জুমবাংলা ডেস্ক : বৃহস্পতিবার রাত ১০টা ২২ মিনিট। স্বাভাবিকভাবেই চলছিল খিলগাঁও শাহজাহানপুর ফ্লাইওভারের নিচের দুই পাশের জনজীবন। রেললাইনে কোনো সিগন্যাল না থাকায় যানবাহনের তেমন একটা চাপও ছিল না ফ্লাইওভারের নিচে। রাজারবাগ থেকে খিলগাঁও রেললাইনের দিকে নান্না বিরিয়ানির সামনে দিয়ে যাচ্ছিল একটি সাদা রঙের মাইক্রোবাস। আর তাকে তাড়া করছিল হেলমেট পরিহিত অস্ত্র হাতে এক আগন্তুক। ১৩ থেকে ১৭ সেকেন্ড। মাইক্রোবাসের ভিতরে থাকা ব্যক্তিকে টার্গেট করে গুলি। চলমান গতিতে হঠাৎ ছন্দপতন। গুলির বিকট শব্দে আঁতকে উঠে আশপাশের মানুষ। মাত্র চার সেকেন্ডেই কিলিং মিশন শেষ করে ফ্লাইওভারের ডিভাইডার টপকে দৌড়ে পালায় আততায়ী। গাড়ি থেকে দুই ব্যক্তি বেরিয়ে এসে জানান গুলিবিদ্ধ মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপু। খুঁজতে থাকেন সেই আততায়ীকে। একই সঙ্গে মাইক্রোবাসের ঠিক সামনে থাকা একটি রিকশার যাত্রী প্রীতির গায়েও গুলি লাগে। গুলিবিদ্ধ দুজনকেই গুরুতর অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন। এ প্রতিবেদকের হাতে আসা কিলিং মিশনের সিসিটিভি ফুটেজ থেকেই দেখা গেছে এসব দৃশ্য। তবে নির্মম এই হত্যাকান্ড নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্ন। টিপুর সঙ্গে গাড়িতে থাকা তার বন্ধু মিরাজ, দেহরক্ষী আবুল কালাম আজাদের গায়ে একটি গুলিও লাগেনি। তবে পথচারী সামিয়া আফরিন প্রীতিকে গুলি করল কে? টিপুর মুভমেন্ট সম্পর্কে কারা অবগত করছিল আততায়ীকে? কেনইবা এই নারকীয় হত্যাকান্ড। কারা এর নির্দেশদাতা? তবে গতকাল দুপুরেই র্যাব এবং ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ অন্তত চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের হেফাজতে নিয়ে গেছে। এদের মধ্যে ফারুক এবং সাগরের নাম জানা গেছে। যদিও কাউকে আটকের বিষয় স্বীকার করেনি র্যাব কিংবা ডিবি। গতকাল সন্ধ্যায় ধানমন্ডির নিজ বাসায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, জাহিদুল ইসলাম টিপু ও কলেজছাত্রী সামিয়া আফরান প্রীতির হত্যাকান্ডে জড়িত কেউই রেহাই পাবে না। খুনিদের দ্রুত গ্রেফতার করা হবে। এ ঘটনা নিয়ে যারা কলকাঠি নাড়ার চেষ্টা করবেন, তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। পরিস্থিতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। খুনি যেই হোক, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, আওয়ামী লীগ নেতা টিপু ও বদরুন্নেছা কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রী প্রীতি হত্যাকান্ডের তদন্তে বেশ কিছু ক্লু পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। থানা পুলিশের পাশাপাশি মামলার ছায়া তদন্ত করছে র্যাব, পিবিআই ও ডিবির একাধিক টিম। হেলমেট পরিহিত খুনি শনাক্ত এবং তার পৃষ্ঠপোষকদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে মাঠে নেমেছেন তারা। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধারকৃত ১২টি গুলির খোসার সূত্র ধরে মামলায় ফরেনসিক সহায়তা দিচ্ছে সিআইডি। গতকাল সরেজমিন মতিঝিল, শাহজাহানপুর ও খিলগাঁও এলাকার স্থানীয় অনেকের সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। প তারা বলেছেন, ছয়টি মোটিভ ধরে টিপু খুনের রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা চলছে। মতিঝিল, পল্টন ও শাহজাহানপুরে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের ঠিকাদারিতে বাটোয়ারা, মতিঝিল আইডিয়াল কলেজের ভর্তি বাণিজ্য, মুক্তিযোদ্ধা মার্কেট নিয়ে দ্বন্দ্ব, সাবেক কাউন্সিলর ‘রিয়াজ মিল্কী’ হত্যাকান্ডের রেশ এবং ‘বোচা বাবু’ খুনের মামলার আপস রফা নিয়ে দুই শুটারের সঙ্গে টিপুর টানাপোড়েন নিয়েও কাজ করছেন তারা। খিলগাঁও রেলগেট সংলগ্ন রেলওয়ে মার্কেট এলাকায় মানামা এফআর হাইটস ভবনের সামনে ফ্লাইওভারের নিচে এ ঘটনা ঘটে। ভবনটির নিরাপত্তাকর্মী মো. লিটন জানান, রাত ১০টার পর বেশ কয়েকটি গুলির শব্দ শুনে বাইরে বেরিয়ে আসেন। তখন লোকজনের ছোটাছুটি দেখতে পান। একটি সাদা মাইক্রোতে রক্তাক্ত লাশ ও রক্তাক্ত এক মেয়েকে সড়কের পাশে নেওয়া হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে লিটন আরও বলেন, রেলক্রসিং থাকায় বিপরীত পাশের সড়কটি ফাঁকা ছিল। ঘাতক গুলি করার পর ওই সড়কে আগেই দাঁড়িয়ে থাকা মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায়।
তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, খুনিদের টার্গেটে ছিলেন শুধু টিপু। রিকশাযাত্রী প্রীতি ঘটনার শিকার। মোটরসাইকেল আরোহী কিলার ছাড়াও ঘটনাস্থলের আশপাশে মোটরসাইকেল যোগে আরও দুজন ব্যাকআপে ছিলেন। টিপুর ঘনিষ্ঠজনের কেউ খুনিদের তাদের গতিবিধি সম্পর্কে অবহিত করেছিল। একই সঙ্গে সম্প্রতি অজ্ঞাত নম্বর থেকে টিপুকে হত্যার হুমকি দেওয়া লোককে খুঁজছে পুলিশ।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র জানায়, মতিঝিলের এজিবি কলোনিতে রিজভী হাসান বাবু ওরফে বোচা বাবু হত্যা মামলা নিয়ে আসামিদের সঙ্গে আপস না করার কারণে স্থানীয় রাজনীতিবিদদের একটি অংশের সঙ্গে টিপুর চরম বিরোধ তৈরি হয়েছিল সম্প্রতি। তবে আসামিদের মধ্যে সাগরের সঙ্গে আবুল কালামের মীমাংসা হয় টিপুর মধ্যস্থতায়। অন্য আসামি শুটার নেসার, মতিঝিল এলাকার সবচেয়ে দক্ষ শুটার হিসেবে পরিচিত সাব শুটার মুসা ও তার ভাই সালেহ মীমাংসার জন্য টিপুর দ্বারস্থ হন। তারা ইউরোপ প্রবাসী সহোদর শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশ-প্রকাশের ক্যাডার হিসেবে এলাকায় পরিচিত। যুবলীগ কর্মী বোচা বাবুর বাবা আবুল কালাম আজাদ নিহত টিপুর ঘনিষ্ঠ সহচর। সব সময় টিপুর সঙ্গেই থাকতেন। বোচা বাবু হত্যা মামলার সব খরচ বহন করতেন টিপুই। ঘটনার সময় গাড়ির পেছনে যে দুজন বসা ছিলেন, তাদের একজন এই আবুল কালাম। সম্প্রতি জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে ১৭৮ কোটি টাকার কাজের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। টিপু ঠিকাদার সমিতির সভাপতি হওয়ার কারণে তার হাত ধরেই অন্যরা ঠিকাদারি কাজ পেতেন। কেউ কাজ না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে টিপুকে হত্যা করিয়ে থাকতে পারেন বলে আশঙ্কা তদন্তসংশ্লিষ্টদের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্তসংশ্লিষ্টদের একজন বলেছেন, হেলমেট পরিহিত সেই খুনি মগবাজার এলাকার সজীব বলে তারা জানতে পেরেছেন। তবে তারা পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারেননি। শাহজাহানপুর এলাকার কারাবন্দি এক শীর্ষ সন্ত্রাসীর নির্দেশে অতীতে সজীব বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নিয়েছেন। নিহত টিপুর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু জানিয়েছেন, এক সপ্তাহ আগেই হুমকির কথা টিপুর মুখে শুনেছেন। এর সত্যতা জানতে টিপুর ফোন দরকার। অথচ ঘটনার পর থেকে টিপুর ফোন পাওয়া যাচ্ছে না। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে টিপুর স্ত্রী কাউন্সিলর ডলিকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে বলে জানা গেছে। পাশাপাশি সম্প্রতি কারও সঙ্গে টিপুর বাদানুবাদ হয়েছে কি না, কোনো সালিশ মীমাংসা নিয়ে কারও সঙ্গে ঝামেলা ছিল কি না, সেটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
নিহত টিপুর গাড়ি চালক মুন্না এ প্রতিবেদককে বলেন, খিলগাঁও রেলগেট এলাকায় গেলে রিকশার প্রতি বেশি মনোযোগ রেখে গাড়ি চালাতে হয়। ঘটনার আগে তিনি রিকশার প্রতি খেয়াল রাখছিলেন যাতে গাড়ির সঙ্গে লেগে না যায়। এ সময় হেলমেট পরা এক যুবক গাড়ির কাছে এসে জানালা দিয়ে টিপুকে উদ্দেশ্য করে গুলি করতে থাকে। একটি গুলি তার হাতে ও পিঠের কাছে বিদ্ধ হওয়ার পর প্রায় অচেতন হয়ে পড়েন। একটানা ৮-১০টি গুলি করে ঘাতক পালিয়ে যায়। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছি বলে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি।
অজ্ঞাতদের বিরুদ্ধে মামলা : রাজধানীর শাহজাহানপুরের আমতলা রেলগেটে দুর্বৃত্তের এলোপাতাড়ি গুলিতে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু ও কলেজছাত্রী সামিয়া আফরান প্রীতি নিহত হওয়ার ঘটনায় হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। গতকাল সকালে শাহজাহানপুর থানায় নিহতের স্ত্রী ফারহানা ইসলাম ডলি বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, জাহিদুল ইসলাম টিপু ১০ বছর যাবৎ বৃহত্তর মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক থাকাকালীন দলীয়ভাবে কোন্দল ছিল। গত চার পাঁচ দিন আগে অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতকারী টিপুকে মোবাইল ফোনে হত্যার হুমকি দেয়। অজ্ঞাত দুষ্কৃতকারীরা পূর্ব শত্রুতার জের ধরে টিপুকে এলোপাতাড়ি গুলি করে হত্যা করেছে। এ সময় প্রীতি নামে এক পথচারীও নিহত হন। আহত হন টিপুর চালক মুন্না। এদিকে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, সিসিটিভি ফুটেজ দেখে শুটারকে শনাক্তের চেষ্টা চলছে। আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। এ ঘটনায় বেশ কিছু তথ্য ও আলামত র্যাবের হাতে এসেছে।
টিপুর শরীরে মিলল ৭ গুলি : গুলিতে নিহত আওয়ামী লীগ নেতা টিপু ও সামিয়া আফরান প্রীতির মৃতদেহের ময়নাতদন্ত শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে ঢামেক ফরেনসিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. জান্নাতুন নাঈম ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেন। মর্গ সূত্রে জানা গেছে, প্রীতির শরীরে গুলি একদিক দিয়ে ঢুকে অন্যদিক দিয়ে বেরিয়ে গেছে। আর টিপুর শরীর থেকে সাতটি গুলি রিকভারি করা হয়েছে। নিহত প্রীতির শরীরে একটি গুলির চিহ্ন রয়েছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।