এ কে এম জামীর উদ্দীন: ভোর হতে আরও ঘণ্টাখানেক বাকি। সারারাত ঘুমাইনি। কিন্তু, শরীরে না ঘুমানোর কোনো অবসাদ নেই। একটু পর নায়াগ্রা জলপ্রপাতে দেখবো। অন্যরকম ভালো লাগার অস্থিরতা কাজ করছে। গত বছর অক্টোবরের শেষ সপ্তাহের কোনো এক রাতের শেষ প্রহরের কথা বলছি। নিউইয়র্ক শহর থেকে বাফেলোতে সবেমাত্র বাস থেকে নামলাম। অঞ্চলটি কানাডার একেবারে সীমান্তবর্তী। টার্মিনালের ভিতর অপেক্ষা করছিলাম, ভোর হওয়ার জন্য।
শরীর-মন উভয় হালকা। কারণ, ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ডের ফেলোশিপের পড়াশোনা শেষ। একাধিক সেমিনারের ধকল ছিল। সব শেষ করে এখন আমেরিকা দেখার পালা। নতুন কিছু দেখলে এমনিতে পুলক অনুভব করি। ফলে পুলকিত।
এর মধ্যে হঠাৎ শিকারী কুকুরসহ আমার দিকে এগিয়ে আসলো পুলিশ। আমি কিছুটা ভীত-সন্ত্রস্ত। আমার পাশের দুইজনকে দেখিয়ে বললেন, তারা কি তোমায় কোনো ঝামেলা করছে। আশ্বস্ত হলাম, আমি তাদের টার্গেট নই। এই প্রথম খেয়াল করলাম দুইজন “কালো” ছেলে-মেয়ে একজন আরেকজনের বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে বেঞ্চের ওপর। পুলিশের আগমনে তাদের ঘুম ভাঙে। পরে তারা বাধ্য হয়ে ওই স্থানটি ত্যাগ করে।
বিষয়টি তখনও আমার মধ্যে ওইভাবে খুব একটা রেখাপাত করেনি। আরেকদিনের ঘটনা। ওয়াশিংটনের মূল শহরের বাইরে একদিন ঘুরতে যাওয়া হয়। উবারের গাড়িতে ছিলাম। সবকিছু নিয়েই কৌতুহল কাজ করছিল। চালককে জিজ্ঞেস করলাম ওই জায়গাটি সম্পর্কে। তিনি জানালেন, এখানে “কালোরা” থাকেন। তবে জায়গাটি নাকি ভয়ঙ্কর নয়। এর পাশের জায়গাটি ভয়াবহ, ওইটিও “কালো” অধ্যুষিত। সেখানো কোনো আইন নাই এবং “কালোরা” বন্দুক নিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। এরপরই বিষয়টি নিয়ে মনের মধ্যে রেখাপাত করে। আমেরিকান বন্ধুদের জিজ্ঞেস করলাম, প্রসঙ্গটি নিয়ে। “কালো” শব্দটি তাদের কাছে অনেকটা আতঙ্কের বিষয়। ওয়াশিংটন বা নিউইয়র্ক শহরে “কালোদের” দেখা পাওয়া দুষ্কর। যারা ভারসাম্যহীন সমাজব্যবস্থায় কিছুটা সুবিধা পেয়ে উচ্চপদস্ত সরকারি বা কর্পোরেট চাকরি করেন তাদের দেখা যায় কালেভদ্রে।
যতটুকু বুঝলাম, তাদেরকে কোনঠাসা করে একেকটা অঞ্চলে আবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে। পাশাপাশি প্রতিনিয়ত কারণে বা অকারণে তারা অপদস্তের স্বীকার হোন। যেভাবে বাফেলোতে দেখেছিলাম।
তখন নিজের মনের মধ্যে অ্যালেক্স হেলির রুটস বইটির কথা মনে পড়ে গেলো। কীভাবে তাদেরকে আফ্রিকা থেকে বন্দী করে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে নিয়ে আসা হয়েছিল, এর বিশদ বিবরণ হেলি তার বইটিতে তুলে ধরেছেন। ইউরোপ বা উত্তর আমেরিকার আজকের তথাকথিত কনক্রিটের সভ্যতা বিনির্মাণের পেছনে এই “কালোদের” অবদান অন্যতম। হেলি নিজেও ওই সম্প্রদায়ের লোক ছিলেন। তার বইটি উপন্যাস আকারে লিখলেও এর প্রত্যেকটি বিবরণ ছিল নিপাট সত্য।
আমেরিকার শেষ কয়টি দিন আমাকে বেশ অস্থির করে তুলেছিল হেলি। “কালো” শব্দটি ওই সম্প্রদায়ের কাছে ভয়ঙ্কর একটি অধ্যায়ের নাম। তারা এটিকে সহ্য করতে পারেন না। কেন? কারণ এই শব্দের দোহাই দিয়ে তাদেরকে নিপীড়ন করা হচ্ছে বছরের পর বছর। এর সর্বশেষ অধ্যায়ের নাম জর্জ ফ্লয়েড।
গত ২৫ মে ফ্লয়েডকে মিনেসোটায় খুন করা হয়েছে। সাদা পুলিশ অফিসার ডেরেক চভিন টানা নয় মিনিট হাঁটু চেপে ধরে রাখেন ফ্লয়েডের ঘাড়। যতক্ষণ না পর্যন্ত তিনি মারা যান। সেখানকার একটি রাস্তায় দিনেদুপুরে মাত্র ২০ ডলারের একটি বিলের সত্যতা যাচায়ের সূত্র ধরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। ফ্লয়েড এই ৯ মিনিটে অনেকবার বলেছিলেন, ‘আই ক্যান্ট ব্রিদ।’
আমরা জানি, ক্ষমতাসীনরা ইতিহাস বিনির্মাণ করেন। যেখানে নিপীড়িতদের জায়গা হয় না। এসব ক্ষমতাসীনরা নিজেদের প্রয়োজনে আইন তৈরি করেন। বেআইনী কর্ম সাধন করার জন্যও তারা আইন তৈরি করেন। আবার আমাদের মতো অনেকে সেটাকে অভিহিত করি “কালো” আইন বলে। অর্থাৎ যা কিছু খারাপ তা সব কালো।
বহুদিন আগে মিচেল ফুকোর ডিসকোর্স পড়তে গিয়ে উপলব্দি করেছিলাম, আমাদের ভালো লাগার অনুভব থেকে শুরু করে সুন্দরের রং সবকিছু ক্ষমতাসীনরা তৈরি করে। এর জন্য তারা ব্যবহার করে নিজেদের মিডিয়া ও ক্ষমতা। নিজেদের ব্যবসার প্রয়োজনে তারা মাঝেমধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েদেরও বিশ্বসুন্দরী হিসেবে নির্বাচিত করে। এর মানে হচ্ছে, ক্ষমতাসীনরা চাইলে সাদাকে বিশ্রিভাবে উপস্থাপন করার মতো শক্তি রাখে।
তারা যদি চায়, কালোই হয়ে যেতে পারে সুন্দরের রং। কিন্তু সেটা হবে না। নিজেদের আধিপত্য টিকিয়ে রাখার জন্য তারা এটি হতে দিবে না।
হাওয়ার্ড ফার্স্টের আরেকটি বই পিকস্কিল এখানে প্রাসঙ্গিক। ১৯৪৯ সালে “কৃষ্ণাঙ্গ” গায়ক পল রবসনের কনসার্ট নিয়ে বইটি লেখা হয়েছিল। নিউইয়র্কের পিকস্কিলে ওই বছর বেশকিছু কনসার্টের গায়ক ছিলেন রবসন। তিনি ছিলেন একাধারে বাম রাজনীতিবিদ ও শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ নেওয়া একজন কর্মী। সেই কনসার্টে রাষ্ট্রের সাহায্যে সাদারা ভয়ঙ্করভাবে আক্রমন করে। সেখান থেকে শুরু হয়েছিল দাঙ্গা। সেই দাঙ্গা এখনও বিভিন্ন অবয়বে দুনিয়াজুড়ে হচ্ছে।
দক্ষিণ আফ্রিকাতে “কৃষ্ণাঙ্গদের” অধিকার আদায়ের জন্যও নেলসন ম্যান্ডেলাদের সংগ্রাম আপাত:দৃষ্টিতে শেষ মনে হলেও এর কি আদৌ শেষ হয়েছে। বেঞ্জামিন মোলয়সদের মতো কবিদের সেখানে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলতে হয়েছিলো বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে। নির্মলেন্দু গুণের কবিতায় তা উঠে এসেছে।
তিনি লিখেছিলেন, যে বয়সে পুরুষ ভালোবাসে নারীকে, সে বয়সে তুমি ভালোবেসেছিলে তোমার মাতৃভূমি, দক্ষিণ আফ্রিকাকে। যে-বয়সে পুরুষ প্রার্থনা করে প্রেয়সীর বরমাল্য, সে-বয়সে তোমার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়েছে ফাঁসির রজ্জুতে। যে-বয়সে পুরুষের গ্রীবা আকাঙ্খা করে রমণীর কোমলবাহুর ব্যগ্র-মুগ্ধ আলিঙ্গন; সে-বয়সে তোমাকে আলিঙ্গন করেছে মৃত্যুর হিমশীতল বাহু। …….. কারাগারের ফটকে নেলসন মেন্ডেলার পত্মী যখন তোমার শোকাতুরা মাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন, মোলয়েস, তখন তোমার মায়ের পুত্রশোকদগ্ধ বুকের উদ্দেশে পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলি ছুটে গিয়েছিল; তারা মাথা নত করে ফিরে এসেছিল লজ্জায়, তোমার সাহসের যোগ্য হয়ে উঠবে বলে, তোমার ভালোবাসার যোগ্য হয়ে উঠবে বলে।
নির্মলেন্দু গুণ আরও লিখেছেন, বেঞ্জামিন মোলয়েস, তুমি একটুও ভেবো না, তোমার অপূর্ণ স্বপ্নসমূহ বুকে নিয়ে আমরা জেগে আছি এশিয়ায়; তুমি আফ্রিকার মাটিতে ঘুমাও।
আমরা জানি, ১৯৮৫ সালে ফাঁসিতে শহীদ হওয়া মোলয়সের ঘুম কোনোভাবে শান্তিতে হচ্ছে না। কারণ আমেরিকার বৈষম্যের দিকে চোখ দিলেই তা স্পষ্ট হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্সাস ব্যুরোর তথ্য মতে, ২০১৮ সালে একটি কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারের বার্ষিক আয় ছিল ৪১ হাজার ৩৬১ ডলার, যা ২০০৮ সালের মন্দার পর তিন দশমিক চার শতাংশ বেড়েছিলো।
একই সময় একটি হিস্পানিক (মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আগত যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী বাসিন্দা) পরিবারের আয় আট দশমিক আট শতাংশ বেড়ে হয়েছিল ৭০ হাজার ৬৪২ ডলার।
ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংকট্যাঙ্ক ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের পরিসংখ্যান আরও ভয়ঙ্কর। ২০১৬ সালে একটি সাধারণ কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারের গড় সম্পদের পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ১৫০ ডলার। একই সময় একটি শেতাঙ্গ পরিবারের গড় সম্পদের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৭১ হাজার ডলার, যা কোনো কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারের চেয়ে ১০ গুণ বেশি।
সম্পদের এই বৈষম্যের অবসান হতে আরও কত বছর লাগবে আমরা এখনও জানি না। এখন দুনিয়াতে ফ্লয়েডের হত্যাকাণ্ড নিয়ে আন্দোলন চলছে। এই ধরনের আন্দোলন আগেও হয়েছিল। সামনেও হবে। তবে অতীত বলে, এসব আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে কখনও ব্যর্থ হয় না।
কিন্তু, এর চেয়ে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হচ্ছে কালো শব্দটি এখন একটি আধিপত্যবাদী ডিসকোর্সের নাম। আমেরিকায় “কৃষ্ণাঙ্গরা” কালো শব্দটি সহ্য করতে পারেন না। আফ্রিকান-আমেরিকান হিসেবে সম্বোধন করলে তারা সস্থিবোধ করেন। কিন্তু বিশ্বের অন্যপ্রান্তরে তাদেরকে কি নামে সম্বোধন করা হবে?
এখানে ফুকোর ডিসকোর্স নিয়ে চিন্তা বেশ প্রাসঙ্গিক। কারণ, কালো শব্দটি এখন বর্ণবাদের সমার্থক হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। বিভিন্ন কারণে মানুষের সভ্যতা এখন হুমকির মুখে। আমরা যদি এসব আধিপত্যবাদী চিন্তা ভাঙতে না পারি, তাহলে আগামীতে আমাদের আবাসস্থল আরও খারাপ পরিণতি মোকাবেলা করবে।
আশার বিষয়, জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু এই ডিসকোর্সকে প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা দিয়েছে। একদিন হয়তো এই ধরনের অসংখ্য ধাক্কা এসব ডিসকোর্সকে টলিয়ে দিবে।
এ কে এম জামীর উদ্দীন: সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার, দ্যা ডেইলি স্টার
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।