জাহিদ আল আমিন: জার্মানির ঋতুতে বসন্ত ( Frühling) এসেছে। কোকিলের কুহু সুর নেই!, নেই শিমূল, পলাশ, কৃষ্ণচুড়ার লালে লাল দুনিয়া। তবুও ভিন্ন এক প্রাকৃতিক রূপের মাদকতা নিয়ে এখানে বসন্ত হাজির হয়। শীতের জড়াগ্রস্থ জীবনের খোলস ছেড়ে প্রকৃতি যেন নতুন সাজে নিজেকে সাজাতে শুরু করে। গাছে গাছে সবুজ পাতার প্রাণোৎসব। বাহারী ফুলের সমাহার, সৌরভ, সৌন্দর্য্য। শীত মৌসূমে দূরদেশ-দেশান্তরে অতিথি হিসেবে বেড়াতে যাওয়া পাখীরা ফিরে আসছে। সকাল-সাঝে এদের কলকাকলীতে পাড়া-গ্রাম জমজমাট। প্রকৃতির এই পালাবদলের মাঝে কোথায় যেন বিষাদের ছায়া! এক টুকরো কালো মেঘ ক্ষণে ক্ষণে উঁকি দিচ্ছে । ঈষাণ কোণে কালবোশেখি ঝড়ের আলামত।
গেল বছরের ডিসেম্বরে যখন চীনের উহানে এই মহামারী শুরু হয়েছিলো, তখন নিরাপদ দূরত্বে থাকা বেশিরভাগ মানুষই এটাকে চিনের সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করতো। খোদ জার্মানিতেও একাধিক চায়নীজ শিক্ষার্থী করোনা সন্দেহে হামলার শিকার হয়েছে। দেখতে দেখতে সেই বালাই এখন তাদের ঘাড়ের উপর এসে বসেছে। যেসব দেশ নিজেদের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে মনে মনে বড়াই করতো। সেবা সূচকে সর্বোন্নত সেই দেশগুলোও এখন বেসামাল, দিশেহারা, থরহরিকম্পমান অবস্থা।
কোন জাত-পাত, জাতি-রাষ্ট্র, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে জনে জনে, ঘরে ঘরে হানা দিতে শুরু করেছে মহামারীটি। যেন সাক্ষাৎ এক জমদূত!
প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে সেই দুর্গোগের কবল থেকে নিজেও বাদ পড়লাম না। সেই ঝড়ের শিকার কীনা জানি না, তবে গত ১০ দিন অসুস্থ শরীরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মনে হলো যেন কতো কিছু অর্জন করেছি। সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি আত্নোপলব্ধি। নিজের বুঝ।
ফিউচার প্ল্যানের অংশ হিসেবেই বর্তমান জবটি থেকে ইস্তফা দিয়েছিলাম। চাকুরি বিধি অনুযায়ী আগামী ৩১ মার্চ, ২০২০ আমার শেষ কর্মদিবস ছিলো। সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলছিলো। বিপত্তি ঘটলো গত ১০মার্চ। দুপুরে কর্মস্থলে যাবার পথে মাথার উপর দিয়ে কয়েক পশলা শিলা বৃষ্টি ঝরে গেলো। কাজ সেরে ফেরার পথে আকাশ-পাতাল জ্বর। সঙ্গে ব্রঙ্কাইটিস রোগীদের মতো কাশি। কাঁপতে কাঁপতে ঘরের দরজায় এলাম। হটাৎ মনে প্রশ্ন এলো করোনা নয়তো! বাড়ির অন্য সদস্যদেরকে বিপদে ফেলছি না তো!
শহরতলীতে একটা বড়সড় বাগানবাড়িতে থাকি। পাঁচজনের পরিবার। খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে সবকিছু মিলে মিশে একান্নবর্তী পরিবার।
জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে ঘরের বাহির থেকেই গৃহকর্তাকে ফোন দিলাম। জানালাম শরীরের লক্ষণগুলো।
জ্বর, শুকনো কাশি, সারা শরীর ব্যথা, প্রচন্ড মাথাও ব্যথা। তবে নি:শ্বাস নিতে কোন কষ্ট হচ্ছে না। দায়িত্ববান জার্মান গৃহকর্তা মাস্ক দিলেন, হ্যান্ড গ্লাভস দিলেন। স্যানিটাইশেন এর বোতল দরজার গায়ে ঝুলানোই ছিলো। কোথাও কিছু স্পর্শ না করে সোজা নিজের ঘরে এলাম। সঙ্গেই বাথরুম, টয়লেট আছে। রাতে পরিবারের সকলে মিলে হোয়াটসএপে জরুরি মিটিংয়ে বসলাম। নিজেদের অতি প্রয়োজনের একটি তালিকা তৈরি করে দিলাম। তবে কোথাও কোন আতংক ছড়াবো না, প্রয়োজনের বাড়তি কিছু ঘরে মজুদ করবোনা, অসুস্থতার তথ্য স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করবোনা, নীতিগতভাবে সবাই সম্মত হলাম। যেকোন পরিস্থিতিতে একজন অন্যের কাছে ছেড়ে যাবো না, এমন চাওয়াতেও সবাই একমত হলাম।
তবে স্বাস্থ্য সুরক্ষার খাতিরে বাড়ির লোকদের আমার আশেপাশে দিয়ে যাতায়ত নিয়ন্ত্রিত করা হলো। আমার খাবার, পানি ইত্যাদির দায়িত্ব স্বেচ্ছায় একজন নিলো। ডাক্তার, ওষুধ, চিকিৎসার ভার পড়ল অন্য একজনের উপর। বাকীরা যার যার সাধ্যমতো এন্টারটেইন করে গেলো।
দিনের পর দিন সময়গুলো বদ্ধ একটা ঘরে কাটানোও মুশকিল। নামাজ, কুরআন শোনা আর দোয়া ও ইস্তিগফার এই সময়ের সবচেয়ে বড় রক্ষা কবচ।
এরই মধ্যে কাশির দমকে ঘরবাড়ি ভূমিকম্পের মতো একেকবার কেঁপে ওঠে। জ্বরের ঘোরে ঘুমে-জাগরণে পড়ে থাকা সময়গুলো বড় অদ্ভুত!
জ্বরাক্রান্ত ফটিকের মতো সুর করিয়া করিয়া কতো কিছুই যে মনে পড়িয়া যায়: “এক বাঁও মেলে না। দো বাঁও মেলে – এ – এ না।”
এমন ঘোরতর জ্বরের বেলায় একাকি স্মৃতিচারণই ভরসা। বিনাশ্রমে, বিনা কষ্টে অনেক বিনোদন!
ছোটবেলায় যখন টাইফয়েড হয়েছিলো, সেই সময়ের স্মৃতিগুলো মনে পড়ে যায়। কলা পাতার বিছানায় শুয়ে শুয়ে মাথায় পানি দেয়া। ঘরের কোনায় মাটির হাড়ি টানানো। সেই হাড়িতে ছোট্ট একটা ছিদ্র। টুকরা গামছার কাপড়ের পাকানো রশি বেয়ে টিপ টপ করে কপালে, মাথায় পানি পড়ছে। কিছুক্ষণ পরপর এসে দাদী দেখে যাচ্ছেন পানি শেষ হলো কী না। গায়ের ওপর বিছানো নকশী পাতলা কাঁথা।
দীর্ঘ মাথায় পানি দেয়া পর্ব শেষ হলে গা মুছিয়ে খাবারের আয়োজন। কয়েক ফোটা লেবুর রস দেয়া অখাদ্য বার্লি অথবা সাগুদানা।
যেন একেবারে জ্বর শরীর ছেড়ে পালাতো, সেদিন গুণে গুণে একমুঠো চিকন আতপ চালের ভাত আর কাঁচকলা দিয়ে শিং মাছের ঝোল। সেই মাছ, আর ঝোলের পরিমান বড়ই সীমিত। তবে অঢেল কাঁচকলার শেষ টুকরাটি পর্যন্ত শেষ করতে হতো। কোন বেলায় নিজেদের ক্ষেতে হওয়া লালশাক মেখে টকটকে লাল হয়ে যাওয়া ভাত। এরমধ্যে দু’চারটি কুচো চিংড়িও পাওয়া যেতো।
এভাবেই দিন কেটে রাত হয়। রাতে পেরিয়ে ভোর আসে। তবে ডাক্তার আর আসে না! করোনার আগমনে জার্মানির চিকিৎসা ব্যবস্থাতে বড়সড় পরিবর্তণ লক্ষ্য করা গেছে। অসুস্থ হওয়ার পরে হাউজ আর্জট (গৃহ চিকিৎসক) এর দরবারে গেলাম। চেম্বারে ঢুকেই দু’একটি জোরে শোরে কাশি দিতেই চারিদিকে আতংক ছড়িয়ে পড়লো। ডাক্তার, তার এসিষ্টেন্ট বিশেষ পোষাক-আশাক পরে দূর থেকে জ্বর পরীক্ষা করতে শুরু করলেন। কোনমতে দেখেই দুইখানা ওষুধ লিখে দরজা দেখিয়ে দিলেন। এরপরে যত জ্বরই হোক না কেন, তার চেম্বারে যেন না যাই, সেকথাও জানিয়ে দিলেন। সঙ্গে একখানা হুমকিও, কেউ যদি করোনা নিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে এসে করোনা ছড়ায়, তার বিরুদ্ধে লাখো ইউরোর জরিমানা। সবকিছু জেনে-বুঝে ঘরে এসে দরজার কপাট আবার বন্ধ করলাম। সবাইকে ছেড়ে এলেও জ্বর আমাকে ছাড়লো না। আর কাশির দমকে পাড়া উজাড় করার দশা।
পরদিন শরীর যখন ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো, বাড়ির সদস্যরা বাধ্য হয়ে এমার্জেন্সি নাম্বারে ফোন দিলো। অন্যসময় যেখানে ৮-১০ মিনিটের মধ্যে এম্বুলেন্স, ডাক্তার সদলবলে চলে আসেন, তারাই জ্বর শুনে অপরাগতা প্রকাশ করলো।
প্রতিটি শহরের জন্য করোনার চিকিৎসায় হটলাইন খোলা হয়েছে। সেই নাম্বারে কন্টিনিয়াস ফোন। ওইদিন আর কোন হটলাইনে কাউকে পাওয়া গেলো না। ৬ষ্ঠ দিন রাত সাড়ে দশটার দিকে একজন ডাক্তার রেসপন্স করলেন। ঘন্টাখানিক পরে তিনি বাসাতেও এলেন। সবাইকে অবাক করে সত্তোরোর্ধ ডাক্তার কোনরকম মাস্ক, হ্যান্ড সু ছাড়াই আমার রুমে চলে এলেন। কোন টেষ্ট ছাড়াই বুক, পিঠে টোকা মেরে তিন, চার খানা ওষুধ লিখে বিদায় হলেন।
আজ দশম দিন। শরীর যেন নিজেকে একটু একটু করে খুঁজে পেতে শুরু করেছে। ঘর থেকে একা একা বাইরে বাগানে পায়চারি করতে বের হয়েছিলাম। আপেল, নাশপাতি, চেরি, মিরাভেলা, আলু বোখারার গাছে গাছে ফুল ফুটেছে। সেই ফুলে দলে দলে মৌমাছিরা এসেছে। আকাশের কালো মেঘ সরে গিয়ে রোদেরা হাসতে শুরু করেছে। দক্ষিণ দিক থেকে মৃদুমন্দ বাসন্তী সমীরণ বইতে শুরু করছে।
প্রকৃতির এইসব আয়োজন যাদের জন্য, তারাও ধীরে ধীরে সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে, রাহমানুর রাহীমের কাছে এই মুনাজাত।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।