আন্তর্জাতিক ডেস্ক: চীনের শিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর সম্প্রদায়ের সদস্যদের মূল আবাসস্থলে প্রতি ২৫ জনের ১ জন ২ থেকে ২৫ বছর মেয়াদে কারাদণ্ড ভোগ করছেন। এটিই বিশ্বের যেকোনো অঞ্চলে সর্বোচ্চ কারাদণ্ড ভোগের হার। খবর এপি’র।
গতকাল সোমবার বার্তা সংস্থা এপি’র এক প্রতিবেদনে ফাঁস হওয়া সরকারি তথ্যের বরাত দিয়ে এ কথা জানানো হয়েছে।
প্রতিবেদন মতে, কারাদণ্ড পাওয়া বেশিরভাগ ব্যক্তির বিরুদ্ধেই জঙ্গিবাদের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে।
শিনজিয়াংয়ের কোনাশেহের অঞ্চলে কারাভোগ করছেন এ রকম ১০ হাজার ব্যক্তির তালিকা এসেছে এপি’র হাতে। তালিকাভুক্ত সবাই উইঘুর বলে নিশ্চিত করতে পেরেছে বার্তা সংস্থাটি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পশ্চিমের গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে চীনের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী উইঘুরদের ওপর চরম নির্যাতনের অভিযোগ প্রকাশিত হয়েছে। চীন সরকার তাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত ধারাবাহিক অভিযানকে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ হিসেবে অভিহিত করেছে। এ জনগোষ্ঠীর সদস্যরা মূলত ইসলাম ধর্মাবলম্বী।
ফাঁস হওয়া তালিকাটি এখন পর্যন্ত বন্দি থাকা উইঘুরদের সবচেয়ে দীর্ঘ তালিকা। ধারণা করা হচ্ছে, ১০ লাখেরও বেশি উইঘুরকে চীন সরকার বিভিন্ন বন্দিশিবির ও কারাগারে আটকে রেখেছে। দীর্ঘদিন ধরে মানবাধিকার সংস্থাগুলো দাবি করে এসেছে যে, সরকার দীর্ঘমেয়াদী কারাদণ্ড দিয়ে উইঘুরদের দমন ও আইনকে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
তালিকাটি প্রকাশের মাধ্যমে এ দাবির সত্যতা প্রমাণ হয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মত দিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক মহলের তীব্র সমালোচনার মুখে, চীনের কর্মকর্তারা ২০১৯ সালে স্বল্পমেয়াদী ও বিচারবহির্ভূত বন্দিশিবির বন্ধের ঘোষণা দেন। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকলেও উইঘুরদের এই বন্দিশিবিরগুলোয় আটক রাখা হত।
বন্দিশিবির বন্ধের বিষয়ে জানালেও, হাজারো উইঘুর এখনো দেশের বিভিন্ন কারাগারে আটক আছেন। অনেকে ১০ বছর বা তার চেয়েও বেশি সময় ধরে কারাদণ্ড ভোগ করছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, উইঘুরদের বিরুদ্ধে আনা জঙ্গিবাদের অভিযোগ অতিরঞ্জিত।
প্রায় ২ লাখ ৬৭ হাজার মানুষের কোনাশেহের শিনজিয়াং প্রদেশের দক্ষিণে ছোট গ্রামীণ অঞ্চল। তালিকা অনুসারে, সেই অঞ্চলের অসংখ্য বাসিন্দা ২ থেকে ২৫ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। গড় কারাদণ্ডের পরিমাণ ৯ বছর।
প্রতিবেদন মতে, সেখানে বিভিন্ন বয়স ও পেশার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের একে অপরের সঙ্গে তেমন যোগসূত্র নেই। শুধু একটি বিষয়ে মিল—তারা সবাই উইঘুর।
বিশেষজ্ঞদের মত, উইঘুর বলেই তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। চীনের প্রশাসন এ দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। শিনজিয়াংয়ের সরকারি মুখপাত্র এলিয়ান আনায়েত গণমাধ্যমকে জানান, আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তাদেরকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
আনায়েতের দাবি, ‘আমরা কখনো কোনো নিদিষ্ট ধর্মাবলম্বী, নৃগোষ্ঠী বা ধর্মকে লক্ষ্য করে ব্যবস্থা নেব না। উইঘুরদের আলাদা করে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে নির্ধারণ করার প্রশ্নই ওঠে না।’
‘আমরা কখনো খারাপকে ভালো বলবো না, বা ভালোকে খারাপ বলবো না’, যোগ করেন তিনি।
ফাঁস হওয়া তালিকাটি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, সেখানে চুরি, ডাকাতি, খুন বা জখমের মত প্রথাগত অপরাধে কাউকে দণ্ড দেওয়া হয়নি। বেশিরভাগ মানুষের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, ধর্মীয় জঙ্গিবাদ বা অন্যান্য অস্পষ্ট অভিযোগ আনা হয়েছে। সাধারণত রাজনৈতিকভাবে ভিন্নমতাবলম্বীদের হয়রানি করতে এমনটি করা হয়। উদাহরণ হিসেবে ‘ঝামেলা পাকানো ও উসকানি দেওয়ার’ মতো অপরাধের কথা বলা যায়।
শিনজিয়াং প্রদেশের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে চীন দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনচেতা উইঘুররা কখনোই চীনের বজ্রমুষ্টির শাসন মেনে নিতে পারেনি। সরকারি বাহিনীর সঙ্গে তাদের নিরন্তর সংঘর্ষ হয়ে এসেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ৯/১১ হামলার পর চীনের কর্মকর্তারা ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ তকমায় উইঘুরদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযান শুরু করে।
২০১৭ সালে অল্প কিছু সংখ্যক উইঘুর ছুরি ও বোমা হামলা চালানোয় তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান শুরু হয়। সরকার জঙ্গিবাদ দমনে গণগ্রেপ্তারকে আইনি উদ্যোগ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
২০২১ সালের এপ্রিলে প্রযুক্তিভিত্তিক ওয়েবসাইট বাজফিড কিছু স্যাটেলাইট ইমেজ সংগ্রহ করে। সেসব ছবির বরাত দিয়ে তারা জানায়, শিনজিয়াংয়ে যে সংখ্যক কারাগার আছে তাতে ম্যানহাটন দ্বীপের ৩৩ শতাংশ জায়গা ভরে ফেলা যাবে।
গত ফেব্রুয়ারিতে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই দাবি করেন, ‘প্রায় ৫ বছরে শিনজিয়াং সহিংস জঙ্গি আক্রমণ থেকে পুরোপুরি মুক্ত হয়েছে। সব গোত্রের মানুষ সুখি-শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করছে।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।