নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম : প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে উত্তাল বঙ্গোপসাগর। জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যাওয়ায় প্লাবিত হয়েছে নগরীর পতেঙ্গা এলাকায় বেড়িবাঁধসংলগ্ন লোকালয় এবং আনোয়ারা, বাঁশখালীসহ বেশ কিছু উপকূলীয় এলাকা।
তবে ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতের আশঙ্কায় সকাল থেকেই উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দারা নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র নিয়ে নিরাপদে চলে যেতে শুরু করেন রোববার সকাল থেকেই। জেলেদেরকে তাদের মাছ ধরার নৌকা ও জাল নিয়ে অন্য স্থানে যেতে দেখে যায়।
স্থানীয়দের আশঙ্কা, ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলে পানি আরও বেড়ে জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি হতে পারে। এজন্য দুপুরের পর অনেককে বেড়িবাঁধসংলগ্ন এলাকা থেকে দোকানপাট গুটিয়ে চলে যেতে দেখা যায়।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন কর্তৃপক্ষ সার্বক্ষণিক নিয়ন্ত্রণকক্ষ খুলে উপকূলীয় এলাকাবাসীদের নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছে। জেলার প্রায় প্রতিটি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে খোলা হয়েছে ‘হেল্প ডেস্ক’। দফায় দফায় অনলাইন মিটিং আয়োজনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান।
ঘূর্ণিঝর মোকাবেলার প্রস্তুতি প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. আবদুল মালেক জুমবাংলাকে বলেন, আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী ঘূর্নিঝড় রেমাল অনেক শক্তিশালী হতে পারে। তাই আমরা ঝুঁকি মোকাবেলায় উপকূলীয় অঞ্চল থেকে লোকজন সরিয়ে নিচ্ছি। এলাকায় এলাকায় মাইকিং করে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ স্থানের লোকজনকে সতর্ক করা হয়েছে। এবং আমাদের স্বেচ্ছাসেবীরা আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে উপকূলীয় অধিবাসীদের নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। ফলে এখন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় আর বেশি লোকজন নেই। অনেকে গবাদীপশু ও গুরুত্বপূর্ণ মালামাল নিয়ে আত্বীয়-সবজনদের বাড়িতেও আশ্রয় নিচ্ছেন।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম নগরীর ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বৈধ বা অবৈধ বাসিন্দাদেরও নিরপাদে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। সেইসঙ্গে আশ্রয়কেন্দ্রগুলো শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
আনোয়ারা উপকূলীয় এলাকার মৎস্য ব্যবসায়ী মো. আবদুর নূর বলেন, ‘আজ দুপুরের জোয়ারে পানি বেড়েছে। রাতের জোয়ারে তা আরও অনেক বাড়তে পারে। ঘূর্ণিঝড় এখনও বাংলাদেশে আঘাত করেনি। আঘাত করলে পানির স্রোত আর বেশি হবে। তাই আমাদের মাছ ধরার সব সরঞ্জাম নিরাপদে নেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। তবে এলাকার মানুষের হাতে এখন টাকা পয়সার খুব সংকট চলছে। এ অবস্থায় আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।’
রেডক্রিসেন্টের জোনাল কো-অর্ডিনেটর তৌসিফ রেজওয়ান বলেন, ‘পতেঙ্গা উপকূলের মূল বাঁধের এখনও কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে সংলগ্ন বিভিন্ন ঘেরের বাঁধের একাংশ ভেঙ্গে পড়েছে। জেলেপাড়ার ভেতরে পানি ঢুকে গেছে। কিছু ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়েছে। জেলেপাড়ার অনেকেই নিরাপদ স্থানে চলে গেছেন। আমাদের স্বেচ্ছাসেবীরা জিনিসপত্র নিতে সহযোগিতা করছে।’
আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, উত্তরপশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে একই এলাকায় ১৯.৮ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯.৪ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থান করছে। এটি আজ (২৬ মে) সকাল ৯টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৩৮০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৩৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্র বন্দর থেকে ২৯৫ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ২৬৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থান করছিল।
এটি আরও উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে আজ (রোববার) সন্ধ্যা বা মধ্যরাত নাগাদ মোংলার নিকট দিয়ে সাগর আইল্যান্ড (পশ্চিমবঙ্গ) খেপুপাড়া উপকূল অতিক্রম করতে পারে।
বঙ্গবন্ধু টানেল বন্ধ : বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল ১২ ঘণ্টা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় রেমালের সম্ভাব্য আঘাতে ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি এড়াতে টানেল চালুর পর প্রথমবারের মতো সাময়িক বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
রোববার (২৬ মে) সন্ধ্যা ৬টা থেকে সোমবার ভোর ৬টা পর্যন্ত টানেল দিয়ে গাড়ি চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু টানেলের নির্বাহী প্রকৌশলী (টোল, ট্রাফিক ও ইএমই) মো. নজরুল ইসলাম।
সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। বৈঠক শেষে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান এ তথ্য জানিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিকেল সাড়ে ৫টায় টানেলের উভয়প্রান্তের চারটি ৪টি ফ্লাড গেইট বন্ধ করবে টানেল কর্তৃপক্ষ। তবে সাগরে পানির উচ্চতা সর্বোচ্চ সাড়ে ৭ মিটার পর্যন্ত টানেলে পানি প্রবেশ করবে না। তবে এর বেশি হলে টানেলের ভেতরে পানি প্রবেশের ঝুঁকি থাকবে। কিন্তু ফ্লাড গেইট বন্ধ থাকলে পানি টানেলের ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে না।
জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু টানেলের নির্বাহী প্রকৌশলী (টোল, ট্রাফিক ও ইএমই) মো. নজরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘বঙ্গোপসাগর ও কর্ণফুলী নদীর মোহনায় টানেলের অবস্থান হওয়ায় ঘূর্ণিঝড়ে আঘাতের ঝুঁকি বেশি। এজন্য আমরা আজ (রোববার) রাতের শিফটে অর্থাৎ সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত ১২ ঘণ্টা টানেল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পরবর্তী আবহাওয়া পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সেতু কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবে।’
শাহ আমানত বিমান বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ : ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতের আশঙ্কায় চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদফতর ৯ নম্বর মহাবিপৎসংকেত জারির পর রোববার (২৬ মে) সকালে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দায়িত্বরত বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন তসলিম আহমেদ জুমবাংলাকে বলেন, দুপুর ১২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সকল ধরনের ফ্লাইট অপারেশনসহ সার্বিক কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। এরপর আবহাওয়া পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সেক্ষেত্রে অপারেশন বন্ধের মেয়াদ বাড়তে পারে।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, রোববার সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশেল পটুয়াখালীর খেপুপাড়া ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাগর দ্বীপ উপকূলে আঘাত হানতে পারে রেমাল। উপকূলে আছড়ে পড়ার সময়ও এটি প্রবল ঘূর্ণিঝড় আকারেই থাকতে পারে। এ সময় বাতাসের গতিবেগ থাকতে পারে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত।
জাহাজশূন্য চট্টগ্রাম বন্দর : ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতের আশঙ্কায় চট্টগ্রাম বন্দরের জেটি থেকে ১৬টি জাহাজ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বহির্নোঙ্গর থেকে ৪৯টি জাহাজকে গভীর সমুদ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। জেটি থেকে সর্বশেষ কনটেইনার পরিবহন চলছিল, সেটাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ আসা-যাওয়া, কনটেইনারসহ পণ্য ওঠানামা ও খালাসসহ সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে আবহাওয়া অধিদফতর ছয় নম্বর বিপৎসংকেত জারির পর শনিবার (২৫ মে) রাতে নিজস্ব ‘অ্যালার্ট-থ্রি’ অর্থাৎ বিপৎ সংকেত জারি করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এরপর নয় নম্বর মহাবিপৎসংকেত জারির পর বন্দর তাদের নিজস্ব ‘অ্যালার্ট-ফোর’ জারি করেছে।
শনিবার রাত ১০টার দিকে চট্টগ্রাম বন্দরের জারি করা বিশেষ নির্দেশনায় জেটিতে থাকা সব জাহাজকে জোয়ার শুরুর সঙ্গে সঙ্গে জেটি ত্যাগের কথা বলা হয়। বহির্নোঙ্গরে থাকা সব জাহাজকে রাত থেকেই গভীর সমুদ্রের উদ্দেশে রওনা দিতে বলা হয়। বন্দরের জেটি ও ইয়ার্ডে কনটেইনার পরিবহন ছাড়া বাকি সব ধরনের কার্যক্রম শনিবার রাতেই বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বন্দর চ্যানেল দিয়ে ছোট ছোট নৌযানগুলোকে তাদের চলাচল বন্ধ করে অভ্যন্তরীণ নৌবন্দরে ফেরত যেতে বলা হয়।
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘রাতে জোয়ার না থাকায় আজ (রোববার) সকালে জেটি থেকে ১৬টি জাহাজকে শাহ আমানত সেতুর দিকে কর্ণফুলী নদীর উজানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বহির্নোঙ্গরে ৪৯টি জাহাজ ছিল। সাগর উত্তাল থাকায় গতকাল (শনিবার) এমনিতেও সেখানে পণ্য ওঠানামা হয়নি। রাতেই সেগুলোকে গভীর সমুদ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর এখন একেবারে জাহাজশূন্য আছে। জেটিতে অতিরিক্ত নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন করা হয়েছে। আমাদের ইক্যুইপমেন্টগুলো সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।