সোমবার রাতে সীমান্তে টহলদারির সময় ভারত ও চীনের সেনাদের মধ্যে কোন গুলি বিনিময় হয়নি। হাতাহাতি সংঘর্ষেই ২৩ ভারতীয় ও ৫ চীনা সেনার মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় আগামীকাল সর্বদলীয় বৈঠকে বসবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি গতকাল বলেছেন, ভারতীয় সেনাদের বলিদান বৃথা যাবে না। ভারত শান্তি চায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, তবে কেউ প্ররোচনা দিলে জবাব দিতে প্রস্তুত। গতকাল রাষ্ট্রীয়ভাবে কোন বিবৃতি না দেয়া হলেও নিহত সৈন্যদের পরিবারের প্রতি শোক জানিয়েছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। চীনের সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে ভারতস্কে কোন প্রকার উস্কানি না দেবার আহ্বান জানানো হয়েছে। এদিকে, পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছে বলে বিবৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। পাশপাশি দুই দেশের প্রতি সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ।
গালওয়ানে সংঘর্ষের পরে সীমান্তে উত্তেজনা কমানোর লক্ষ্যে সক্রিয় নয়াদিল্লি ও বেজিং। চলছে ক‚টনৈতিক ও সেনা স্তরে আলোচনার মাধ্যমে বোঝাপড়ায় আসার তৎপরতা। বুধবার বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর টেলিফোনে কথা হয়েছে। নিরপেক্ষভাবেই দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী পূর্ব-লাদাখের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেছেন। আলোচনা এবং ঐকমত্যের ভিত্তিতে সীমান্ত সমস্যা মেটানোর বিষয়ে তারা সম্মত হয়েছেন’।
চীন-ভারতের মাঝে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় অনেকবার সংঘর্ষ হলেও বস্তত ১৯৮৪ সালের পর আর গুলি বিনিময় হয়নি। ওয়েস্টার্ন সেক্টর তথা লাদাখে দুই দেশের সেনাদের মধ্যে গত কয়েক বছরে অনেকবার হাতাহাতি হয়েছে। এতে আহত হলেও কোন দেশের সেনা সদস্যের প্রাণহানি ঘটেনি। গুলি চলেনি কোনও বারই। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সূত্রে বলা হচ্ছে, সোমবার রাতে সীমান্তে টহলদারির সময় দুই দেশের সেনার মধ্যে যে মুখোমুখি সঙ্ঘাত হয়েছে তাতে গুলি চলেনি। ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক কর্নেলসহ ২৩ সেনা সদস্যের যে মৃত্যু হয়েছে, তা গুলিতে বা বিস্ফোরণের কারণে নয়। লোহার রড, পাথর দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। বলা যেতে পারে, প্রথমে দু’পক্ষে হাতাহাতি হয়। তারপর তা প্রাণঘাতী মারামারির পর্যায়ে পৌঁছে। চীনা সেনা লোহার রড, লাঠি, পাথর নিয়ে মারামারি করে। প্রত্যাঘাতে ভারতীয় সেনাও সেই হাতিয়ারই ব্যবহার করেছে বলে খবর। তাতে চীনের ৫ জন সেনা সদস্যের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছে আরও ১১ জন।
ভারতকে গালওয়ান সীমান্তে সব ধরনের উসকানিম‚লক তৎপরতা বন্ধ করার জন্য হুঁশিয়ারি দিয়েছে চীনা সেনাবাহিনী। একইসঙ্গে দু’দেশের মধ্যকার বিতর্কিত বিষয়গুলো আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার লক্ষ্যে নয়াদিল্লিকে সঠিক পথে ফিরে আসারও আহ্বান জানিয়েছে। চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির পশ্চিম কমান্ডের মুখপাত্র সিনিয়র কর্নেল ঝাং শুয়িলি বলেছেন, ‘গত সোমবার রাতে ভারতীয় সেনারা দু’দেশের সীমান্তবর্তী গালওয়ান উপত্যকা অঞ্চল দিয়ে নিয়ন্ত্রণ রেখা অতিক্রম করার মাধ্যমে নিজেদের প্রতিশ্রুতি চরমভাবে লঙ্ঘন করে। যার ফলে দু’পক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী শারীরিক সংঘাত ও হতাহতের ঘটনা ঘটে’।
ঝাং গত মঙ্গলবার রাতে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে আরো বলেন, ভারত ও চীনের শীর্ষস্থানীয় সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈঠকে যে সমঝোতা হয়েছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী তা মারাত্মকভাবে লঙ্ঘন করেছে। তিনি দাবি করেন, গালওয়ান উপত্যকা সব সময় চীনের মালিকানায় ছিল এবং ভারতের এ পদক্ষেপ ছিল দ্বিপক্ষীয় সামরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মারাত্মক ক্ষতিকর।
ভারতীয় সেনা সূত্র জানায়, ক‚টনৈতিক বোঝাপড়া অনুযায়ী লাদাখে দুই দেশের সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল স্তরে আলোচনা চলছিল। তাতে স্থির হয়েছিল, গালওয়ান উপত্যকায় চীনা সেনা যেখানে তাঁবু গেড়েছে সেখান থেকে তা তুলে নিতে হবে। কিন্তু সেই শর্ত পালনের আগেই পারস্পরিক কথা কাটাকাটি থেকে ঝামেলা শুরু হয়। তারপর ক্রমশই তীব্রতা বাড়তে থাকে। সেনা সূত্রে বলা হচ্ছে, পিএলএ সেনারা লোহার রড, পাথর নিয়ে প্রস্তুত হয়েই এসেছিল ঝগড়া বাধাতে। বিতন্ডার পর তারাই প্রথম লোহার রড ও পাথর দিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ওই কর্নেলকে আঘাত করে। তখনই প্রত্যাঘাত করেন ভারতীয় সেনা সেনারা। কিন্তু তারাও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেননি। দফায় দফায় কয়েক ঘটনা ধরে এই সঙ্ঘাত চলতে থাকে। মাঝরাতে দুই দেশের শীর্ষ সেনা অফিসারদের হস্তক্ষেপে তা থামানো হয়।
পরে গতকাল সকাল থেকে উত্তেজনা প্রশমনের জন্য দুই দেশের সেনা কর্তাস্তরে আলোচনা শুরু হয়েছে। গালওয়ান নদী উপত্যকা অঞ্চলের ১৪ নম্বর টহলদারী পয়েন্টে তা চলেছে। তবে সূত্রের মতে, সীমান্তে এখনও প্রবল উত্তেজনা রয়েছে। এতোটাই যে, সেখানে আলোচনার জন্য যে পদস্থ সেনা কর্মকর্তারা গিয়েছেন, তাদের নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বেগে রয়েছে নয়াদিল্লি।
লাদাখে বিপুল সংখ্যক সেনার মৃত্যুতে প্রথমবারের মতো মুখ খুলে প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেছেন, ‘সেনা জওয়ানদের বলিদান বৃথা যাবে না। গতকাল বুধবার এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে মোদি বলেন, ‘ভারত শান্তি চায়। কিন্তু কেউ প্ররোচনা দিলে যে কোনো পরিস্থিতিতে তার উপযুক্ত জবাব দিতেও প্রস্তুত’। গতকাল করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। তার আগে এই বক্তব্য পেশ করেন তিনি।
এদিকে ভারত-চীন সীমান্ত পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে সর্বদলীয় বৈঠক ডেকেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আগামীকাল শুক্রবার বিকেল পাঁচটায় এই বৈঠক ডাকা হয়েছে। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এই বৈঠক হবে বলে প্রধানমন্ত্রীর দফতর সূত্রে খবর। কংগ্রেসসহ সব বিরোধী দলকেই আমন্ত্রণ জানানো হবে বৈঠকে।
ওদিকে সংঘর্ষ শুরুর পর থেকেই নয়াদিল্লিতে চূড়ান্ত তৎপরতা শুরু হয়। শীর্ষ সামরিক কর্তা ও মন্ত্রীদের বৈঠক হয়েছে। তবে সরকারিভাবে কোনও বিবৃতি দেননি কোনও মন্ত্রী। গতকাল প্রথম মুখ খোলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী। নিহত সেনাদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান রাজনাথ সিংহ। ‘জওয়ানদের এই বলিদান দেশ ভুলবে না’ বলেও টুইটারে লিখেন তিনি। তিনি লিখেছেন, ‘গালওয়ানে সেনা সদস্যদের মৃত্যু গভীর পীড়া ও বেদনাদায়ক। কর্তব্যে গিয়ে ভারতীয় সেনার ঐতিহ্য মতোই আমাদের সেনা নজিরবিহীন সাহসিকতা ও শৌর্যের পরিচয় দিয়েছে।’ নিহত সেনাদের শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘এই সেনা সদস্যরা সাহসিকতা ও বলিদান দেশ কখনও ভুলবে না। তাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা।’
অন্যদিকে, লাদাখে ভারত-চীন সঙ্ঘাতের পরে পরিস্থিতির দিকে কড়া নজর রাখছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মঙ্গলবার গালওয়ান উপত্যকায় দুই পক্ষের একাধিক সেনা হতাহত হওয়ার পরেই হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে একথা জানানো হয়। দুই দেশের মধ্যে সমস্যা দ্রুতই শান্তিপূর্ণভাবে মিটবে বলে বিবৃতিতে আশা প্রকাশ করা হয়। হোয়াইট হাউসের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গতকাল ভারতীয় সেনা বাহিনীর নিহত সদস্যদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। তিনি বলেন, ‘লাদাখ সীমান্তে উত্তেজনা কমাতে ভারত-চীন উভয়পক্ষই তৎপর হয়েছে। আমরা বর্তমান পরিস্থিতির শান্তিপূর্ণ সমাধান আশা করছি। আমেরিকা এই পরিস্থিতির উপর নজর রাখছে। পরিস্থিতি যাতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়, সেই চেষ্টা করা হবে মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে।’
পাশাপাশি, উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ায় চীন ও ভারতকে ‘সর্বাধিক সংযম’ বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের মুখপাত্র এরি কানেকো এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আমরা ভারত ও চীনের মধ্যে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় সহিংসতা ও মৃত্যুর খবর নিয়ে উদ্বিগ্ন।’ তিনি বলেন, ‘দুই দেশই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও উত্তেজনা প্রশমনে কাজ করবে বলে আমরা আশা করছি।’
এদিকে চাইনিজ আর্মির ওয়েস্টার্ন থিয়েটার কম্যান্ডের মতে, ভারত-চীন সীমান্ত সঙ্ঘাতে ভারত দায়ী। তিনি জানিয়েছেন, ‘গালওয়ান ভ্যালি চীনের, সবসময় চীনই দায়িত্ব পালন করেছে।’ ইতিমধ্যে ভারতীয় সেনার তরফে দেয়া বিবৃতিতে উল্লেখ রয়েছে যে, চীনের সেনার আঘাতেই নিহত হয়েছে ভারতীয় সেনা। এরপরেই ভারতের বিরুদ্ধে পালটা অভিযোগ তুলছে চীন। সূত্র : ভয়েস অব আমেরিকা, দ্য হিন্দু, ডেইলি মেইল, দ্য ওয়াল।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।