জুমবাংলা ডেস্ক : জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) বিদ্যমান বয়সের হিসেব অনুযায়ী এক বছর বয়সে বাবা হয়েছেন মো. আব্দুল হামিদ নামে এক ব্যক্তি। মূলত এনআইডি সংশোধন আবেদনের ৭ বছর অতিবাহিত হলেও কাঙ্ক্ষিত সংশোধন না মেলায় আব্দুল হামিদের বড় মেয়ের সঙ্গে তার বয়সের পার্থক্য দাঁড়িয়েছে এক বছর। সে হিসেবে মাত্র ১ বছর বয়সেই বাবা হয়েছেন তিনি!
ভুক্তভোগীর ছোট ছেলে হৃদয় বলেন, ২০১৭ সালে আমার বাবা জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনের আবেদন করলেও দীর্ঘদিন নির্বাচন অফিসে যোগাযোগ করার পরও কোনো সমাধান পাইনি। যখনই নির্বাচন অফিসে গিয়েছি, সেখান থেকে বলা হয়েছে- সময় লাগবে। কিন্তু সেই সময় যে এতো দীর্ঘ হবে সেটা জানা ছিল না।
হৃদয় বলেন, ‘আমার বাবার বয়স হয়েছে, তিনি অসুস্থ। তার পেনশনও আটকা পড়ে আছে। এমন অবস্থায় জানতে পারলাম, বাবার এনআইডি সংশোধনের আবেদনটি বাতিল করা হয়েছে। সব কিছু ঠিক থাকার পরেও কোন যুক্তিতে আবেদনটি বাতিল করা হলো সেটাও জানি না।
এই যুবক আরও বলেন, আমরা তিন ভাই-বোন। আমার বড় বোন নাহিদা আক্তার দিপার এনআইডিতে জন্ম সাল ১৯৮৮। আর বাবার এনআইডিতে জন্ম সাল ১৯৮৭। এটা তো ভুল, সেটা দেখেই বোঝা যায়। তারপরও বাবার অনলাইন জন্ম সনদ, এসএসসি পাশের শিক্ষা সনদ, যেখানে চাকুরিরত ছিলেন সেখানকার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার প্রত্যয়নপত্রসহ যাবতীয় সকল কাগজপত্র জমা দিয়েছিলাম। তবুও সাত বছর পর সংশোধনের আবেদনটি বাতিল করা হলো।
বিগত বছরগুলোতে নির্বাচন অফিসে গিয়েও হয়রানির শিকার হয়েছেন, উল্লেখ করে হৃদয় বলেন- ‘এই ৭ বছরে বেশ কয়েকবার নির্বাচন অফিসে সংশোধনের বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়েও কোনো সমাধান পাইনি। বরং কর্মকর্তাদের বাজে ব্যবহারের শিকার হয়েছি। এসব হয়রানি বন্ধ হওয়া উচিত।’
মো. আব্দুল হামিদের জাতীয় পরিচয়পত্র পর্যালোচনা করে জানা যায়, তিনি ২০১৭ সালের মে মাসে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সংশোধনের আবেদন করেন। এক বছর পর ২০১৮ সালে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালকের দপ্তর থেকে সংশোধনের জন্য তদন্তে প্রেরণ করলে তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা জন্ম তারিখ সংশোধনযোগ্য তদন্ত প্রতিবেদন প্রেরণ করেন।
তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, এনআইডিতে উল্লিখিত আবেদনকারীর জন্ম তারিখ ০৮/০৭/১৯৮৭। আবেদনকারীকে দেখেই বোঝা যায়, তার এই জন্ম তারিখ ভুল। কারণ তিনি একজন বয়স্ক মানুষ। তার চাকুরির যোগদানপত্র হতে দেখা যায়, তিনি ১৯৭৮ সালে চাকুরিতে যোগদান করেছেন। তার বড় মেয়ের এসএসসি পাশের সনদপত্র অনুযায়ী জন্ম তারিখ ১৬/১২/১৯৮৮। আব্দুল হামিদের চাকুরিতে যোগদানের সাল এবং মেয়ের জন্ম সাল থেকেই বোঝা যায় আবেদনকারীর জন্মসাল ১৯৮৭ এর বহু পূর্বে। জন্মতারিখ সংশোধনের জন্য তিনি যে অনলাইন জন্ম নিবন্ধন সনদপত্র দাখিল করেছেন সেখানে তার জন্ম তারিখ ০৯/১১/১৯৫৮ উল্লেখ করা হয়েছে। ফরওয়ার্ডিং লেটারসহ পঞ্চগড় সুগার মিলস্ লিমিটেড এর মহাব্যবস্থাপক এর প্রত্যয়নপত্রে আবেদনকারীর সঠিক জন্ম তারিখ ০৯/১১/১৯৫৮ বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন এবং এনআইডিতে উল্লিখিত তার জন্ম তারিখ সংশোধন করার জন্য সুপারিশসহ প্রত্যয়নপত্র প্রদান করেছেন। আবেদনকারী এসএসসি পাশ। তাকে এসএসসি পাশের সনদপত্র দাখিল করতে বলা হয়েছিল। তিনি জানিয়েছিলেন, তার এসএসসি সনদপত্র হারিয়ে গেছে। যে কারণে পরবর্তীতে তিনি রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড থেকে তার ডুপ্লিকেট সনদপত্র উঠিয়েছেন। উক্ত সনদপত্র হতে দেখা যায়, তিনি ১৯৭৩ সালে এসএসসি পাশ করেছেন। আবেদনকারীর চেহারা এসএসসি পাশের বছর, চাকুরিতে যোগদানের বছর, মেয়ের জন্ম সাল থেকে অনুমান করা যায় তার জন্ম তারিখ ০৯/১১/১৯৫৮ হওয়াটা স্বাভাবিক।
তদন্ত প্রতিবেদন প্রেরণ করার তিন বছর পর ২০২১ সালে ফের সচল হয় এনআইডি সংশোধনের এ আবেদনটি। নথি তোলা হয় এনআইডি’র মহাপরিচালক বরাবর। যেখানে কর্মকর্তা বলেছেন, আবেদনকারী তার বয়স প্রায় ২৯ বছর বাড়ানোর আবেদন করেছেন। দাখিলকৃত দলিলাদি যাচাই করে দেখা যায়, আবেদনকারী ১৯৭৩ সালে রাজশাহী বোর্ড থেকে এসএসসি পাশ করেন এবং তিনি পঞ্চগড় সুগার মিলে কর্মরত আছেন। তার এসএসসি সনদ, চাকুরির প্রত্যয়ন ও অনলাইন জন্মসনদের সাথে চাহিত তথ্যের মিল রয়েছে। আবেদনকারী বড় সন্তানের জন্মসাল ১৯৮৮, সে অনুযায়ী পিতার বিদ্যমান জন্মসাল ১৯৮৭ অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এছাড়াও আবেদনকারীর বাহ্যিক অবয়বের সাথে চাহিত জন্মতারিখ সঠিক রয়েছে মর্মে প্রতীয়মান হয়।
উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাও ঠিক একই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। যেখানে আব্দুল হামিদের জন্ম সাল ১৯৮৭ নয় বলেই দাবি করেন।
এরপর ২০১৮ সালে তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত প্রতিবেদনে বলেন, আবেদনকারী এসএসসি পাশ। তাকে এসএসসি পাশের সনদপত্র দাখিল করতে বলা হয়েছিল। তিনি জানিয়েছিলেন তার এসএসসি সনদপত্র হারিয়ে গেছে। পরবর্তীতে তিনি রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড থেকে তার ডুপ্লিকেট সনদপত্র উঠিয়েছেন। উক্ত সনদপত্র হতে দেখা যায়, তিনি ১৯৭৩ সালে এসএসসি পাশ করেছেন। তার দাখিলকৃত মাধ্যমিক (এসএসসি) শিক্ষা সনদ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সেখানে (শিক্ষা সনদ) রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের স্বাক্ষর ও সীল রয়েছে যা ২০১৮ সালে করা হয়েছে। ২০১৮ সালে উত্তোলন করা শিক্ষা সনদ তিন বছর পর ২০২১ সালে এসে ইসির জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগ ফের যাচাই করা প্রয়োজন বলে এনআইডি সংশোধনের আবেদনটি আবার ঝুলে যায়। যা ২০২৪ সালে এসে বাতিল হয়েই যায়।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসির এক কর্মকর্তা বলেন, আব্দুল হামিদের জাতীয় পরিচয়পত্র দীর্ঘদিন ফেলে রাখার কোনো কারণ দেখছি না। খালি চোখে দেখে বুঝা যায় এটা করণীকভুল। যেহেতু আবেদনটি বাতিল হয়েছে সেহেতু নতুন করে আবার আবেদন করলে এ এনআইডিটি সংশোধন হয়ে যাবে বলে আমি আশাবাদী।
এদিকে জাতীয় পরিচয়পত্রে সকল কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আনতে ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশনের প্রশাসনিক ১০ অঞ্চলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব শফিউল আজিম।
যেখানে কর্মকর্তাদের সেবা প্রার্থীদেরকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। শফিউল আজম বলেন, ‘প্রত্যেকটি অফিসকে সেবাকেন্দ্র বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশে বসবাসকারী এবং প্রবাসী নতুন ভোটার নিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন, ভোটার স্থানান্তরসহ সকল কাজে সেবা প্রার্থীদেরকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সেবা প্রদান করতে হবে। কোনো সেবা প্রার্থী যেন হয়রানির শিকার না হয় এবং কোনো দালাল যেন সুযোগ না পায় সেজন্য প্রত্যেকটি অফিসের নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষকে ক্লোজ মনিটরিং করতে হবে। জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাসহ সেবাগ্রহিতার সন্তুষ্টি অর্জন ও দুর্নীতিমুক্ত সেবা প্রদানে সকলকে সর্বদা সচেষ্ট থাকতে হবে।’
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম ব্যতীত অন্যান্য অঞ্চলের নাগরিকদের এনআইডি সেবা আরও সহজ হচ্ছে। মূলত সময় কমছে। কেননা এখন থেকে সমতলের কেউ নতুন ভোটার হতে এলে আঙুলের ছাপ রোহিঙ্গা ডাটাবেজের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হবে না। এতে সময় কম লাগবে। আগে কেউ আবেদন করলে আগে তার আঙুলের ছাপ ১০ লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হতো। এখন এ ব্যবস্থা কেবল চট্টগ্রাম অঞ্চলের নতুন ভোটারদের ক্ষেত্রে বলবৎ থাকবে।
দীর্ঘদিন ধরে আবেদন ঝুলে থাকার বিষয়ে ইসি সচিব শফিউল আজিম বলেন, ‘আমরা তাদের নির্দেশনা দিয়েছি। এছাড়া স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) যদি পরিবর্তন করতে হয়, আমরা সেটাও করবো। এখন এনআইডি আবেদন তো ফেলে রাখার সুযোগ নেই। আমরা যেভাবে অঞ্চলভেদে বৈঠক করছি এটা তো আগে সেভাবে হয়নি। দুর্নীতির পথটা বন্ধ করি আগে। আমি তো এখানে বসে দেখতে পারছি, তার ওখানে কয়টা ঝুলে আছে। আমরা এখন সবগুলো টাইমলাইন করে দিচ্ছি। নির্ধারিত তারিখ করে দিচ্ছি, যে এতদিনের মধ্যে অবশ্যই নিষ্পত্তি করতে হবে। জেলা এবং উপজেলায় কোনো সেবার ক্ষেত্রে কতদিন লাগবে আমরা সেটা ফ্রিক্সড করে দেব। যাতে বছরের পর বছর ফেলে রাখতে না পারে।;
তিনি আরও বলেন, ‘সবাই তো আর খারাপ না। ১০ আঞ্চলিক কর্মকর্তার মধ্যে যদি দুইজন ভালো না হয়, তাহলে তো সে নিজেই নিজের প্যাঁচে পড়বে। মানুষকে কোনো হয়রানি ছাড়া নির্বিঘ্নে সেবা দিতে হবে। ২০১৫ সাল থেকে যে আবেদন পড়ে আছে, সেটা যদি আমরা আগেই বলে দেই যে, ওটা দেওয়ার সুযোগ নাই। তাহলেও অনেক আবেদন নিষ্পত্তি হয়।
’ইসি সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে সংশোধনের তিন লাখ ৮৫ হাজার ৭৭ হাজার আবেদন অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে ক ক্যাটাগরি পাঁচ হাজার ৮৬৩ টি, ক-১ ক্যাটাগরির ৪৬১টি, খ ক্যাটাগরিতে আছে ৫৩ হাজার ২৫৪টি, খ-১ ক্যাটাগরিতে আছে পাঁচ হাজার ২৭৬টি, গ ক্যাটাগরির এক লাখ ৬৩ হাজার ৬৪৯টি, গ-১ ক্যাটাগরির ৮২৮টি ও ঘ ক্যাটাগরির ১০ হাজার ৪৭১টি আবেদন ঝুলে আছে। এছাড়া ক্যাটাগরি করা হয়নি, এমন আবেদনের সংখ্যা ২৮ হাজার ৪৯২টি।
ক ক্যাটাগরির আবেদন নিষ্পত্তি করেন থানা বা উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, ক-১ ক্যাটাগরি নিষ্পত্তি করেন সহকারী থানা বা উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, খ ক্যাটাগরির আবেদন নিষ্পত্তি করে থাকেন জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, খ-১ ক্যাটাগরির আবেদন নিষ্পত্তি করে থাকেন অতিরিক্ত জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা।
এছাড়া গ ও গ-১ ক্যাটাগরির আবেদন নিষ্পত্তি করে থাকেন আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা। ঘ ক্যাটাগরির আবেদন নিষ্পত্তির এখতিয়ার এনআইডি মহাপরিচালকের।
এদিকে সেন্ড ব্যাক টু সিটিজেন ক্যাটাগরিতে আছে ঝুলে আছে ১৪ হাজার ৫০০টি আবেদন, তদন্তাধীন আছে ৬১ হাজার ৭৩টি আবেদন, শুনানীর অপেক্ষায় আছে ৯ হাজার ৬৯৫টি আবেদন এবং অতিরিক্ত দলিলাদি প্রয়োজন এমন আবেদনের সংখ্যা ২৩ হাজার ৬৬০টি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।