নিজস্ব প্রতিবেদক: জনতা ব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেয়া মো. আবদুল জব্বারের প্রোফাইলে মোটা অক্ষরে লেখা রয়েছে, ‘তাঁর নেতৃত্বের প্রধান শপথ হচ্ছে কর্মীই প্রথম এবং সঠিক জায়গায় সঠিক ব্যক্তি।’ কিন্তু তাঁর এই শপথের সাথে বাস্তবতা বিপরিতমুখী হওয়ায় হতাশা ও ক্ষোভ গ্রাস করেছে জনতা ব্যাংকের সাড়ে ১২ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারিকে।
একদিকে দায়িত্ব গ্রহণের পাঁচ মাসেই জনতা ব্যাংককে ইতিহাসের সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থায় দাঁড় করানো, অন্যদিকে কর্মীদের প্রতি অভিভাবকসুলভ আচরণ না করা- সব মিলিয়ে হতাশ হয়ে পড়েছেন তারা।
মানবসম্পদ বিভাগের স্বেচ্ছাচারিতা ও দায়িত্ব অবহেলার কারণে ছুটি না পাওয়ায় বিনা চিকিৎসায় এক সহকর্মীর মৃত্যুর শোকে ব্যাংকটির কর্মকর্তা-কর্মচারিরা যখন মূহ্যমান, তখন এই শোকের আগুন উষ্কে দিয়েছেন জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মো. আবদুল জব্বার। ছয়দিন আগে সময় টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘তদবির না করায় ওই ব্যাংক কর্মকর্তা ছুটি পায়নি।’
এমডি’র এমন বক্তব্যে স্তব্ধ হয়ে পড়েছেন কর্মকর্তা-কর্মচারিরা। সহকর্মীর জন্য তাদের শোক ছাইচাপা দ্রোহে রূপ নিয়েছে। ব্যাংকের প্রতিটি টেবিলেই এখন আলোচনা এমডি’র ‘অমানবিক’ ও ‘অপেশাদারসুলভ’ মনোভাব নিয়ে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও চলছে এ নিয়ে তুমুল আলোচনা। তারা ঘটনার নিন্দা ও দায়ীদের বিচার দাবি করছেন।
ব্যাংকটির কর্মকর্তারা বলেছেন, ৩৩ বছরেও জনতা ব্যাংকের কর্মীদের নিজের করে নিতে পারেননি আবদুল জব্বার। তা না হলে তিনি ‘সন্তানসম’ মৃত সহকর্মীর জন্য শোক ও দুঃখ প্রকাশ না করে ভুক্তভোগীকেই দায়ী করতে পারতেন না। এমনকি এমডি’র এমন বক্তব্যে অবাক হয়েছেন জ্যেষ্ঠ ব্যাংকাররাও।
টেলিভিশন চ্যানেলটির সংবাদে জানা যায়, তিন মাস আগেই চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে ২০ দিনের ছুটির আবেদন করেছিলেন জনতা ব্যাংকের নওগাঁ এরিয়া অফিসের প্রিন্সিপাল অফিসার দেওয়ান মো. শাহাদাৎ হোসেন। কিন্তু তদবির না করায় ছাড় হয়নি ছুটির ফাইল। বিদেশে চিকিৎসা না নিতে পেরে বাঁচার শেষ সুযোগটুকু পাননি শাহাদাৎ হোসেন। গত ২৪ সেপ্টেম্বর মারা যান তিনি। এতিম হয়েছে ১০ মাসের শিশুসহ তিন সন্তান। দিশেহারা শাহাদাতের স্ত্রীসহ পুরো পরিবার।
মর্মান্তিক এ ঘটনার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় থেকে তদবির করাটাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন এমডি। সময় টিভিকে আবদুল জব্বার বলেছেন, ‘এই ঘটনায় কোনও কর্মকর্তা দোষী নন। ছুটির আবেদনের পর এটা নিয়ে তদবির করলেই পারতো। কারণ এটাই ঐতিহ্য।’
দায়িত্বহীনতার বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি উল্টো প্রশ্ন রাখেন, ‘কিসের দায়িত্বহীনতা বলেন তো! এই দায়িত্বহীনতা কে করছে? এ রকম শত শত আবেদন আসে।’
তিনি বলেন, ‘যারা সিরিয়াস মনে করে তারা একবার স্মরণ করায়, স্যার আমি একটু জরুরি যাবো। (শাহাদাতের) ছোট একটা দরখাস্ত আমি দেখেছি।’
ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তার এমন মন্তব্য গ্রহণযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার।
টিভি চ্যানেলটিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘এটা আমি মনে করি অমানবিক। প্রধান কার্যালয়ের যারা দায়িত্বশীল ছিল, তারা এটা সঠিক সময়ে পাঠাননি। রেগুলেশন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে এটার একটা বিচার পদ্ধতিতে যাওয়া উচিত।’
এমডি’র বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ব্যাংকটির একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না কারার শর্তে জুমবাংলা’কে বলেন, এমডি হলেন আমাদের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর অভিভাবক। তিনিই যদি আমাদের প্রতি অমানবিক হন, তাহলে আমরা কোথায় যাবো? তিনি আমাদের সহকর্মীর মৃত্যুর প্রেক্ষিতে গণমাধ্যমে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা কোনভাবেই আমরা মেনে নিতে পারছি না। তার এই বক্তব্য আমাদেরকে স্তব্ধ করে দিয়েছে।
শোচনীয় অবস্থায় পড়েছে জনতা ব্যাংক
আবদুল জব্বারের সময়ে এসে ইতিহাসের সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থায় পৌঁছেছে জনতা ব্যাংক পিএলসি। চলতি বছরের এপ্রিলে তিনি যখন দায়িত্ব নেন তখন ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। জুন শেষেই তা বেড়ে হয়েছে ২৮ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা। এর ফলে ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ৩২ দশমিক ৬ শতাংশই এখন খেলাপি। মার্চেও এ হার ছিল ১৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। অর্থাৎ খেলাপি ঋণের হার দ্বিগুণ হয়েছে। এতে দেশের মোট খেলাপি ঋণের ১৮ শতাংশের বেশি অংশীদারিত্ব এখন মো. আবদুল জব্বারের নেতৃত্বাধীন ব্যাংকটির।
বিপুল খেলাপি ঋণের কারণে বড় অংকের মূলধন ঘাটতিতে পড়ার পাশাপাশি দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনায় প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা ধার করতে হচ্ছে জনতা ব্যাংককে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।