গোলাম মওলা : বছর দশেক আগেও বড় সাইজের ছাগলের চামড়া বিক্রি হতো ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা। তখন ট্যানারি মালিকরা ৫০০ টাকা করেও ছাগলের চামড়া কিনতেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতি উল্টো। বর্তমানে বিশ্ববাজারে ছাগলের চামড়ার বিপুল চাহিদা থাকার পরও দেশের বাজারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই চামড়া মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। দেশের এই চামড়া বিশ্বমানের হওয়া সত্ত্বেও সেই চামড়ার কদর নেই। যেন ছাগলের চামড়া একেবারে উচ্ছিষ্টে পরিণত হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২৯ জুন) ঈদের দিনে দেখা গেছে, গত তিন বছরের মতো এবারও ছাগলের চামড়া ছুঁয়েও দেখছেন না আড়তদাররা। আকারে ছোট হওয়া ও সরকার নির্ধারিত মূল্য থেকে চামড়াপ্রতি খরচ বেশি হওয়ায় ছাগলের চামড়া নিতে কোনও আগ্রহ নেই আড়তদারদের। শুধু রাজধানীই নয়, সারা দেশে ছাগলের চামড়ার কোনও দামই পাননি বিক্রেতারা। প্রতি কাপ চা খেতে লাগে ১০ টাকা, অথচ এবারের কোরবানির ঈদে মাত্র পাঁচ টাকা বা তারও কম দামে প্রতি পিস ছাগলের চামড়া বিক্রি হতে দেখা গেছে। অনেক জায়গায় চামড়ার কোনও ক্রেতাই নেই। রাজশাহীর বাঘায় ১০ টাকা দরে ছাগলের চামড়া বিক্রি হয়েছে। নীলফামারীতে ছাগলের চামড়ার দাম ছিল মাত্র ২৫ টাকা। সরেজমিন দেখা গেছে, ছাগলের চামড়া নিয়ে কোনও আগ্রহই নেই আড়তদার ও ট্যানারি মালিকদের। অনেক ক্ষেত্রেই তারা ছাগলের চামড়ার দরদাম করেননি। এ কারণে অনেক বিক্রেতা ছাগলের চামড়া ফেলে যান, কিংবা নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করেন।
রাজধানীর কল্যাণপুর থেকে ছাগলের ১০টি চামড়া নিয়ে সায়েন্স ল্যাব এলাকায় আসেন একটি মাদ্রাসার শিক্ষকরা। একে একে ছয় জন ক্রেতার কাছে এই চামড়া নিয়ে যান তারা। কিন্তু তাদের কেউই কিনতে আগ্রহ দেখাননি। পরে এক ক্রেতা ১০টি চামড়ার জন্য মাত্র ৩০ টাকা দেওয়ার প্রস্তাব করেন।
ছাগলের চামড়ার দাম এত কম কেন, জানতে চাইলে পোস্তা এলাকার আড়তদাররা বলছেন, একটা চামড়া ১০ টাকা দিয়ে কিনলেও এর পেছনে সব মিলিয়ে প্রায় ৬০ টাকা খরচ হয়। কিন্তু ট্যানারিতে বিক্রির সময় ২০-৩০ টাকার বেশি পাওয়া যায় না। এ কারণেই এখন কেউ ছাগলের চামড়া কিনতে চান না।
বৃহস্পতিবার কোরবানির পর ছাগলের চামড়া না নেওয়ার কারণ হিসেবে আড়তদাররা বলছেন, ছাগলের একটি চামড়ার পেছনে তিন কেজি লবণ প্রয়োজন। এতে খরচ হচ্ছে ৩০ টাকা। এর সঙ্গে শ্রমিক ও পরিবহন খরচ মিলিয়ে মোট ৬০ টাকা খরচ হয়। সে হিসেবে ছাগলের চামড়ায় সরকার নির্ধারিত পরিমাপে খরচ বেশি পড়ে যায়।
জানা গেছে, স্থানীয় বাজারে পশুর চামড়ার একটি লেডিস হাতব্যাগের দাম ন্যূনতম দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। এই ব্যাগ তৈরিতে লাগে মাত্র তিন ফুট চামড়া। এই চামড়া ট্যানারি থেকে উদ্যোক্তারা সংগ্রহ করেন প্রতি বর্গফুট ১০০ থেকে ২৫০ টাকায়। অথচ প্রতিটি ছাগলের চামড়ার দাম ৫০ টাকাও পান না এর মালিকরা।
লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি সাইফুল ইসলাম জানান, প্রতিবছর ঈদুল আজহায় গরুর চামড়ার পাশাপাশি ছাগলের চামড়া সংগ্রহ করা হয় ২০ থেকে ৩০ লাখ।
যদিও কোরবানিদাতাদের বক্তব্য হলো— ছাগলের চামড়া নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে বিপাকে পড়েছেন তারা।
অর্থনীতির বিশ্লেষকদের মতে, চামড়ার বৈশ্বিক চাহিদা বর্তমানে কিছুটা কম থাকলেও চামড়াজাত পণ্যের দাম কমেনি।
এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘চামড়া শিল্পের দিকে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের নজর দিতে হবে। এই খাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী বাড়াতে হবে। বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের অব্যবস্থাপনা থেকে উদ্ধার করে ৩০ থেকে ৪০টি বিদেশি বিনিয়োগকারীর মাধ্যমে এই খাতে ৩০ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ আনা গেলে দেশের চামড়া খাতে আমূল পরিবর্তন আসবে।’
বাংলাদেশ ট্যানারস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, বৈশ্বিক চামড়ার বাজার ৪২০ বিলিয়ন ডলারের। ২০৩২ সালে এর বাজার হবে ৭৩৫ বিলিয়ন ডলারের। প্রায় ৬ শতাংশ হারে বৈশ্বিক এই বাজার বাড়ছে। বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে ১০ বিলিয়ন ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করতে চায়, যা বর্তমানে ১০০ কোটি ডলার (এক বিলিয়ন)।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।