এ কে এম খাদেমুল হক: প্রায় ষোল কোটি মানুষের দেশে সচিব থেকে শুরু করে অফিস সহকারী পর্যন্ত সব মিলিয়ে সরকারি চাকরির সংখ্যা মাত্র ৩২ লাখ৷ মানে প্রতি পঞ্চাশ জনে একজনের সুযোগ আছে জনগণের টাকায় বেতন পাওয়ার৷ তবু বাংলাদেশে সরকারি চাকরি পেতে সবাই মরিয়া৷
কারণ, বেসরকারি খাতের প্রকৃত বিকাশ না ঘটা৷ বেসরকারি খাতের চাকরির একদিকে কোনো নিশ্চয়তা নেই, অন্য দিকে আবার আছে পরিশ্রমের তুলনায় পারিশ্রমিকের পরিমাণ নিয়ে অতৃপ্তি৷ সরকারি চাকরিতেও যে বেতনের হারটা খুব সন্তোষজনক, তা হয়ত নয়; কিন্তু চাকরির নিশ্চয়তা আর সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার কারণে সরকারি চাকরি ইদানিং হয়ে উঠেছে প্রায় সোনার হরিণ৷ কিন্তু এই চাকরি পাবেন কারা? আবেদনের যোগ্যতা হবে কী?
বিদ্যমান যে বিধির আলোকে বাংলাদেশে সরকারি চাকরি নিয়ন্ত্রিত হয়, সেটি মূলত ব্রিটিশ আমলের বিধি৷ তাতে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের জন্য বয়স ও শিক্ষাগত যোগ্যতার ক্ষেত্রে কিছু পূর্ব শর্ত আছে৷ এ দুটি শর্ত আসলে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত৷ প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করতে কত সময় লাগতে পারে, সেটি বিবেচনায় রেখে নির্ধারণ করতে হয় সরকারি চাকরিতে নিয়োগের সম্ভাব্য ন্যুনতম এবং সর্বোচ্চ বয়স৷ আরো একটি বিষয় এখানে বিবেচ্য, সেটা হলো মানুষের কর্মক্ষমতা ও জীবনীশক্তির সুবিধা কাজে লাগানো৷ ব্রিটিশ আমলে যখন এ বিধিমালা প্রণীত হয়েছিল, তখন এই অঞ্চলের মানুষের গড় আয়ু ছিল পঞ্চাশ বছরের নিচে৷ তখন সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ছিল ২৭ বছর৷
কিন্তু চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির পরিপ্রেক্ষিতে এ অঞ্চলের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এ আইনটি পুনর্বিবেচনা করা হয়৷ ১৯৮০’র দশকের শেষ দিকে যখন সর্বশেষবার এ উদ্যোগ নেয়া হয়, ততদিনে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে হয়েছিল ৫৫ বছর৷ তবে সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৭২ বছর৷ তাই মানুষের কর্মক্ষম থাকার বয়সটাও নতুন করে পুনর্নিধারণের সুযোগ তৈরি হয়েছে৷ তাই দাবি উঠেছে, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর৷ যারা এ দাবি তুলছেন, তারা বিশ্ব জুড়ে অন্যান্য দেশের উদাহরণ দিচ্ছেন৷
সবচেয়ে মোক্ষম উদাহরণ আমাদের পাশের দেশ ভারত; সেখানে বিভিন্ন পদের জন্য আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ বছর থেকে শুরু করে ৪৫ বছর পর্যন্ত৷ উন্নত বিশ্বের কোনো দেশে তো এই সীমা কার্যত তুলেই দেয়া হয়েছে৷ কোভিড-১৯ অতিমারিতে গত প্রায় দেড় বছর ধরে সারা বিশ্বের কার্যত থমকে থাকা তাদের এই দাবিকে আরো জোরালো করেছে, জীবন থেকে ঝরে যাওয়া এই দুটি বছরকে অন্তত সমন্বয় করার যুক্তি উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই৷
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই যুক্তি আসলে অকাট্য৷ কেননা এই দেড় বছরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি তো হয়েছে শিক্ষাক্ষেত্রেই৷ দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে, বন্ধ রয়েছে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের জন্য নিয়োগের প্রক্রিয়াও৷ এই সময়ের মধ্যে বিপুলসংখ্যক চাকরিপ্রার্থীর আবেদনের বয়স পেরিয়ে গেছে৷ তাদের ক্ষতিটুকু পুষিয়ে নেয়ার একটি উদ্যোগ সরকার নিয়েছিল গত বছরের নভেম্বর মাসে, পাঁচ মাস শিথিল করা হয়েছিল বয়সসীমা৷ কিন্তু সেটা তো সাময়িক৷
প্রকৃতপক্ষে সাময়িক নয়, বর্তমান বাস্তবতায় এই বিষয়ে স্থায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ তৈরি হয়েছে৷ বর্তমানে বাংলাদেশে প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ন্যূনতম যোগ্যতা অনার্সসহ ব্যাচেলর্স ডিগ্রি৷ সাধারণ হিসেব অনুসারে এই ডিগ্রি পেতে সময় লাগার কথা ২৩ বছর৷ ৬ বছর বয়সে শিক্ষা জীবন শুরু, তারপর স্কুলের দশ, উচ্চ মাধ্যমিকের দুই আর গ্র্যাজুয়েশনের চার এই ষোল বছরের শিক্ষা৷ কিন্তু স্কুলের ১০ বছর শেষে এসএসসি পরীক্ষা গ্রহণ এবং কলেজে ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করতে কেটে যায় আরো ৬ মাস এবং এইচএসসি পরীক্ষা শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আরো ৬ মাস৷ তাই কোনো সেশন জট ছাড়া এই পর্যায়ের শিক্ষা গ্রহণ শেষ করা সম্ভব ২৩ বছর বয়সে, তারপর চাকরি যুদ্ধের জন্য বর্তমান নিয়ম অনুসারে সময় পাওয়া যায় ৭ বছর৷ কিন্তু বাস্তবতা হলো, নানা কারণে শিক্ষা গ্রহণের প্রক্রিয়াটা শেষ করতে সময় লেগে যায় আরো বেশি৷ সবচেয়ে বড় কথা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভেদে এই সময়সীমা এক রকম নয়৷ তাই আবেদনের জন্য কেউ বেশি সময় পান, কেউ কম৷ আবার যখন সরকারি চাকরিতে আবেদনের যোগ্যতা অর্জিত হয়, তখন হয়ত দেখা যায় যে, শূন্য পদ পুরণের জন্য বিজ্ঞাপন হচ্ছে না৷
সবচেয়ে কাঙ্খিত চাকরির পরীক্ষা, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস বা বিসিএস পরীক্ষার কথাই ধরা যাক- এই পরীক্ষার জন্য কিন্তু প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ে বিজ্ঞাপন হয় না৷ এর একটি বড় কারণ, সময়মতো পরীক্ষা শেষ করতে না পারা৷ বিপুলসংখ্যক পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা নিতে হয়, এবং সে পরীক্ষার কয়েকটি ধাপ রয়েছে বলে একেকটি বিসিএস শেষ করতে কার্যত কয়েক বছর সময় লেগে যায়৷ বর্তমানে যেমন একসঙ্গে চারটি বিসিএস পরীক্ষার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে৷ বিভিন্ন সরকারি দফতরের ছোটখাটো পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে তো অবস্থা আরো জটিল৷ সেখানে এরকম কোনো নিয়মিত পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই বলে দেখা যায় বছরের পর বছর পদ খালি থাকলেও নিয়োগের উদ্যোগ নেয়া হয় কয়েক বছর পর একবার৷ তাই বাস্তবে বহু আকাঙ্খিত সরকারি চাকরিতে আবেদনের জন্য শিক্ষাজীবন শেষে খুব কম সময়ই হাতে পাওয়া যায়৷
তবে মনে রাখা দরকার, আবেদনের সর্বোচ্চ বয়সসীমা বাড়ানো হলে কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেড়ে যাবে৷ কারণ, তখন একেকজন আবেদনকারী বেশিসংখ্যক বিজ্ঞাপনের বিপরীতে আবেদন করার সুযোগ পাবে৷ তবে সেটাকে ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করার সুযোগ রয়েছে৷ কারণ, বয়স বাড়ানো হলেই তো আর সবাই শুধু সরকারি চাকরির আশায় আবেদন করে যাবেন না; তাদের মধ্যে অনেকে যোগ্যতা অনুসারে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেয়ে যাবেন৷ অনেকেই সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে সরকারি চাকরিতে যোগ দেয়ার সুযোগ পাবেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সেই অভিজ্ঞতার সুফল পাবে৷ ৩৫ বছর বয়সে চাকরিতে প্রবেশ করলেও কিন্তু ২৫ বছর চাকরিশেষে ৬০ বছরে অবসর নেয়ার সুযোগ থাকছে; অর্থাৎ একজন শিক্ষিত কর্মীর কাছ থেকে তার ক্যারিয়ারের সেরা কর্মক্ষম সময়টুকু পাওয়ার সুযোগ থাকছে সরকারের৷ সেটা বিবেচনায় রেখে যদি চাকরিপ্রার্থীদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রটিতে কিছুটা হলেও বৈষম্য কমানো যায়, মন্দ কী?
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।