ফারুক তাহের, চট্টগ্রাম: মোছাম্মৎ জাহান আরা বেগম হেনা। তার চোখের আলো নেই; তারপরও আলোকিত একজন মানুষের নাম হেনা। দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতাকে জয় করে তিনি নিজে আলোকিত হয়েছেন এবং চারপাশকেও আলোকিত করেছেন তার কর্মের মধ্য দিয়ে। প্রতিবন্ধী মানুষকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করে তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে দীর্ঘ সংগ্রামে নিজেকে সক্রিয় রেখেছেন তিনি। নিজের কর্মপ্রচেষ্টায় অর্জনও করেছেন অনেক।
২০১৪ সালে শিক্ষা ক্যাটাগরিতে শিশু ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রদত্ত ‘জয়িতা’ পুরস্কার পেয়েছেন হেনা। ২০১৯ সালে ২৮তম আন্তর্জাতিক ও ২১তম জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবসে চট্টগ্রাম বিভাগীয় ও জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তর তাকে সফল প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হিসেবে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করেন।
হেনা চোখের আলো নিয়েই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। শৈশব-কৈশোর কেটেছে সাধারণ অন্য আট-দশটা ছেলেমেয়ের মতোই। তার পিতা আহমদুর রহমান চৌধুরী, মাতা জান্নাত আরা। স্বামী মোহাম্মদ খাদেমুল বাশারও মৃদু প্রতিবন্ধী। চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার আমিরাবাদে তার জন্ম। একটি সামাজিক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে তিনি তার দুই চোখের আলো হারিয়েছেন আজীবনের জন্য।
কি ছিল সেই সামাজিক দুর্ঘটনা এমন প্রশ্নের উত্তরে হেনা বলেন, ‘আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে একজন সাধারণ শিশুর মতই। এই পৃথিবীর আলো-বাতাস, রংধনুর রং আমার খুব পরিচিত। আমি দেখেছি মায়ের মমতা ভরা মুখের হাসি, সবুজ ঘাসের উপর শিশিরের ছোঁয়া। আর তার সাথে ঘাসফুল। ফুলের উপর ফড়িং আর প্রজাপতির মেলা। আমি উপভোগ করেছি পৃথিবীর রূপ রং সৌন্দর্য। দক্ষিণ সাতকানিয়া গোলাম বারী উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে অধ্যায়নরত অবস্থায় আমি হারিয়ে গেলাম গহীন এক অন্ধকার জগতে। নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা চলাকালিন সময় আমাদের পাড়ায় ডাকাত পড়ে। সময়টা ছিল ১৯৯৫ সালের ৭ ডিসেম্বর, দিবাগত রাত প্রায় ২টা।
সেসময় বাড়ির বাইরে কিছু মানুষের কোলাহল শোনা যায়। একটু পর আমার চাচা তার বাড়ি থেকে চিৎকার করছে ডাকাত ডাকাত বলে। সাথে সাথে আমার ভাই জানালা খুলে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে দেখার চেষ্টা করেন, আর আমিও তার পিছন পিছন দাঁড়িয়ে পড়ি। কিছু বোঝার আগেই আমি বিছানায় অচেতন হয়ে পড়ি। শতশত ছরা গুলিতে আমার সারা দেহ ঝাঁজরা হয়ে যায়। আমার ভাইও আহত হন। তৎক্ষণাত পাশের গ্রামবাসিরা এসে জড়ো হয় আমাদের বাড়িতে। আমাকে বাঁচানোর জন্য আত্মীয় স্বজনরা আপ্রাণ চেষ্টা চালান। চট্টগ্রামের কোনও হাসপাতালে আমাকে চিকিৎসা দিতে রাজি হয়নি। তাদের ধারণা এটা নিশ্চয় কোন রাজনৈতিক ঘটনার ফল। অবশেষে ঢাকা ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে আমার চিকিৎসা শুরু হয়। আল্লাহর অশেষ কৃপায় আমি বেঁচে যাই, কিন্তু হারাতে হয় আমার দুই চোখের আলো। শুরু হয় অন্ধকারে পথ চলা।’
স্কুলে, বাড়িতে সারাক্ষণ আনন্দে মেতে থাকত যে মেয়ে, সে মেয়ে আর হাসতে পারে না। হাঁটতে-খেলতে পারেনা। খেতে পারে না নিজের মত করে। হঠাৎই সম্পূর্ণ পরনির্ভরশীল হয়ে গেল। ধীরে ধীরে কিশোরী হেনা বুঝতে পারলো তার জীবন চলার পথ থেমে গেছে। একদিকে মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়েছে, তার উপর চোখের আলো হারিয়ে প্রতিবন্ধীত্ব বরণ-এটা খুবই যন্ত্রণার ঠেকল তার কাছে। অনেকটা বোঝা হয়ে গেল পরিবারের। চার বোন এক ভাইয়ের মধ্যবিত্ত পরিবার। একমাত্র উপার্জনকারি ব্যক্তি তাদের বাবা। পরিবারের পক্ষ থেকে ভালোবাসার কোনও কমতি ছিলনা। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে তার মনে হত তিনি অবহেলিত, তার কোন স্বাধীনতা নেই। আশে পাশে মানুষের নানা অমূলক মন্তব্য। এভাবে কেটে গেল দুটি বছর।
বন্ধুরা যখন স্কুলে যেত, বাড়ির সবাই যখন কাজে ব্যস্ত থাকত, তখন হেনা মুখ লুকিয়ে কাঁদতেন। বাবা তার মলিন মুখ দেখে মাথায় হাত বুলিয়ে সান্তনা দিতেন। বাবা সব সময় পড়ালেখার চালিয়ে নিতে উৎসাহ দিতেন। বাবার আগ্রহে আর মায়ের সহযোগিতাই আবার পড়ালেখা শুরু করেন তিনি। মায়ের মুখে মুখে পড়া মুখস্ত করতেন। কিন্তু একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়ে কিভাবে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবেন সে সম্পর্কে ধারণা ছিল না। চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সাথে যোগাযোগ করে জানতে পারলেন শ্রুতি লেখকের মাধ্যমে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়।
১৯৯৮ সালে দক্ষিণ সাতকানিয়া গোলাম বারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন হেনা। পরে স্থানীয় আলহাজ্ব মুস্তাফিজুর রহমান কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি হলে হঠাৎ একদিন বিকাল বেলা এক দৃষ্টিহীন ভদ্রলোক বাড়িতে হাজির হন। তিনি হেনার মায়ের কাছে তার পরিচয় দিলেন। নাম মোহাম্মদ মহসিন। তিনি সমাজসেবা পরিচালিত সমন্বিত অন্ধশিক্ষা কার্যক্রম লোহাগাড়া উপজেলায় একজন রিসোর্স শিক্ষক হিসেবে চাকুরি করেন।
হেনা বলেন, ‘সেদিন তাকে দেখে সত্যি আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। কারণ আমি প্রথম আরেকজন দৃষ্টিহীন মানুষকে কাছে থেকে পেলাম যিনি একজন শিক্ষক হিসেবে চাকরিতে নিয়োজিত আছেন। দৃষ্টিহীন মানুষ আবার চাকরি করতে পারে! জেনে আরও অবাক হলাম। এটা কিভাবে সম্ভব! যাই হোক তিনি আমাকে ব্রেইল পদ্ধতি শেখালেন। ২০০১ সালে আমি এইচএসসি পরীক্ষায় দ্বিতিয় বিভাগে এবং ২০০৪ সালে একই কলেজ থেকে দ্বিতীয় বিভাগে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি সম্পন্ন করি। তখনো জানতাম না প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার সম্পর্কে। জানতাম না জীবন যাপন সম্পর্কে। বাবার ইচ্ছায় আমি ২০০৬ সালে চট্টগ্রাম শহরে বঙ্গবন্ধু ল টেম্পল কলেজে ভর্তি হই। কিন্তু সন্ধ্যাকালীন ক্লাস হওয়ার কারণে ছয়মাসের মাথায় আমি কলেজ যাওয়া বন্ধ করি। এরপর ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে মাস্টারসে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হই। অনেক সমস্যার মধ্য দিয়ে আমি অবশেষে দ্বিতিয় বিভাগে মাস্টার্স পাশ করি। মহসিন স্যারের সহযোগিতায় চট্টগ্রামে কয়েকজন প্রতিবন্ধী মানুষের সাক্ষাৎ লাভ করি। ধীরে ধীরে তাদের সহযোগিতাই প্রতিবন্ধী মানুষের লেখাপড়ার ক্ষেত্রে বিড়ম্বনা, জীবন যাপনের নানা যাতনার কথা সরাসরি জানতে পারি। আমার মনের মধ্যে অন্যরকম অনুভূতি সৃষ্টি হলো। নিজের কষ্ট আর নীপিড়িত মানুষের বঞ্চনা আমাকে তাড়িত করছে। কিছু একটা করতে হবে, কিন্তু কি করব তা আমি জানি না।’
হেনা আরও বলেন, ‘কয়েকজন প্রতিবন্ধী বন্ধুর সহযোগিতাই ২০০৮ সালে Disability rights Group নামে একটি দলে স্বেচ্ছাসেবি হিসেবে সম্পৃক্ত হই। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এবং জাতীয় প্রতিবন্ধী ফোরামের মাধ্যমে ইউনাইট থিয়েটার ফর সোস্যাল আ্যাকশন (উৎস) সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করেছিল। আমাদের কাজ ছিল ২০০১ সালের প্রণিত প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন অনুযায়ি জেলা কল্যাণ কমিটিকে সচল করা। কেননা, আইন থাকলেও তার কোন বাস্তবায়ন ছিল না, সরকারি ও বেসরকারী পর্যায়ে প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা। আমাদের অ্যাডভোক্যসির ফলে ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত কল্যাণ কমিটি সচল হয়ে ওঠে এবং বেশকিছু পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। যেমন সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রতিবন্ধীদের সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব এবং কিছুটা সহনশীলতা। জাতীয় প্রতিবন্ধী ফোরামের মাধ্যমে Leadership, Networking And Advocacy, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গের অধিকার এবং Convention on the Rights of Persons with the Disabled সহ নানা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি।’
২০০৮ সালে Young Power in Social Action (YPSA) থেকে কম্পিউটারের ছয় মাসের প্রশিক্ষণ নেন হেনা। Volunteer replacement program, Focal persons on Disability Resource Center, Community base rehabilitation program পরিচালনা করেন। জাপান এমব্যাসির আর্থিক অনুদানে Disability resorce Center দক্ষিণ চট্টগ্রামে প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য একটি সম্ভাবনার দ্বার খুলে যায়। প্রতিদিন প্রায় ৩০-৪০ জন প্রতিবন্ধী নারী-শিশু, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা থেরাপি, হস্তশিল্প, সেলাইসহ বিভিন্ন সেবা গ্রহণ করছেন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গের অধিকার বাস্তবায়নের জন্য Alliance of Urban DPOOs in Chittagong (AUDC) নামে প্রতিবন্ধী সংগঠন গড়ে তোলেন। বর্তমানে তিনি এই প্রতিষ্ঠানে প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব পালন করছেন। একজন নারী হয়ে প্রতিবন্ধী নারীরা পিছিয়ে থাকবে এটা মানতে পারছিলামনা। তাই নারীদের সংগঠিত করে একটি Women with disability Development Association (WDDA) নারী সংগঠন করেন। বর্তমানে সংগঠনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সম্পুর্ণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি দ্বারা পরিচালিত সংগঠনের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য কিছু কাজের মধ্যে Unhabitet এর আর্থিক সহযোগিতাই ৮০ জন প্রতিবন্ধী যুবক-যুবতীকে জীবন দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণ দেন এবং ১২ জন যুবককে ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনার জন্য আর্থিক সহযোগিতার ব্যবস্থা করেন। Disability rights Fund এর আর্থিক সহযোগিতাই চট্টগ্রাম শহরে ২১টি প্রতিবন্ধীদের দল তৈরী করেন। তাদের মধ্যে ২১ সদস্য বিশিষ্ট একটি মনোসামাজিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দল আছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এ্যাভোক্যাসি করে ৮ জন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির চাকুরীর ব্যবস্থা করেন। এছাড়া আরও অনেক সেবামূলক কাজ করেছেন।
২০১৩ সালে Movility International এর পক্ষ থেকে স্কলারসিপ নিয়ে Seventh International Women Leadership on Disability WILD place Eugene Oregon in USA অং গ্রহণ করেন হেনা। ২১টি দেশের নারী প্রতিবন্ধী প্রতিনিধি উক্ত প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন। এক মাসব্যাপি প্রশিক্ষণকালিন সময় জাতিসংঘসহ আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে নারীদের অধিকার প্রবেশগম্যতা, সমসুযোগ এবং একোমোডেশন নিয়ে তিনি কাজ করেন।
প্রতিবন্ধী বলে প্রতিবন্ধী নারীরাও বখাটেদের হাত থেকে রেহায় পান না। Handicap International Ges Bangladesh Legal Aid Service Trust (BLAST) এর সহযোগিতাই প্রায় ৫০০ জন প্রতিবন্ধীব্যক্তি ও তাদের পরিবারকে আইনের সহায়তা বিষয়ক অরিয়েনটেশন, ২৫ জনকে সরাসরি লিগেল এইড প্রদান করেন হেনা।
তিনি বলেন, ‘সমাজে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া মানুষের মধ্যে প্রতিবন্ধী নারীদের অবস্থান খুবই নাজুক। প্রতিবন্ধী নারীরা এখনো পরিবার ও সমাজে অনেক পিছিয়ে আছে। আমাদের যে রাষ্ট্রীয় অধিকারসমূহ রয়েছে, সেখান থেকে অনেক সময় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বঞ্চিত হন। আমার জীবনের স্বপ্ন প্রতিবন্ধী নারী ও শিশুদের জন্য কাজ করা। পরিবারে ও সমাজে তাদের জন্য শক্ত ভিত তৈরি করা। এমন একটি প্রতিষ্ঠান তৈরী করা যেখানে নারীরা কাজ করবে এবং শিশুরা শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করবে। কোন প্রতিবন্ধী নারী কর্মহীন থাকবেনা, পরিবার গঠনে কোন বাধা হয়ে দাঁড়াবেনা তার প্রতিবন্ধীতা। আর আমার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন সরকারি বেসরকারি আর্থিক এবং মানসিক প্রণোদনা।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।