রঞ্জু খন্দকার, গাইবান্ধা থেকে: মাটির সরু পথ এঁকেবেঁকে চলে গেছে গ্রামান্তরে। কোথায়, কোন দূরে গিয়ে সে মেঠোপথ ঠেকেছে, পথিকও জানেন না। পথের বাঁকে কোথাও বট-পাকুড়ের ছায়া। অদূরে গরু রেখে সেখানে আড্ডায় মেতেছে রাখাল বালক।
মেঠো সে পথের দুধারে তাল-তমাল-হিজলের সারি। সারি ভেদ করে বাইরে দৃষ্টি দিলে অবারিত সবুজের প্রান্তর। কখনো সে প্রান্তর ফসলভরা, কখনোবা রিক্ত, নিঃস্ব–ফসলহারা। ফাঁকা সে ফসলিমাঠ থেকে গোধূলি বেলায় গরু চড়িয়ে সেই পথ ধরে ঘরে ফিরছে রাখাল। অথবা ভোর-সকালের দূর্বা দলে একই পথে লাঙল কাঁধে মাঠে যাচ্ছেন কৃষক।
এমনটা ভাবা এখন কষ্ট-কল্পনা হলেও সদ্য সাবেক হয়ে যাওয়া নব্বইয়ের দশকেও এই-ই ছিল গ্রামবাংলার চিরপরিচিত দৃশ্য। যাদের বয়স এখনো কেবল ত্রিশ, হয়ত তারাও বালকবেলায় নিজেই দেখেছেন এমনটা, অথবা নিজেই ছিলেন এমন দৃশ্যের চরিত্রে। কিন্তু উন্নয়নের জোয়ারে হঠাৎ কোথায় হারিয়ে গেল এসব? এমন মেঠোপথই বা হারিয়ে গেল কোন বাঁকে?
গত শুক্রবার শহুরে পিচঢালা রাস্তা ধরে যাওয়ার সময় পিচছাড়া এক মেঠোপথ দেখে এমন নস্টালজিক হয়ে পড়েন এ প্রতিবেদক। এরপর সে পথে মোটরসাইকেল চালিয়ে দেন প্রতিবেদক ও তাঁর দুই সঙ্গী।
তখন বিকেলের কনে-দেখা আলো ফিকে হয়ে এসেছে। গরুর পাল খুর দিয়ে মেঠোপথের ধূলা উড়িয়ে ফিরছে গোয়ালে। সেগুলোকে ‘হু-হট-হট’ খেদিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন একদল কিষান-কিষানি। তাদের কারও হাতে গরুশাসনের লাঠি, কারও মাথায় রান্নার জন্য সংগ্রহ করা লাকড়ি।
পথের দুধারে খেজুরবৃক্ষের সারি। যেন পথিককে বরণের জন্য ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয়েছে সেগুলো। সে সারি পেরিয়ে দুপাশে তাকালে চোখ চলে যায় ধনধান্যে ভরা মাঠে। ধানগাছ যেন তার সর্বাঙ্গে সবুজের শাড়ি পরে সেজেছে!
প্রতিবেদকের সঙ্গী দুজনের ভাষ্য, এমন মেঠোপথ আগে হামেশাই গ্রামেগঞ্জে দেখা যেত। কিন্তু বর্তমানে উন্নয়নের জোয়ারে এরকম রাস্তার দেখা পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ছে। আগে গ্রামে পিচঢালা রাস্তা না থাকায় খুব দুঃখ হতো। নিজেদের উন্নয়ন-বঞ্চিত মনে হতো। অথচ এখন পিচছাড়া এমন গ্রামীণ রাস্তা দেখার জন্য মনটা আঁকুপাঁকু করে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, মেঠোপথটি সাঁওতালপল্লীর ভেতর দিয়ে চলে গেছে। এটি সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্ম এলাকা নামে পরিচিত। ইউনিয়ন সাপমারা। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় এর অবস্থান।
গোবিন্দগঞ্জের কাটা এলাকা থেকে বিরামপুর মহাসড়ক ধরে এগিয়ে গেলে হাতের বাম পাশে পড়বে মেঠোপথটি।
শুক্রবার ওই পথে গরু খেদিয়ে নেওয়া দলটির একজন জানালেন, এই পথ ধরে এগোলে সামনে সাঁওতালপল্লী। সেটি পার হয়ে বড় রাস্তায় মিশেছে এই পথ।
চেহারা মিলিয়ে বোঝা গেল, এই দলটির লোকজনও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের।
মেঠোপথ ধরে সামনে এগিয়ে সারি সারি সাঁওতালবাড়ির দেখা মিলল। বেশির ভাগ বাড়ি মাটির তৈরি, একতলা। কোনোটি দোতলা। সব বাড়ি পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি।
দেখা গেল, বাড়ির সামনে রাস্তার পাশে কোথাও সাঁওতাল বালক-বালিকারা মাচাঙয়ের ওপর বসে আছে। কোথাও সাঁওতালি নারীরা গৃহস্থালি কাজকর্ম করছেন।
কয়েকজন সাঁওতাল নারী-পুরুষের কাছে চায়ের দোকানের খোঁজ করেও পাওয়া গেল না। তাঁরা জানালেন, চা পাওয়া যাবে আরও সামনে, বড় রাস্তায়। বর্ষার কারণে মেঠোরাস্তাটিতে কাঁদা হলেও ‘তেমন’ সমস্যা হবে না।
অবশ্য কর্দমাক্ত স্থানগুলো পার হতে যথেষ্টই বেগ পেতে হয় এ প্রতিবেদক ও তাঁর সঙ্গীদের।
সঙ্গীদের একজন গোবিন্দগঞ্জের মহিমাগঞ্জ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক হেদায়েত উল্লাহ। তিনি বললেন, এমন গ্রামীণ রাস্তা দূর থেকে আকর্ষণীয় হলেও, বর্ষায় এ পথে চলাচল তত সুখকর নয়; সেটা ভালোই বোঝা গেল।
আরেক সঙ্গী ফুলছড়ি উপজেলার হেলেঞ্চা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারুক হোসাইন। তিনি বললেন, দেশে একটি হলেও এমন মেঠোপথ টিকে থাক। সব পথ উন্নয়নের কার্পেটে মোড়ানোর দরকার নেই। পিচছাড়া এমন পথ টিকে থাকুক কিছু মানুষের স্মৃতিজাগানিয়া ভালোবাসা হয়ে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।