১ নভেম্বর, ১৯৫২। প্রশান্ত মহাসাগরের বিস্তীর্ণ জলরাশির ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে একটি এফ-৮৪ থান্ডারজেট বিমান। ককপিটে বসে আছেন ইউএস এয়ারফোর্সের তুখোড় পাইলট ক্যাপ্টেন জিমি রবিনসন। উত্তেজনায় জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন তিনি। বাইরে যতখানি দেখা যায়, চোখে পড়ে প্রশান্ত মহাসাগরের বিস্তৃত নীল জলরাশি। সে এক অপার্থিব দৃশ্য। কিন্তু সেদিকে তাকানোর বিন্দুমাত্র ফুরসত নেই রবিনসনের।
আসন্ন মিশনের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করছেন নিজেকে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘটতে যাচ্ছে ক্যারিয়ারের সবচেয়ে শ্বাসরুদ্ধকর অভিজ্ঞতা। ২৮ বছর বয়সী রবিনসনের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লিবারেটর বোমারু বিমানে ‘বোম্বার্ডলাইনার’ হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু এ মিশনের ঝুঁকির মাত্রার সঙ্গে যুদ্ধকালীন সেই সময়েরও তুলনা চলে না। কারণ, কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি এফ-৮৪ বিমান নিয়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন ভয়ংকর মাশরুম ক্লাউডের মধ্যে!
পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণস্থলে গম্বুজ—বলা ভালো, মাশরুম আকৃতির যে ধোঁয়ার কুণ্ডলী সৃষ্টি হয়, সেটাই মাশরুম ক্লাউড নামে পরিচিত। মার্কিন বিমানবাহিনী অনেকটা আকস্মিকভাবেই আবিষ্কার করে, এই ভয়ংকরদর্শন ধোঁয়ার কুণ্ডলীর ভেতর দিয়েও বিমান চালিয়ে আসা সম্ভব। ঘটনার সূত্রপাত ১৯৪৮ সালের মে মাসে। বিমানবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল পল ফকনার একটি বি-২৯ বিমান নিয়ে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণস্থল পর্যবেক্ষণ করছিলেন।
এমন সময়ে দুর্ঘটনাক্রমে তিনি মাশরুম ক্লাউডের খুব কাছে চলে যান। চ্যালেঞ্জিং কিছু ঘটনার মুখোমুখি হলেও মোটামুটি অক্ষত অবস্থায়ই দ্রুত সেখান থেকে সরে আসতে সক্ষম হন ফকনার। বিমান নিয়ে নিরাপদে ফেরেন মূল বেসে। ফিরেই গর্ব করে রিপোর্ট করেন—আমাদের কেউ মারা যায়নি, এমনকি অসুস্থও হয়নি।
সামান্য সময়ের জন্য মাশরুম ক্লাউডে প্রবেশের অভিজ্ঞতাটুকু ভীষণ উপভোগ করেছিলেন দুঃসাহসী পল ফকনার। তাই পরে আবারও এমনটা করার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে একটি বিশেষ স্কোয়াড্রন গঠনের সুপারিশ করেন তিনি। তবে এবার তিনি সেখানে যেতে চান হরেক রকম বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতিসহ যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে, যেন সঙ্গে করে নিয়ে আসা যায় ভয়ংকরদর্শন সেই মেঘের নমুনা।
মাশরুম ক্লাউডের মধ্য দিয়ে বৈজ্ঞানিক মিশন পরিচালনায় পারদর্শী পাইলট খুঁজে পাওয়া ছিল ভীষণ কঠিন এক কাজ। এমনিতে স্বাভাবিক অবস্থায়ও জেট বিমান সামলানো যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং। কোনোভাবে সামান্য মনোযোগ বিচ্যুতি হলেই কপালে লেখা হয়ে যায় নিশ্চিত মৃত্যু। অথচ ক্লাউডের ভেতর বৈজ্ঞানিক মিশন পরিচালনা করতে হলে পাইলটকে বিমান চালানোর পাশাপাশি মনোযোগ দিতে হবে একগাদা বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ও রেকর্ডিং ডিভাইসের দিকে। একই সঙ্গে নজর রাখতে হবে কয়েকটি রেডিয়েশন পরিমাপক যন্ত্রের প্যানেলে।
এগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য লিখে রাখার পাশাপাশি নিয়মিত বিরতিতে তাকে রিপোর্ট করতে হবে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থানরত বিজ্ঞানীদের কাছে। পরিষ্কার আকাশে উড়ে বেড়ানোর সময়েই এতগুলো ভিন্ন ভিন্ন ধরনের কাজ একসঙ্গে করা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার! আর পারমাণবিক বিস্ফোরণের কেন্দ্রস্থলের কাছে বিক্ষুব্ধ আকাশের সীমানায় এত সব সামলে মিশনের মূল লক্ষ্য অর্জন করা যেকোনো কম অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাসম্পন্ন পাইলটের পক্ষে একরকম অসম্ভব।
তবে তুখোড় পাইলট ক্যাপ্টেন জিমি রবিনসনের ঝুলিতে ছিল সফলভাবে এ রকম মিশন সমাপ্ত করে আসার মতো সাহস ও দক্ষতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একবার বুলগেরিয়ায় শত্রুপক্ষের ছোড়া গুলির আঘাতে তাঁর বিমান পৌঁছে গিয়েছিল ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। সেই বিমান ছেড়ে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি।
প্যারাস্যুট দিয়ে মাটিতে নামার সময়টুকুতে রবিনসন ছিলেন শান্ত ও ধীরস্থির। শূন্যে ভেসে থাকা অবস্থায়ই তিনি ম্যাপে নিজের অবস্থান দেখে নিয়েছিলেন। তারপর সিগারেট জ্বালিয়ে নিরুত্তাপভাবে অপেক্ষা করছিলেন মাটি স্পর্শ করার। রবিনসনের প্রবল মানসিক শক্তি সম্পর্কে খানিকটা আঁচ পাওয়া যায় এ ঘটনা থেকে।
১৯৫২ সালের এপ্রিলে একটা প্র্যাকটিস স্যাম্পলিং মিশন সফলভাবে শেষ করে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেকে মাশরুম ক্লাউডে ডাইভ দেওয়ার যোগ্য প্রমাণ করেন তিনি। কেউ হয়তো তখনো কল্পনা করতে পারেনি, কী নির্মম পরিণতি অপেক্ষা করছে এই সাহসী পাইলটের ভাগ্যে।
সেদিন সকাল থেকেই মিশনের জন্য প্রস্তুত হয়ে অন্য পাইলটদের সঙ্গে মূল বেসে অপেক্ষা করছিলেন ক্যাপ্টেন রবিনসন। পূর্বনির্ধারিত সময়ে বিস্ফোরণ হতেই আকাশে আবির্ভূত হয় একটি উজ্জ্বল কমলা রঙের নিখুঁত উপবৃত্তাকার আলোকচ্ছটা। জগতের সব আলোকে নিষ্প্রভ করে দিয়ে, এক দীর্ঘ দৃশ্যমান আর্তনাদ সৃষ্টি করে ক্রমে সেটি পরিণত হয়েছিল ধুলাবালি আর কোরালমিশ্রিত পরিপূর্ণ এক মাশরুম মেঘে।
বিস্ফোরণের সেই ক্লাউডের নমুনা সংগ্রহ করে আনার দুঃসাহসিক মিশনে অংশ নেয় তিনটি দল। এর প্রথমটি, রেড ফ্লাইট, বিস্ফোরণের ঠিক উনিশ মিনিট পর উড়াল দেয় আকাশে। দুটি এফ-৮৪ থান্ডারজেটের সমন্বয়ে গঠিত এ দলের নেতৃত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল ভিরগিল মিরোনি। তাঁদের গন্তব্য ছিল মেঘের চূড়া, অর্থাৎ ২৯ হাজার মিটার উচ্চতায়। কিন্তু ১৭ হাজার মিটার ওপরে উঠতেই বিমানগুলো পৌঁছে গিয়েছিল নিজেদের সামর্থ্যের শেষ বিন্দুতে।
আসলে এফ-৮৪ জেটগুলোকে সর্বোচ্চ ১২ হাজার মিটার উচ্চতা পর্যন্ত নিরাপদে ওড়ার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। তখন ভিরগিল মিরোনির সামনে কেবল একটি রাস্তাই খোলা। সেটি হলো মাশরুম ক্লাউডের স্টেম অংশের বিক্ষিপ্ত ধুলাবালি আর ভয়ংকর এলোমেলো টার্বুলেন্ট বায়ুপ্রবাহের মধ্য দিয়েই বিমান নিয়ে উড়ে যাওয়া!
সেখানে প্রবেশের মাত্র পাঁচ মিনিটের মাথায় প্রচণ্ড বৈরী আবহাওয়ার কারণে প্রথম দলের দুটি বিমানেরই অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে। তীব্র আর্তনাদ করে যেন আত্মসমর্পণই করে বসে এগুলোর ইঞ্জিন। ফলে দ্রুত ক্লাউড থেকে বেরিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে বাধ্য হন প্রথম দলের পাইলটরা।
এবার জিমি রবিনসনদের পালা। ততক্ষণে সেই প্রলয়ংকরী মাশরুম মেঘটি আইভি মাইক বোমার বিস্ফোরণস্থল—মার্শাল আইল্যান্ডের অংশ—ছোট্ট ইলুগেলাব আইল্যান্ডটিকে ভয়াবহ অন্ধকারে নিমজ্জিত করে ফেলে। পার্শ্ববর্তী আরেকটি এফ-৮৪ থান্ডারজেটে চালকের আসনে থাকা পাইলট বব হ্যাগানকে সঙ্গী করে জিমি উড়াল দিলেন সেদিকে। ক্রমে চোখের সামনে থেকে হারিয়ে যেতে শুরু করল স্বচ্ছ পরিষ্কার আকাশ। স্বেচ্ছায় জেনেশুনে তাঁরা যেন ছুটে চলছিলেন মানবসৃষ্ট নরকের দরজায়।
ইতিমধ্যেই লেফটেন্যান্ট মিরোনি রেডিও বার্তায় রবিনসনদের জানিয়ে দিয়েছিলেন ক্লাউডের ভেতরের ভয়ংকর পরিবেশের কথা। সেখানে দেখা প্রজ্বলিত শিখার মতো একধরনের লালচে আভা এবং বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতিগুলোর অস্বাভাবিক আচরণ সম্পর্কেও আগাম সতর্ক করেছিলেন তিনি। তবে এসব সাবধানবাণীতে খুব একটা কাজ হয়নি। মাশরুম ক্লাউডের সীমানা স্পর্শ করতেই বিক্ষুব্ধ পরিবেশের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে নামতে হলো তাঁদের। প্রবল ঝড়ের আঘাতে রবিনসনের ফাইটার জেট তখন ভয়ংকরভাবে দুলছে। প্রাণান্ত চেষ্টার পর অবশেষে তিনি বিমানের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেলেন। সেই সঙ্গে সক্ষম হলেন অটো পাইলট মোড চালু করতে।
জিমি রবিনসনের এফ-৮৪ বিমানের ডানার সঙ্গে লাগানো ছিল একগাদা ফিল্টার। বিস্ফোরণ থেকে উদ্ভূত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাগুলো আটকে ফেলাই এদের মূল লক্ষ্য। পারমাণবিক বিস্ফোরণের কেন্দ্রস্থলে নিউট্রন ফ্লাক্সের মান ছিল প্রায় ১০২৪ নিউট্রন/সেমি২। বিস্ময়কর গতিতে সেখানে নিউট্রন ক্যাপচার বিক্রিয়া সংঘটিত হচ্ছিল।
পৃথিবীতে এমনটা আগে কখনো দেখা যায়নি। ক্ষুধার্ত নিউক্লিয়াসগুলো যেন গোগ্রাসে নিউট্রন গিলে নিচ্ছিল, আর তৈরি করছিল ইউরেনিয়াম-২৫৫-এর মতো হরেক রকম অদ্ভুত আইসোটোপ। নতুন মৌল খুঁজতে গিয়ে জীবন বিসর্জন দেওয়া ইতিহাসের প্রথম মানুষ ক্যাপ্টেন জিমি রবিনসন। দুঃখজনকভাবে তাঁর মরদেহ কখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।