জয়ী হবো।’
চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনে এবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভী। একসময়ের জামায়াতে ইসলামীর অন্যতম এই পৃষ্ঠপোষককে ২০১৪ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ, যিনি ‘মধ্যপ্রাচ্য লবিস্ট’ হিসেবে বেশ পরিচিত ও আলোচিত। আওয়ামী লীগ তাকে দলে নিলেও দলটির পোড়খাওয়া অনেক নেতাকর্মীই তাকে মেনে নিতে পারেননি। আবার অনেকেই ভিড়ে যান তার সঙ্গে। ফলে এই আসনের সাধারণ মানুষও বিভ্রান্তিতে পড়ে যান। একাংশের বিরোধিতা থাকা সত্বেও নদভী ২০১৪ ও ২০১৮ সালে সাংসদ নির্বাচিত হন।
গত ১০ বছরে সংসদ সদস্য হিসেবে নদভী’র কর্মকাণ্ড আলোচনা-সমালোচনা থাকলেও আওয়ামী লীগের উপর মহলে তার রয়েছে শক্ত যোগাযোগ। ফলে জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে যুক্ত নিজের স্বজন ও অনুসারীদের তিনি ইতিমধ্যেই আওয়ামী লীগে প্রতিষ্ঠা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ ও ত্যাগী নেতারা কোণঠাসা হয়ে পিছিয়ে রয়েছেন।
আওয়ামী লীগ নেতা ও সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং উপজেলা চেয়ারম্যান শিল্পপতি এম এ মোতালেবকে পাশে রেখে গত দুই সংসদ নির্বাচনে নদভী নির্বাচনী বৈতরণী পার হলেও এবার বেঁকে বসেছেন মোতালেবসহ বেশ কয়েকজ কেন্দ্রীয় নেতা। তম্মধ্যে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়া অন্যতম। ফলে দলীয় মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন ফরম জমা দেনে মোতালেব। আপিল শুনানীর পর প্রার্থীতা ফিরে পেলে সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনে এবার নতুন করে মেরুকরণ তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের প্রকৃত অনুসারীরা।
এ প্রসঙ্গে এম এ মোতালেব জুমবাংলাকে বলেন, ‘অনেক ষড়যন্ত্রের পরও ন্যায়বিচার পেয়েছি। রবিবার ঢাকা থেকে এলাকায় ফিরেই এলাকায় নির্বাচনি প্রস্তুতি শুরু করেছি। এতে এলাকার মানুষের যে উচ্ছ্বাস ও ভালোবাসা দেখছি, তাতে আমি জয়ের ব্যাপারে অত্যন্ত আশাবাদী।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।