সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা। মিষ্টি জলের জন্য হাঁটতে হয় তিন কিলোমিটার। পথে লোনা পানি আর ভাঙা বাঁধ। মরিয়া এক নারী, সালমা বেগম, কাঁধে মাটির কলসি নিয়ে যাত্রা শুরু করেন ভোরে। পথে জোয়ারের পানি। হাঁটু সমান লবণাক্ত জলে ডুবতে ডুবতে এগোন। কখনও পা পিছলে পড়ে যান। কলসির পানি ছিটকে পড়ে। চোখে জল? না, লবণাক্ততার জ্বালা। “এখন তো কষ্ট করে পানি আনতে পারি, আগামী প্রজন্মের কী হবে?” প্রশ্ন তার কণ্ঠে কাঁপুনি ধরে। সালমার এই যাত্রাপথই যেন বাংলাদেশের জলবায়ু সংকটের প্রতীক— জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নামক দানবের সামনে দাঁড়িয়ে এক জাতির হতাশা আর সংগ্রামের ইতিহাস।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব: উপকূলীয় অঞ্চলে এক নির্মম বাস্তবতা
বাংলাদেশের ৭১০ কিলোমিটার উপকূলরেখা আজ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সরাসরি মোক্ষভূমি। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়, ও লবণাক্ততা ঢুকে পড়েছে মানুষের নিত্যজীবনে।
- সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি: NASA-র তথ্যমতে, গত ৩০ বছরে বাংলাদেশে সমুদ্রস্তর বেড়েছে ৩-৮ মিমি/বছর, যা বৈশ্বিক গড়ের দ্বিগুণ। ২০৫০ নাগাদ উপকূলের ১৭% এলাকা তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা (World Bank, 2023)।
- লবণাক্ততার আগ্রাসন: সুন্দরবন লাগোয়া ১০৫টি ইউনিয়নের ৭০% জমিতে লবণাক্ত পানি ঢুকে ফসল উৎপাদন অসম্ভব করেছে। SRDI-র গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৭৩ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত লবণাক্ত জমির পরিমাণ বেড়েছে ২৬ লাখ হেক্টর থেকে ৩৮ লাখ হেক্টরে (Soil Resource Development Institute)।
- ঘূর্ণিঝড়ের বিধ্বংসী রূপ: সিডর, আইলা, আম্ফান— এই নামগুলো উপকূলবাসীর মনে আতঙ্কের ছাপ রেখেছে। ২০২০-২০২৩ পর্যন্ত ৭টি বড় ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ গেছে ১,২০০ মানুষের, ক্ষতি ১২ বিলিয়ন ডলার (BMD, 2023)।
মাছের চাষি থেকে দিনমজুর: খুলনার কয়রা উপজেলার রহিমুল ইসলামের কথা ভাবুন। ২০ বিঘা জমিতে মাছ চাষ করতেন। ২০১৯ সালের ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের পর তার পুকুর লবণাক্ত প্লাবনে ডুবে যায়। “এখন ঢাকায় ইটভাটায় কাজ করি। পরিবার ছাড়া জীবন,”— তার চোখে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ছায়া।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব: কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তায় ধ্বস
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সরাসরি আঘাত হেনেছে বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থায়। ধান, গম, সবজির উৎপাদন হ্রাস, মিঠাপানির সংকট, এবং নতুন রোগ-বালাই কৃষকদের হতাশ করছে।
ফসল উৎপাদনে বিপর্যয় (BRAC গবেষণা, ২০২৩)
ফসল | ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা (%) | উৎপাদন হ্রাস (%) |
---|---|---|
বোরো ধান | ৪৫% | ২৫-৩০% |
রবি শস্য | ৩০% | ২০-২৫% |
মাছ চাষ | ৬০% | ৪০-৫০% |
- উত্তরাঞ্চলের খরা: রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জে বৃষ্টিপাত কমেছে ২০%। পদ্মার পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় টিউবওয়েল অকেজো।
- হাওর অঞ্চলের বন্যা: সুনামগঞ্জের হাওরে আগাম বন্যা ধান গাছ ডুবিয়ে দেয়। ২০২২ সালে ৮ লক্ষ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত (WFP প্রতিবেদন)।
সবজি চাষি জাহানারা বেগমের কণ্ঠস্বর: “নেত্রকোনার বারোমারিতে আগে বছরে তিনটি ফসল হতো। এখন বৃষ্টি না হলে শুকনা মরু, বৃষ্টি এলে বন্যা। কীভাবে বাঁচব?”
জলবায়ু উদ্বাস্তু: ভূমিহীনের নতুন পরিচয়
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সবচেয়ে মর্মান্তিক চিত্র হলো জলবায়ু উদ্বাস্তু। বিশ্বব্যাংকের মতে, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ১.৩ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। এখনই প্রতি বছর ৫-৭ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন (IOM, 2023)।
অভিবাসনের গন্তব্য:
- নগরীর বস্তি: ঢাকা, চট্টগ্রামে ৬০% বস্তিবাসী জলবায়ু কারণে স্থানান্তরিত।
- ভাসমান জীবন: হাওর ও নদীভাঙন এলাকায় মানুষ বানানো ভেলায় বসবাস করছে।
- প্রান্তিক পেশা: দিনমজুর, রিকশাচালক, ইটভাটার শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন।
কুড়িগ্রামের রোকেয়ার গল্প: “ব্রহ্মপুত্র নদ ভাঙন দিয়ে ঘর গেল ২০২১ সালে। স্বামী নৌকায় চড়ে কাজ খোঁজে। আমরা খোলা আকাশের নিচে থাকি। মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করাতে পারিনি।”
বাংলাদেশের অভিযোজন ও সংগ্রাম: হতাশার মাঝে আশার আলো
জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে রোল মডেল। সরকারি ও বেসরকারি স্তরে চলছে নানা অভিযোজন প্রকল্প।
সরকারি উদ্যোগ:
- মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান (MCPP): ২১০০ সাল পর্যন্ত টেকসই পরিকল্পনা, বিনিয়োগ $২৩০ বিলিয়ন।
- জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড: ২০০৯ সাল থেকে ৫০০+ প্রকল্পে বরাদ্দ ৪৮০ মিলিয়ন ডলার।
- সাইক্লোন শেল্টার: উপকূলে ১৪,০০০+ আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, যা ৫০ লাখ মানুষকে রক্ষা করে।
স্থানীয় উদ্ভাবন:
- লবণাক্ততা সহিষ্ণু ধান: ব্রি ধান-৯৭, ১০-১২ ডিএস/মি লবণাক্ততায় চাষযোগ্য।
- ভাসমান কৃষি: গোপালগঞ্জের বেডে কচুরিপানা দিয়ে তৈরি ভাসমান সবজি খামার।
- ঘূর্ণিঝড়-প্রতিরোধী ঘর: খুলনায় ইটের ভিতের উপর টিনের ঘর, বন্যার পানি ঢুকতে পারে না।
সুন্দরবনের সংগ্রাম: শাকিলা আক্তার, শ্যামনগরের একজন নারী। লবণাক্ত জমিতে কেওড়া গাছ লাগিয়ে মধু সংগ্রহ করেন। “গাছ আমাদের রক্ষাকর্তা। এগুলো ঝড় ঠেকায়, মৌমাছি দেয়, আয়ও হয়।”
ভবিষ্যতের পথ: বৈশ্বিক দায়িত্ব ও স্থানীয় প্রতিশ্রুতি
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় শুধু বাংলাদেশের প্রচেষ্টাই যথেষ্ট নয়। উন্নত দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণ কমানো, আর্থিক সাহায্য, ও প্রযুক্তি হস্তান্তর জরুরি।
- COP27-এ ক্ষতিপূরণ তহবিল: বাংলাদেশের তত্ত্বাবধানে Loss & Damage Fund গঠন ঐতিহাসিক অর্জন।
- সবুজ শিল্পায়ন: নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়িয়ে ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০% শক্তি উৎপাদনের লক্ষ্য।
- যুব শক্তির অংশগ্রহণ: জলবায়ু কর্মী নেটওয়ার্কের ১০,০০০+ স্বেচ্ছাসেবক তৃণমূলে সচেতনতা ছড়াচ্ছে।
ড. সালিমুল হকের আহ্বান: “জলবায়ু ন্যায়বিচার ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা বিশ্বকে শেখাতে পারে কীভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাঝেও আশা জাগিয়ে রাখা যায়।”
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব শুধু পরিসংখ্যান বা রিপোর্টের বিষয় নয়— এটা সালমার খালি কলসি, রহিমুলের ছিন্ন সংসার, রোকেয়ার ভাঙা ঘরের গল্প। বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের এই সংগ্রামে আমরা সবাই অংশীদার। সরকারি নীতির পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্যোগও জরুরি: একটি গাছ লাগানো, পানি সাশ্রয়, প্লাস্টিক ব্যবহার কমানো— ছোট পদক্ষেপই বদলে দিতে পারে ভবিষ্যৎ। আসুন, আজই শপথ নেই: আমরা আমাদের সন্তানদের জন্য একটি নিরাপদ, সবুজ বাংলাদেশ গড়ে তুলব। সময় ফুরিয়ে আসছে— কাজ শুরু হোক এখনই!
জেনে রাখুন
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল কোনগুলি?
উপকূলীয় জেলা (সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট), হাওর অঞ্চল (সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ), এবং উত্তরাঞ্চল (রাজশাহী, নওগাঁ) সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা, বন্যা ও খরা এসব এলাকার জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করছে।
জলবায়ু উদ্বাস্তু কী? বাংলাদেশে তাদের সংখ্যা কত?
যারা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়, তারাই জলবায়ু উদ্বাস্তু। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (IOM)-র মতে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৪০ লাখ জলবায়ু উদ্বাস্তু রয়েছেন। প্রতি বছর ৫-৭ লাখ মানুষ নতুন করে বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন।
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কী কী জাতীয় পদক্ষেপ নিয়েছে?
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও অ্যাকশন প্ল্যান (BCCSAP), মুজিব ক্লাইমেট প্রসপেরিটি প্ল্যান, জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড গঠন, ৬,৫০০+ সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ, এবং লবণাক্ততা-সহিষ্ণু ফসলের গবেষণা প্রধান জাতীয় উদ্যোগ। এছাড়া ২০০৯ সাল থেকে নিজস্ব তহবিলে অভিযোজন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
লবণাক্ত পানির সমস্যা সমাধানে কী করা যেতে পারে?
বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ (রেইনওয়াটার হার্ভেস্টিং), ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার কমানো, লবণাক্ততা-সহিষ্ণু ধান (ব্রি ধান-৯৭, ৯৯) ও সবজি চাষ, এবং পুকুরে প্লাস্টিক লাইনার ব্যবহার করে লবণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। পাশাপাশি সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনায়ন লবণাক্ততা রোধে সহায়ক।
আমরা ব্যক্তিগতভাবে কীভাবে অবদান রাখতে পারি?
গাছ লাগানো, প্লাস্টিক ব্যবহার কমানো, পানি ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত খাবার কেনা, এবং পরিবেশবান্ধব যানবাহন ব্যবহারের মাধ্যমে কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমানো যায়। জলবায়ু সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে সামাজিক মাধ্যমও ব্যবহার করা যেতে পারে।
জলবায়ু অর্থায়নে বাংলাদেশ কী পাচ্ছে?
গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড (GCF), বিশ্বব্যাংক, এবং উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে বাংলাদেশ জলবায়ু তহবিল পায়। তবে প্রতিশ্রুত $১০০ বিলিয়নের মাত্র ২০% বাস্তবায়িত হয়েছে। ২০২৩ সালে Loss & Damage Fund চালু হলে আরও সহায়তা পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।