চাঁদের কোনো বায়ুমণ্ডল আছে? প্রশ্নটা শুনে একটু থতমত খেয়ে গেলে দয়া করে সে জন্য নিজেকে দোষ দেবেন না। ধূসর চাঁদকে বরাবরই পাথরের স্তুপ বলেই ভেবেছে মানুষ। কবি-সাহিত্যিকেরা তাতে কাব্যের প্রলেপ দিয়েছেন, রূপকথায় উঠে এসেছে চাঁদের বুড়ির কথা; একটু কাব্যিক ঢঙে জনপ্রিয় ধারার বিজ্ঞানে বলা হয়েছে ‘পৃথিবীর বহুকালের সঙ্গী’। তবে প্রচলিত ধারায় এর কথা এলেই শোনা যায়—চাঁদে বাতাস নেই, কারণ, এর কোনো বায়ুমণ্ডল নেই। কথাটা অর্ধসত্য। চাঁদে শ্বাস নেওয়ার মতো বাতাস নেই বটে, তবে অত্যন্ত পাতলা বায়ুমণ্ডল রয়েছে একে ঘিরে।
প্রশ্নটা তো ঠোঁটে এসেই রয়েছে—কোত্থেকে, কীভাবে এল এই বায়ুমণ্ডল? সে রহস্যের সমাধান অবশেষে পাওয়া গেল। এ নিয়ে একদল বিজ্ঞানী গত ২ আগস্ট সায়েন্স অ্যাডভান্স জার্নালে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। চাঁদের বায়ুমণ্ডলটিকে বলা যায় এক্সোস্ফিয়ার বা বহিঃআবরণ। বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরেই ভাবছেন, এটি এল কোত্থেকে, আর টিকে রইলই-বা কীভাবে? সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গেছে, মহাজাগতিক পাথুরে হামলাই এর পেছনের মূল কারিগর!
চাঁদের বয়স প্রায় সাড়ে ৪ বিলিয়ন বা ৪৫০ কোটি বছর। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে বারবার বিভিন্ন উল্কা, মহাজাগতিক পাথরখণ্ড আছড়ে পড়েছে চাঁদের মাটিতে। এর ফলে ‘ইম্প্যাক্ট ভেপোরাইজেশন’ নামে একটা ঘটনা ঘটে। এই আছড়ে পড়ার ফলে সংঘর্ষাঞ্চলের চারপাশে মাটি ছিটকে উঠে যায় নানা দিকে।
এ সময় বাষ্পীভূত প্রচুর পদার্থ হয় চাঁদের মহাকর্ষ ছিন্ন করে বেরিয়ে যায় মহাকাশে, আর নাহয় ঝুলে থাকে বহিঃআবরণী অঞ্চলে—এভাবে ধীরে ধীরে চাঁদের বায়ুমণ্ডল গড়ে ওঠে। কালের আবর্তে ক্ষয়ে গেলেও একই পদ্ধতিতে বারে বারে সেরে উঠেছে চাঁদের বিক্ষত বায়ুমণ্ডল।
যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির সহযোগী অধ্যাপক এবং এই গবেষণা দলের প্রধান নিকোল নিই এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা দেখিয়েছি, এভাবে বারবার সেরে ওঠার ফলেই চাঁদের চারপাশে এই পাতলা বায়ুমণ্ডলটি টিকে রয়েছে এতদিন।’
চাঁদের এই বিক্ষত হওয়ার ইতিহাস এর মাটিতে স্পষ্ট। চাঁদের বুকে রয়েছে প্রচুর খানাখন্দ—গর্ত। আসলে, এর জন্মকালের শুরু থেকেই, অর্থাৎ প্রায় ৪৫০ কোটি বছর আগের সেই সময় শিশু সৌরজগৎ ছিল নরকসম এক অঞ্চল। বারবার বড় বড়, ভারী ভারী পাথর সৌরজগতের বিভিন্ন গ্রহ-উপগ্রহের বুকে আছড়ে পড়েছে।
এভাবেই চাঁদের বুকে সৃষ্টি হয়েছে এসব গর্ত। ধীরে ধীরে এই মহাজাগতিক হামলার পরিমাণ কমে এসেছে, স্থিতিশীল হয়েছে সৌরজগৎ। ফলে কালের আবর্তে ভারী পাথরের আঘাত কমে গেছে বটে, তবে ছোট ছোট পাথর, যেগুলোকে বলা হয় মাইক্রোমিটিওর—ধুলিকণার চেয়েও ছোট—ঠিকই নিয়মিত হারে হামলে পড়েছে চাঁদের মাটিতে। ফলে ইম্প্যাক্ট ভেপোরাইজেশন ঘটার সুযোগ অক্ষুণ্ণ রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় স্থিতিশীল ও টেকসই পাতলা বায়ুমণ্ডল আজও রয়েছে চাঁদের চারপাশে।
মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার লুনার অ্যাটমোস্ফিয়ার অ্যান্ড ডাস্ট এনভায়রনমেন্ট এক্সপ্লোরার (লাডি, LADEE) যখন চাঁদের এই পাতলা বায়ুমণ্ডল ও মাটির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে; চাঁদের পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর চন্দ্রবালুর প্রভাব পর্যবেক্ষণ করে, তখন বিজ্ঞানীরা প্রথম চাঁদের বায়ুমণ্ডল গড়ে ওঠার পেছনে এই পাথুরে হামলার ভূমিকার কথা জানতে পারেন।
ফলে চাঁদের এই বাইরের আবরণী গড়ে ওঠার দুটো পদ্ধতির দিকে মনযোগ দেন তাঁরা। এক, ইম্প্যাক্ট ভেপোরাইজেশন, যার কথা আগেই বলেছি। আর দুই, আয়ন স্পাটারিং। এ পদ্ধতিতে উচ্চ শক্তির আয়নিত কণারা সূর্য থেকে ছুটে আসে, হামলা করে চন্দ্রপৃষ্ঠে। এই কণাদের বলা হয় সোলার উইন্ড বা সৌরবায়ু। এগুলোর হামলার ফলে এদের থেকে শক্তি স্থানান্তরিত হয় চন্দ্রপৃষ্ঠের পরমাণুগুলোতে। পাশাপাশি এদের হামলায় এসব পরমাণু ছিটকে চলে আসে বায়ুমণ্ডলে বা বেরিয়ে যায় মহাকাশে।
লাডির তথ্য থেকে দেখা যায়, দুটো পদ্ধতিই এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু মূল ভূমিকা কোনটির, তা জানা যায়নি। এ জন্য বিজ্ঞানীরা সাহায্য নিলেন নাসার অ্যাপোলো অভিযানে সংগৃহীত চাঁদের মাটির নমুনার। ১৯৬৯ সালে অ্যাপোলো ১১ থেকে শুরু করে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত ৬টি অ্যাপোলো মিশনে ১২ জন নভোচারী নেমেছেন চাঁদের বুকে। তাঁরাই ফেরার সময় নিয়ে এসেছেন এসব নমুনা।
বিজ্ঞানীরা এ নমুনা থেকে পটাশিয়াম ও রুবিডিয়াম আলাদা করে নিলেন। এগুলো সহজে বাষ্পীভূত হয়, ইংরেজিতে যাকে বলে ভোলাটাইল। এগুলোর দুধরনের আইসোটোপ আছে—হালকা ও ভারী। আইসোটোপ মানে একই মৌলের ভিন্ন রূপ—অর্থাৎ নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সংখ্যা সমান, তবে নিউট্রনের সংখ্যা কম-বেশি। কম সংখ্যক নিউট্রনবিশিষ্ট আইসোটোপ হালকা হয়, আর বেশি নিউট্রন থাকলে হয় ভারী।
গবেষক দল অনুমান করল, ভারী আইসোটোপের পরিমাণ চাঁদের বায়ুমণ্ডল ও মাটিতে বেশি থাকার অর্থ, মূল ভূমিকা রেখেছে ইম্প্যাক্ট ভেপোরাইজেশন। কারণ কী? সেটা জানা যায় নিকোল নিইর ভাষ্যে। ‘ইম্প্যাক্ট ভেপোরাইজেশন পদ্ধতিতে বেশির ভাগ পরমাণু চাঁদের বায়ুমণ্ডলে থেকে যাওয়ার কথা, আর আয়ন স্পাটারিং পদ্ধতিতে বেশির ভাগের চাঁদ ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা মহাকাশে।’
দেখা গেল, পটাশিয়াম ও রুবিডিয়ামের বেশির ভাগ ভারী আইসোটোপ রয়ে গেছে চাঁদের মাটিতে। এভাবে বোঝা গেল, ইম্প্যাক্ট ভেপোরাইজেশন পদ্ধতি চাঁদে বায়ুমণ্ডল গড়ে ওঠার পেছনে প্রায় ৭০% ভূমিকা রেখেছে। আর আয়ন স্পাটারিং পদ্ধতিতে গড়ে উঠেছে প্রায় ৩০%-এর মতো বায়ুমণ্ডল।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।