বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক : বিভিন্ন উপকথায় চাঁদকে দেখানো হয়েছে থকথকে সুবুজাভ পনিরের পিণ্ড। অবশেষে রায় এলো চাঁদ তো পনিরের তৈরি নয়ই, সঙ্গে পাওয়া গেলো চাঁদের গঠন নিয়ে বাস্তুনিষ্ঠ প্রমাণ।
গবেষণায় উঠে এসেছে চাঁদের ভেতকার গঠন নিরেট, ঘনত্ব অনেকটাই লোহার কাছাকাছি। চাঁদের অভ্যন্তরে গঠন কঠিন না গলিত; বিজ্ঞানী মহলে দীর্ঘদিনের বিতর্কের বুঝি অবসান হলো এবার। আর এ নিয়ে নিবন্ধ ছেপেছে বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন এবার চাঁদের পূর্ণাজ্ঞ ইতিবৃত্ত ও সৌরজগতের নানান অজানা দিক জানা যাবে।
‘ফান্স ন্যাশনাল সেন্টার ফর সায়েন্টিফিক রিসার্চে’ (সিএনআরএস) করা পরীক্ষাটির দলনেতা জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর্থার ব্রাইউড বলছেন, “চাঁদের চৌম্বকক্ষেত্রের বিবর্তন নিয়ে অনুসন্ধান করতে গেলে ভেতরের নিরেট অংশের উপস্থিতি সম্পর্কে জানা যায়, যা একটি অখণ্ড কঠিন আবরণের উপস্থিতি সমর্থন করেছে। এতে করে সামনে সৌরজগতের প্রথম একশো কোটি বছরে চাঁদে বিশালাকৃতির উল্কাপাতের (যা লুনার বম্বার্ডমেন্ট নামে পরিচিত) স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে।”
ভৌত-কম্পনের ডেটা বিশ্লেষণ করে সবচেয়ে কার্যকরভাবে কোন সৌরবস্তুর ভেতরের গঠন ও উপাদান সম্পর্কে জানা যায়। ভৌত-কম্পনে যে তরঙ্গ তৈরি হয় সেগুলো পর্যবেক্ষণ করে চাঁদের ভেতরের গাঠন-উপাদানের পূর্ণাঙ্গ তালিকা বের করতে পারবেন, বলছেন বিজ্ঞানীরা।
বিজ্ঞানীদের কাছে অ্যাপোলো মিশনের ভৌত-কম্পন (সিসমিক) ডেটা রয়েছে, কিন্তু সেগুলো দিয়ে চাঁদের ভেতরের গঠন কেমন, সেটা পুরোপুরো নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। একদম কেন্দ্রের কিছুটা বাইরের দিকে গলিত লাভার একটি স্তর রয়েছে। তারও ভেতরের অংশ কি গলিত না নিরেট সেটা নিয়ে বিতর্ক বেশ পুরনো। অ্যাপোলো মিশনের ডেটা দুইটি বক্তব্যকেই সমর্থন করে।
এর সুস্পষ্ট উত্তরে খুঁজতে ব্রাইউড ও তার দল অন্যান্য স্পেস মিশনগুলোর ডেটা ব্যবহার করেছেন। তার সঙ্গে চালিয়েছেন লেজার রেঞ্জিং (কোন বস্তুর উপর লেজার রশ্মি ফেলে ও প্রতিফলিত রশ্মিটি গ্রহণ করে মধ্যবর্তী দূরত্ব এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য নির্ণয়ের পরীক্ষা) মত পরীক্ষা নিরীক্ষা। সে সব থেকে জানা গেছে পৃথিবীর অভিকর্ষের প্রভাবে চাঁদের গঠন পরিবর্তনের মাত্রা, চাঁদের ঘনত্ব, পৃথিবী ও চাঁদের মধ্যকার দূরত্বের ভিন্নতাসহ আরো চাঁদের অসংখ্য খুঁটিনাটি তথ্য।
গবেষণাটির পরবর্তী অংশে তারা ভিন্ন ভিন্ন উপাদান হলে কোর (কেন্দ্রের গঠন) কেমন হতো, সেসব মডেল তৈরি করে পরীক্ষায় প্রাপ্ত ডেটার সঙ্গে মিলিয়ে দেখেন।
বেশকিছু চমকপ্রদ তথ্য সে সব থেকে জানতে পেরেছে গবেষক দলটি। চাঁদের উপরিভাগ থেকে কেন্দ্রের দিকে গেলে ক্রমশ ঘনত্ব বাড়তে থাকে, এটাই চাঁদের গঠন নিয়ে বহুল প্রচলিত তত্ত্ব, যা দিয়ে চাঁদের আগ্নেয়গিরির অঞ্চলের নির্দিষ্ট কিছু মৌলের উপস্থিতি ব্যাখ্যা করা হয়। সিএনআরএস এর বিজ্ঞানীদের করা গবেষণা আরো নতুন কিছু দিক সামনে এসে সেই তত্ত্বকেই সমর্থন করছে।
গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, চাঁদের ভৌত আবরণগুলোর গঠন অনেকটাই পৃথিবীর আবরণগুলোর মতই। এর বাইরের গলিত অংশের ভেতরে রয়েছে নিরেট অংশ। তাদের মডেল অনুসারে এর বাইরের দিকের ব্যাসার্ধ তিনশো ৬২ কিলোমিটার আর একদম ভেতরের অংশে সেটা দুইশো ৫৮ কিলোমিটার, যা চাঁদের ব্যসার্ধের শতকরা প্রায় ১৫ ভাগ। তাদের প্রাপ্ত ফলাফলে চাঁদের একদম কেন্দ্রে প্রতি ঘনমিটারের ভর সাত হাজার আটশো ২২ কিলোগ্রাম যা লোহার আপেক্ষিক গুরুত্বের প্রায় সমান।
২০১১ সালে নাসার ভূ-তত্ত্ব বিষয়ক ‘মার্শাল প্ল্যানেটারি’ বিজ্ঞানী রেনে ওয়েবার অ্যাপোলো মিশনের ডেটা থেকে তরঙ্গ বিশ্লেষণ করে কাছাকাছি একটি ফলাফল পান। সেখানে চাঁদের কেন্দ্রের কোরের ব্যাসার্ধ আসে ২৪০ কিলোমিটার এবং ঘনত্ব পাওয়া যায় প্রতি ঘনমিটারে আট হাজার কিলোগ্রাম।
ব্রাইউড ও তার দলের প্রাপ্ত ফলাফল আগের ওয়েবারের প্রাপ্ত আগের ফলফলকেই সমর্থন করছে। তাতে করে চাঁদের ভেতরের অংশের গঠন পৃথিবীর ভেতরকার মত, এমনটাই প্রতীয়মান হয়। সঙ্গে সঙ্গে চাঁদের বিবর্তনের নিয়ে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও উঠে এসেছে।
চাঁদের উৎপত্তির পর পর এর শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র ছিলো, তিনশ ২০ কোটি বছর আগে থেকে যার তীব্রতা কমতে শুরু করে। কোন সৌরবস্তুর কেন্দ্রের ঘূর্ণন ও তাপীয় পরিবর্তনের ফলে এই রকম চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি হয়। তাই চাঁদের কেন্দ্রের ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে পারলে তা চাঁদের চৌম্বক ক্ষেত্রকেও ব্যাখ্যা করতে পারবে।
গত কয়েক বছরে চাঁদে মানুষের অভিযান নিয়ে নতুন করে চেষ্টা চালাচ্ছে বিভিন্ন দেশের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা। তাই আশা করা যাচ্ছে ব্রাইউড ও তার দলের পাওয়া এই ফলাফলকে অচিরেই আধুনা সিসমমিক প্রযুক্তি দিয়ে যাচাই বাছাই করে দেখা সম্ভব হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।