জুমবাংলা ডেস্ক : গণআন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার তিন দিন পরে গত ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই জনপ্রশাসনে ব্যাপক রদবদল শুরু করা হয়। বিশেষ করে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া শীর্ষ কর্মকর্তাদের চুক্তি বাতিল এবং প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে ‘শেখ হাসিনার সরকারের অনুগত’ শীর্ষ কর্মকর্তাদের সরিয়ে দিয়ে তাদের জায়গায় আগের কোণঠাসা কর্মকর্তাদের পদায়ন করা হয়েছে।
গত এক মাসে প্রশাসনের শীর্ষপদে ব্যাপক রদবদলের পাশাপাশি ৫ জন সাবেক অতিরিক্ত সচিবকে চুক্তিভিত্তিক সচিব নিয়োগ দেওয়ার দুদিনের মাথায় তাদের সিনিয়র সচিব করা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে কাজে গতি আনতেই প্রশাসনে রদবদল আনা হচ্ছে। তবে জনপ্রশাসনে গতি ফেরাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও এখনও স্থবিরতা কাটেনি বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। সচিবসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে ওএসডি করা ও বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর পর কর্মকর্তাদের মধ্যে এখনও আতঙ্ক বিরাজ করছে।
আওয়ামী লীগ আমলে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, ইরাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. ফজলুল বারী, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মো. কামরুজ্জামান, জাপানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শাহাবুদ্দিন আহমদ ও তথ্য কমিশনের সচিব জুবাইদা নাসরিনের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে।
এ ছাড়া নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোস্তফা কামাল ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরীসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়েছে।
বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. মনিরুজ্জামানসহ অনেক কর্মকর্তাকে। বাতিল করা হয়েছে শেখ হাসিনাসহ বিগত সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের কূটনৈতিক পাসপোর্ট। ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান ও চট্টগ্রাম বন্দরের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহাইলকে চাকরিচ্যুত করে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও কুমিল্লাসহ ২৫ জেলার ডিসিকে প্রত্যাহার করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দফতরে বদলি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। বাকি ডিসিদেরও পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহার করে সেখানে নতুন ডিসি নিয়োগের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বঞ্চিত হওয়া কর্মকর্তাদের বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
অন্যদিকে সরকার ‘বঞ্চিত’দের পদোন্নতি প্রদান অব্যাহত রেখেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বঞ্চিত ছিলেন এমন ১৩১ জন যুগ্ম সচিবকে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন ২২৩ জন। এ ছাড়া সিনিয়র সহকারী সচিব মর্যাদার ১১৭ কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দিয়ে উপসচিব করা হয়েছে। পিএসসির পরীক্ষায় সব ধাপে উত্তীর্ণ হওয়ার পরও গত দেড় যুগে নিয়োগ না পাওয়া আড়াইশ’রও বেশি ব্যক্তিকে সম্প্রতি নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের অংশ হিসেবে সরকারি সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদের হিসাব দেওয়ার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
সারা দেশে ১২টি সিটি করপোরেশন ও ৩২৩টি পৌরসভার মেয়র এবং বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের অপসারণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। সব মিলিয়ে ১ হাজার ৮৭৬ জন জনপ্রতিনিধিকে অপসারণ করে এসব পদে প্রশাসক হিসেবে সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতিরা পদত্যাগের পর সেখানে নতুন বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিনের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মো. আসাদুজ্জামান। বিগত সরকারের আমলের নিয়োগ বাতিল করে সম্প্রতি সারা দেশে ৬৬ জন আইনজীবীকে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও ১৬১ জনকে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল পদে নতুন নিয়োগ দিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। হাসিনা সরকারের পতনের পর সরকারি, আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি-প্রো ভিসি এবং প্রক্টরসহ শীর্ষ পদের ব্যক্তিরা দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে কেউ কেউ স্বেচ্ছায় পদ ছাড়ছেন, আবার অনেক প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ, অপমান-অপদস্তসহ চাপের মুখে অনেকে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন।
ক্ষমতা গ্রহণের পর দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারি কোনো কাজে যেন আর দুর্নীতি না হয়, সেটি নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। এ ছাড়া সরকারি সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদের হিসাব চেয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে সরকার। দুর্নীতির অভিযোগে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রায় অর্ধশত মন্ত্রী এমপির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। গত এক মাসে প্রশাসনকে গতিশীল করতে নানা পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এর মধ্যে রয়েছে ক্ষমতা হারানোর চারদিন আগে ‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ’ ও তাদের ছাত্র সংগঠন ‘ইসলামী ছাত্রশিবির’কে নিষিদ্ধ করে আওয়ামী লীগ সরকার যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল তা বাতিল করেছে। এ ছাড়া ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা নেওয়ার পর গত দেড় দশক ধরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুদিন ১৫ আগস্টের সরকারি ছুটি বাতিল করা হয়েছে। ‘বৈষম্যমূলক নীতি’ বিবেচনায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তায় প্রণীত আইনটিও বাতিল করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। এর ফলে বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং তাদের সন্তানদের জন্য বিশেষ নিরাপত্তার সুবিধাটি আর নেই।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরবর্তী প্রায় তিন সপ্তাহজুড়ে সচিবালয় ও জাতীয় প্রেস ক্লাব এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে নানা দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করতে দেখা গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল সচিবালয় ঘেরাও করে আনসার সদস্যদের বিক্ষোভ। ‘রেস্ট প্রথা’ বাতিল করে চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে গত ২৫ আগস্ট সারাদিন সচিবালয় অবরোধ করে রেখেছিলেন আধা-সামরিক বাহিনীর প্রায় ১০ হাজার আনসার সদস্য। আলোচনার মাধ্যমে বিকালে সরকারের পক্ষ থেকে ‘রেস্ট প্রথা’ বাতিল ঘোষণা করা হলেও আন্দোলন না থামিয়ে তারা সচিবালয়ের ভেতরে ঢুকে পড়েন। পরে ছাত্রদের সঙ্গে সংঘর্ষের পর তারা পালাতে বাধ্য হন। এ সময় অবরোধ ও সংঘর্ষের ঘটনায় গ্রেফতার সাড়ে তিনশ’রও বেশি আনসার সদস্যকে গ্রেফতার দেখিয়ে পরবর্তী সময়ে কারাগারে পাঠানো হয়। এমন পরিস্থিতিতে পরবর্তী সময়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ও সচিবালয়ের আশপাশে সভা-সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করেছে পুলিশ। সে সঙ্গে প্রধান বিচারপতির সরকারি বাসভবন, বিচারপতি ভবন, হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ ও মৎস্যভবন সংলগ্ন এলাকায়ও সভা-সমাবেশ না করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মূল লক্ষ্যে এখনও পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এটা যদিও কোনো সহজ কাজ নয়, তবে তা সম্ভব।
তিনি বলেন, আমরা যে কর্তৃত্ববাদের পরাজয় দেখলাম তার মূলে ছিল দুর্নীতি ও দুঃশাসন। জনগণের অর্থ আত্মসাৎ করে সম্পদের পাহাড় গড়াই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। যেখানে জনগণের কাছে কোনো জবাবদিহিতা ছিল না। ছিল প্রশাসনে দলীয়করণ ও পরিবারতন্ত্রের ছড়াছড়ি। আর এগুলোর প্রতিবাদ করতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের চড়াই-উৎরাই পার হতে হয়েছে। আর এসবের বিরুদ্ধে কথা বলায় তারা আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেছিল।
শিক্ষার উন্নয়নে বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে: রাষ্ট্রপতি
তিনি বলেন, বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার লক্ষ্যে সবাইকে কাজে লাগিয়ে তা এগিয়ে নিতে হবে। কারণ পৃথিবীতে অনেক বিপ্লব হলেও আমাদের দেশের ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী বিপ্লব পৃথিবীতে বিরল।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।