ড. সুলতান মাহমুদ রানা : গত ৩ মে কালের কণ্ঠে প্রকাশিত শীর্ষ প্রতিবেদনে ‘কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ বিএমডিসি’ শিরোনামে ভুল চিকিৎসা, ভুয়া চিকিৎসক, রোগীর প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ না দেওয়া, সঠিক সময়ে সঠিক ব্যবস্থা না নেওয়া, রোগীর কাছ থেকে অনৈতিক অর্থ আদায়, বেসরকারি হাসপাতালে খরচের বাড়াবাড়ি, নকল ওষুধ—এমন অনেক অভিযোগের বিষয়ে বিস্তর তুলে ধরা হয়।
প্রতিবেদনে উল্লিখিত তথ্যগুলো দেখলে যে কেউই চমকে উঠবে। প্রতিনিয়ত বাংলাদেশ মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) কাছে অসংখ্য অভিযোগ জমা হলেও বাস্তবে সেগুলো যথাযথভাবে নিষ্পত্তি হয় না। অবশ্য বিএমডিসির ব্যাখ্যা, ভুক্তভোগীর ব্যাখ্যা এবং বাস্তবতা মিলিয়ে বিষয়টি গভীর অনুধাবনের প্রয়োজন রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে গত ৪ মে একই পত্রিকায় ‘তদন্তে গতি আনতে হবে’ শিরোনামের সম্পাদকীয়তে চিকিৎসাব্যবস্থায় আস্থা ফেরাতে করণীয় উল্লেখ করা হয়।
এ কথা সত্য যে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা আগের তুলনায় অনেক এগিয়ে। এর পরও বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা আমাদের ব্যথিত করে। এসব অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার ফলে সাধারণ মানুষ আমাদের দেশের হাসপাতাল ও চিকিৎসাসেবার প্রতি ক্রমেই আস্থা হারাচ্ছে।
অথচ দেশের উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চিকিৎসা খাতে যে উন্নয়ন হয়েছে এবং হচ্ছে, তাতে সাধারণ মানুষের আস্থার মাত্রা ক্রমেই বেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ঘটছে এর উল্টো। সাম্প্রতিক সময়ে অনেকেই চিকিৎসার জন্য পাশের দেশ ভারতে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশনে ভিসার আবেদন করলে সিরিয়াল পেতেই হিমশিম খেতে হয়।
কারণ আবেদনকারীর সংখ্যা অনেক বেশি। অথচ বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসক এবং হাসপাতাল রয়েছে। অনেক সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ ভারতের চেয়েও এগিয়ে। তাহলে বাংলাদেশের চিকিৎসার প্রতি আস্থা না রেখে ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার পেছনের যুক্তিটি কী? এই প্রশ্নের উত্তরে এক কথায় বলা যায় যে আমাদের দেশের চিকিৎসার প্রতি মানুষের আস্থার সংকট, আর ভারতের চিকিৎসায় আস্থা সৃষ্টি। আন্তর্জাতিক মানের ভালো চিকিৎসক থাকলেও নানা কারণে রোগীরা বাংলাদেশের চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। আর এই আস্থা হারানোর পেছনের কারণ হিসেবে হাজার হাজার উদাহরণ দেওয়া সম্ভব।
মূলত এক শ্রেণির ডাক্তারের অনৈতিক মুনাফাবাজি, বাণিজ্যিক ও অপেশাদার মনোভাবের কারণে দেশের পুরো স্বাস্থ্য খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবার সুযোগ বৃদ্ধি পেলেও কিছু নৈতিকতাহীন চিকিৎসকের নেতিবাচক ভূমিকায় সাধারণদের আস্থার সংকট প্রকট হচ্ছে। অনেক সময় আমরা শুনে থাকি, বড় বড় সরকারি হাসপাতালে রোগী ভর্তি হতেও নাকি জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়। এমনও তথ্য আছে আমার কাছে, গ্রাম থেকে আসা গুরুতর অসুস্থ রোগীকে জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক হাসপাতালে ভর্তি না করে পরদিন সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলে থাকেন। এমন অবস্থা থেকে কারো অনুমান করতে ভুল হবে না যে ক্লিনিক ব্যবসার সঙ্গে ওই সব ডাক্তার প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। একজন রোগী অতিমাত্রায় অসুস্থ না হলে শখ করে নিশ্চয়ই হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কথা নয়।
মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম হলো চিকিৎসা। কিন্তু এই মৌলিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে অনেক প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। এমনকি চিকিৎসকদেরও হয়রানি করা হয়। অনেক মানবিক চিকিৎসক হয়রানির শিকারও হন, যেটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে কিছু অনৈতিক চিকিৎসকের কারণে গোটা চিকিৎসাব্যবস্থা দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছেন চিকিৎসাব্যবস্থাকে আস্থায় ফেরাতে। সাধারণ মানুষ যাতে আস্থা পায়, এ জন্য তিনি নিজে প্রায়ই সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যান। সর্বশেষ গত ৩ মে রাজধানীর আগারগাঁও চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে ১০ টাকায় টিকিট কেটে তিনি নিজে চিকিৎসা নেন। এমন উদাহরণ আমরা প্রায়ই দেখি।
বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রীও একজন নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক। তিনি চিকিৎসাব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের যাতে আস্থা তৈরি হয়, সে জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। গত ২৮ এপ্রিল ৪১তম বিসিএস (স্বাস্থ্য) ও বিসিএস (পরিবার পরিকল্পনা) ক্যাডারের নব-নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ওরিয়েন্টেশন অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমি যেমন চিকিৎসকের মন্ত্রী, ঠিক তেমনি রোগীদেরও মন্ত্রী। চিকিৎসকের ওপর কোনো আক্রমণ হলে যেমন সহ্য করব না, আবার রোগীর প্রতি চিকিৎসকের কোনো অবহেলা হলেও বরদাশত করব না।’
তিনি উল্লেখ করেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখতেন তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার। আমি মনে করি সেই স্বপ্ন পূরণ করার কারিগর হচ্ছ তোমরা। যারা আজকে চিকিৎসক হিসেবে যোগদান করতে যাচ্ছ। আমার বিশ্বাস, তোমরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নপূরণে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবে।’
সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ভালো সেবা পাওয়ার তথ্য রয়েছে অনেক। আবার চিকিৎসাসেবার বাণিজ্যিকীকরণ নিয়েও অনেক তথ্য গণমাধ্যম সূত্রে আমরা জানতে পারি। এর বিপরীতে চিকিৎসাসেবার বাণিজ্যিকীকরণের মাত্রা এতটাই বেড়েছে যে হাসপাতালের বহির্বিভাগে রোগী দেখা থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখা, রোগ নির্ণয় বা ডায়াগনসিস, ব্লাড ব্যাংক এবং সিসিইউ, আইসিইউর নামে চলছে অনৈতিক বাণিজ্য। হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা খাতের এসব অনিয়ম-দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা ও অনৈতিক কাজ নিয়ে গণমাধ্যমে লেখালেখি ও টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও অবস্থার তেমন পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পর সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েই দায়িত্ব শেষ করছে।
একদিকে বড় বড় সরকারি হাসপাতালের পেছনে সরকার বছরে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করছে, অন্যদিকে রোগ নির্ণয় এবং সার্জিক্যাল অপারেশনের জন্য নামসর্বস্ব, মানহীন ডায়াগনস্টিক সেন্টার, প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকের দালালরা সরল সাধারণ রোগীদের সেখানে যেতে বাধ্য করছে। মোটা অঙ্কের মাসোহারা বা কমিশন বাণিজ্যের লোভে এক শ্রেণির চিকিৎসকও এই চক্রের সঙ্গে জড়িত আছেন বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে। টিআইবির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলিতে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তাদের ১০ হাজার টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। রোগীদের রোগ নির্ণয়ে সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার ও দালালদের কমিশন ভাগাভাগির তথ্যও উঠে এসেছে টিআইবির প্রতিবেদনে।
স্বাস্থ্যসেবা খাতের মতো একটি জরুরি ও জনগুরুত্বপূর্ণ সেক্টরের প্রতিটি স্তরে এমন দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনা পুরো জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। চিকিৎসকদের মানুষ সেবাদানকারী হিসেবে দেখতে চায়, চিকিৎসা কোনো বাণিজ্য নয়, এটি একটি সেবাদান প্রক্রিয়া। চিকিৎসার সঙ্গে বাণিজ্য শব্দটি মানানসই নয়। কাজেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে নিয়োজিত প্রত্যেক চিকিৎসককে নিজস্ব সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ থেকে সেবা প্রদানে অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া উচিত।
লেখক : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ,
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
গরমে গ্লুকোজ পানি পান করা কি ভালো না ক্ষতি, কী বলছেন চিকিৎসক
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।