ওয়াহিদ হাসান: ‘এ মাটির তরে সকল সন্তানের আছে কিছু দান। কেউ ছিল যারা অকাতরে দিয়ে গেছে প্রান, তাদের তরে অবনত শীর তারাই মহান’। এরকমই একজন ছিলেন গাজীপুর জেলার গর্ব, কালীগঞ্জের কৃতি সন্তান শহীদ ময়েজউদ্দিন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের একজন রাজনীতিবিদ, একজন প্রথিতযশা আইনজীবী ও সমাজকর্মী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা। এছাড়াও সেনাশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের একজন শহীদ।
১৯৩০ সালের ১৭ মার্চ কালীগঞ্জের মোক্তারপুর ইউনিয়নের বড়হরা গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন। তার পিতা মরহুম ছুরত আলী ও মাতা শহর বানু। নোয়াপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর রাজা রাজেন্দ্র নারায়ন (আরআরএন) পাইলট সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালে সেখানে থেকে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ন হয়ে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৫০ সালে প্রথম বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন। সেখানে তিনি ১৯৫৩ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক (সম্মান) ও ১৯৫৫ এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে ১৯৬০ সালে একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এলএলবি পাস করে আাইন পেশায় আত্মনিয়োগ করে। পাশাপশি রাজনীতিতেও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
কলেজে ছাত্র থাকা অবস্থায় তার রাজনীতিতে হাতেখড়ি। ’৫২ ভাষা আন্দোলন দিয়েই তার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পরেন। রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই তিন বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে আসেন।
তৎকালীন সময়ে যখন পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে, তখন মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন আইনী লড়াই করতে এগিয়ে আসেন। ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পরিচালনা করার দায়িত্ব নেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পরিচালনা করার জন্য গঠিত মুজিব তহবিল আহবায়ক নির্বাচিত হন। একজন বিচক্ষণ আইনজীবি ও রাজনৈতিক হিসাবে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন।
শুধু পূর্ব বাংলার স্বাধীকার আন্দোলন নয়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে মেঘালয় দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে মুক্তি্যুদ্ধে পরিচালনাকারী নেতৃবৃন্দের সংঙ্গে তিনি একযোগে কাজ করেন।
স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠনের পর বিভিন্ন পর্যায়ে দল ও সরকারকে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য একজন সংসদ সদস্য হিসেবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে কালীগঞ্জ নির্বাচনী এলাকা থেকে যথাক্রমে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য এবং জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হবার পর দলের চরম সংকটময় দিন গুলোতে আাওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করার দুরুহ দায়িত্ব পালন করেন। ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকান্ডের পর বিশ্বাস ঘাতক খন্দকার মোশতাক কতৃক আাহুত সংসদ সদস্যদের সভার সর্ব প্রথম তীব্র প্রতিবাদ করেন মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন। তার বলিষ্ঠ এবং প্রতিবাদী দুঃসাহসিক ভূমিকায় উপস্থিত সকলেই সে দিন হতবাক হয়ে গিয়েছিল।
মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন উল্লেখযোগ্য সময় ধরে বৃহত্তর ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং পরে সভাপতি দায়িত্ব পালন করেন। একই সময় তিনি ঢাকা মহানগর এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা ছিলেন।
শহীদ ময়েজউদ্দিন সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। তার মৃত্যুর পরবর্তী সময়ে তার পরিবার বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করেন। তার পাঁচ কন্যা ও এক ছেলে সন্তানকে বাবার আদর্শে মানুষ করেছেন। সকলকেই উচ্চ শিক্ষিত ও সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। বাবার সামাজিক ও রাজনৈতিক আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তার দ্বিতীয় কন্যা মেহের আফরোজ চুমকি তার পিতার সাবেক আসনে বর্তমানে গাজীপুর-৫ কালীগঞ্জ সংসদ সদস্য হিসেবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছেন।
যে গ্রামে তিনি জন্মে ছিলেন সেই গ্রামের সাথে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিবিড় যোগাযোগ ছিল মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিনের। এলাকার মানুষের জন্য বিভিন্ন মুখী উন্নয়ন মূলক কার্যক্রমও গ্রহণ করেছিলেন। তার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় গড়ে তুলেছিলেন নোয়াপাড়া হেলথ কমপ্লেক্স। সেই হাসপাতালটি করার জন্য দান করেন ২ বিঘা জমি।
মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন এলাকার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করতে থাকেন। ১৯৭৭ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। একাধারে বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতির মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমাজ সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা করেন। সমজ সেবক হিসেবে তিনি পৃথিবীর বহু দেশে সভা, সেমিনার ও সম্মেলনে যোগদান করেন।
কালীগঞ্জ, ঘোড়াশাল, বাড়িয়া, নরসিংদী, পলাশ, রূপগঞ্জ, কাপাসিয়া, গাজীপুরসহ বিভিন্ন এলাকার বয়োজৈাষ্ঠ মানুষের কাছে তিনি এক মহান ব্যাক্তিত্ব। আজ লোক মুখে তার সে অবদানের কথা শোনা যায়। তিনি এলাকার হাজার হাজার মানুষের চিকিৎসায় সহয়তা করেছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন তারই কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। সেই উন্নয়নের কাফেলায় কালীগঞ্জবাসীর প্রতিনিধিত্ব করছেন শহীদ ময়েজউদ্দিনের কন্যা মেহের আফরোজ চুমকি এমপি। শহীদ ময়েজউদ্দিন যে স্বপ্ন দেখেছেন তার কন্যা কালীগঞ্জকে সেইভাবেই সাজিয়ে তুলছেন।
১৯৮২ সালে সামরিক বাহিনী অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল দেশব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ধাপে ধাপে গনতন্ত্র পুনঃ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন প্রবল গন আন্দোলনে রূপ নেয়। মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ গনতন্ত্র পুনঃ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শরিক হওয়া জন্য তিনি কালীগঞ্জে চলে যান। ১৯৮৪ সালে ২৭ সেপ্টেম্বর সারাদেশে ২২ দল আহুত হরতালের পক্ষে নেতৃত্ব দেওয়ার সময় কালীগন্জ থানার সামনে বটতলায় এরশাদ সরকারের লেলিয়ে দেয়া সন্ত্রাসী খুনি আজম, শহীদুল্লাহ্, শাহাবুদ্দিন সহ কয়েকজন মিলে ছুরিকাহত করে। পরে তিনি ঘটনাস্থলেই শাহাদাৎ বরন করেন। তার এই আত্মদান ক্রমে ক্রমে গনতন্ত্র পুনঃ উদ্ধারে সংগ্রামকে অভিষ্ঠ লক্ষে পৌঁছে দেয়।
কালীগঞ্জের ছাত্র ও যুব সমাজ মনে করেন মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিনে যদি আরো বেশী সময় বেঁচে থাকতেন তাহলে আরও জোড়ালোভাবে মানুষের কল্যানে দূরবর্তী স্বপ্নকে কাছে টেনে আনতে পারতেন। তার দেশপ্রেম, গনতন্ত্রের প্রতি সমর্থন, দেশের মানুষের প্রতি অংঙ্গীকার ভালোবাসা, ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা, মরন জয়ী সাহস এবং জীবন ইতিহাসের ধারাবাহিকতা সে কথাই বলে।
তাই শহীদ ময়েজউদ্দিন এর স্বপ্ন আমাদের মত তরুণ প্রজন্মের মধ্য দিয়েই বাস্তবায়িত হউক। উন্নত সমৃদ্ধশালী কালীগঞ্জ গড়ার লক্ষ্যে তার যোগ্য উত্তরসূরী মেহের আফরোজ চুমকি এমপিকে সহযোগিতার মাধ্যমে শহীদ ময়েজউদ্দিনের স্মৃতি ধারণ করা সম্ভব। আসছে আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর মরহুমের ৩৫তম শাহাদাৎ বার্ষিকীতে জানই গভীর শ্রদ্ধা।
লেখক: ওয়াহিদ হাসান, ক্রীড়া সম্পাদক, গাজীপুর জেলা ছাত্রলীগ।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।