ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি : জ্যৈষ্ঠের তপ্ত দুপুরে ঠাকুরগাঁওয়ের দিগন্তজোড়া সবুজ বাগান থেকে ভেসে আসছে পাকা লিচুর ম ম গন্ধ। সবুজের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে লাল টুকটুকে ফলের থোকা, যেন প্রকৃতির নিজ হাতে সাজানো এক অনবদ্য ক্যানভাস। এই দৃশ্য কেবল চোখের আরাম নয়, এটি জেলার হাজার হাজার মানুষের জীবন-জীবিকার এক বিশাল কর্মযজ্ঞের প্রতিচ্ছবি। বাগান মালিকের স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন, ব্যাপারীর দেশজুড়ে ব্যবসা প্রসারের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, শ্রমিকের ঘামে ভেজা জীবনের স্বস্তি আর পথে কুড়ানো লিচু বিক্রি করা শিশুর একবেলা অন্নের সংস্থান—সবকিছুই আবর্তিত হচ্ছে এই রসালো ফলকে কেন্দ্র করে। ঠাকুরগাঁওয়ের লিচু অর্থনীতি তাই শুধু সমৃদ্ধির গল্প শোনায় না, এর পরতে পরতে লুকিয়ে আছে শ্রম, সাফল্য আর গভীর বঞ্চনার নানা অধ্যায়।
বাগান মালিকের চোখে সোনালি স্বপ্ন:
ঠাকুরগাঁওয়ের লিচু এখন আর স্থানীয় বাজারের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নেই। এখানকার বোম্বাই, চায়না-৩, বেদানা ও মাদ্রাজি জাতের লিচুর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। জেলার সদর, পীরগঞ্জ, রানীশংকৈল, বালিয়াডাঙ্গীসহ প্রায় প্রতিটি উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে লিচুর চাষ হচ্ছে। বিশেষ করে আকচা, গড়েয়া, ভুল্লি ও রুহিয়ার বাগানগুলো জেলার লিচু চাষের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
আকচা গ্রামের প্রবীণ লিচু চাষি শফিকুল ইসলাম এবার তৃপ্তির হাসি হেসে বলেন, “এইবার আল্লাহ মুখ তুলে তাকিয়েছে। গত কয়েক বছরের মধ্যে সেরা ফলন হয়েছে। আবহাওয়া ভালো থাকায় লিচুর আকার, রং আর স্বাদ—সবই মনমতো। গত বছর শিলাবৃষ্টি আর ঝড়ে যে লোকসান হয়েছিল, আশা করি এবার তা পুষিয়ে নিতে পারব।
শফিকুল ইসলামের মতো হাজারো চাষি লিচুকে আঁকড়ে ধরে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। তবে এই স্বপ্নের পেছনে রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ আর অক্লান্ত পরিশ্রম। একটি বাগানকে ফলন উপযোগী করে তুলতে সময় লাগে ৫ থেকে ৭ বছর। এই দীর্ঘ সময়ে গাছের পরিচর্যা, সার-ওষুধ, সেচ আর শ্রমিকের মজুরি বাবদ বড় অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। এরপরও প্রতি মুহূর্তে থাকে প্রকৃতির খামখেয়ালিপনার ভয়। শফিকুল আক্ষেপ করে বলেন, “ঝড়-শিলাবৃষ্টির ভয় মাথায় নিয়েই আমাদের প্রতি বছর নতুন করে পথচলা শুরু করতে হয়। সারাবছরের পরিশ্রম এক রাতের দুর্যোগে শেষ হয়ে যেতে পারে।
হাটবাজারে উৎসব, অর্থনীতিতে প্রাণের সঞ্চার:
লিচু পাকতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পেয়েছে ঠাকুরগাঁওয়ের হাটবাজারগুলো। শহরের প্রাণকেন্দ্র চৌরাস্তা, কালিবাড়ী বাজার থেকে শুরু করে গ্রামের ছোট ছোট হাট পর্যন্ত সর্বত্রই এখন লিচুর পসরা। ভ্যান, ঝুড়ি আর ডালিতে সাজানো লালচে-গোলাপি লিচুর স্তূপ ক্রেতাদের আকর্ষণ করছে। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে প্রতিদিন শত শত ট্রাক লিচু যাচ্ছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। ব্যাপারীদের হাঁকডাক আর ক্রেতা-বিক্রেতার দর কষাকষিতে বাজারগুলো এখন উৎসবমুখর।
ঢাকার বাদামতলী থেকে আসা পাইকারি ব্যাপারী আব্দুল মান্নান বলেন, “প্রায় বিশ বছর ধরে এই ব্যবসা করছি। ঠাকুরগাঁওয়ের লিচুর মান আর স্বাদের কারণে এর চাহিদা সবসময়ই বেশি। আমরা সরাসরি বাগান থেকে লিচু কিনে ট্রাকে করে ঢাকায় পাঠাই। ভালো দাম পাওয়া যায়, তাই প্রতি বছর এই মৌসুমের জন্য অপেক্ষা করি।” তাঁর মতো শত শত ব্যাপারীর আনাগোনায় জেলার গ্রামীণ অর্থনীতিতে অর্থের প্রবাহ বাড়ছে।
তবে এই রঙিন চিত্রের উল্টো পিঠও রয়েছে। শহরের ফুটপাতে বসে লিচু বিক্রি করেন রেহানা বেগম। তিনি বলেন, “পাইকারের কাছ থেকে অল্প কিছু লিচু কিনে এখানে বসি। ১০০ লিচু বিক্রি করলে ৩০-৪০ টাকা লাভ থাকে। কোনোদিন বিক্রি না হলে পচে গিয়ে লোকসান হয়। সারাদিন রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে এই সামান্য লাভের জন্য বসে থাকি। এই দিয়েই তো সংসার চলে।” রেহানার মতো প্রান্তিক বিক্রেতাদের কাছে লিচুর ব্যবসা টিকে থাকার এক কঠিন লড়াই।
ঘামে ভেজা পয়সা, তবু নেই নিশ্চয়তা:
লিচু মৌসুমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ এর সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াকরণ, যা পুরোপুরি শ্রমনির্ভর। জ্যৈষ্ঠের কাঠফাটা রোদে গাছের মগডালে উঠে লিচু পাড়া, বাছাই করা, পাতা ছাড়িয়ে গোছা বাঁধা এবং ঝুড়িতে সাজানোর মতো কঠিন কাজগুলো করেন হাজারো মৌসুমি শ্রমিক। বছরের অন্য সময়ে যাদের কাজের নিশ্চয়তা থাকে না, তাদের জন্য এই এক-দেড় মাসের কাজ যেন আশীর্বাদ।
শ্রমিক সর্দার রফিক মিয়া জানান, “ভোর থেকে কাজ শুরু হয়। সারাদিন গরমে শরীর পুড়ে যায়। গাছের উঁচু ডালে ওঠা খুব ঝুঁকিপূর্ণ, পড়ে গিয়ে হাত-পা ভাঙার ভয় থাকে। কিন্তু কী করব? এই সময় দৈনিক ৫০০-৭০০ টাকা আয় হয়। এই টাকা দিয়ে ছেলেমেয়ের পড়ার খরচ, সংসারের ধারদেনা শোধ করার চেষ্টা করি।” মৌসুম শেষে এই শ্রমিকদের অনেকেই আবার বেকার হয়ে পড়েন। তখন নতুন করে শুরু হয় তাদের জীবনসংগ্রাম।
মুন্সিরহাটের ‘টক-মিষ্টি’ শৈশব:
ঠাকুরগাঁওয়ের লিচু অর্থনীতির সবচেয়ে করুণ চিত্রটি সম্ভবত মুন্সিরহাটে দেখা যায়। এখানে প্রতিদিন বিকেলে জড়ো হয় একদল শিশু। তাদের ছেঁড়া জামা, খালি পা আর মলিন মুখে রাজ্যের ক্লান্তি। তাদের ছোট্ট হাতের পলিথিনে বা বস্তায় থাকে বাগান থেকে ঝরে পড়া, পরিত্যক্ত কিংবা কুড়িয়ে পাওয়া লিচু। এই লিচু বিক্রি করেই তাদের দিনের অন্নের সংস্থান হয়।
দশ বছরের রুবেল জানায়, “সকালে স্কুলে যাই, স্কুল থেকে ফিরে লিচু কুড়াতে যাই। বাগানের মালিকরা অনেক সময় তাড়া করে, আবার কেউ কেউ কিছু নিতে দেয়। এখানে এনে বিক্রি করে যা পাই, তা দিয়ে মায়ের হাতে দিই। মা চাল কেনে।” রুবেলের মতো দরিদ্র নারীরা কাছে লিচু মানে মিষ্টি কোনো ফল নয়, বরং বেঁচে থাকার এক কঠিন বাস্তবতা। লিচু অর্থনীতির সবচেয়ে উপেক্ষিত অংশ, যাদের শ্রমের কোনো স্বীকৃতি বা মূল্য নেই।
সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ:
ঠাকুরগাঁওয়ের লিচু শিল্পে সম্ভাবনা যেমন বিশাল, তেমনি চ্যালেঞ্জও কম নয়। কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি প্রয়োগ করলে ফলন আরও বাড়ানো সম্ভব। লিচু থেকে জুস, জেলি বা অন্যান্য প্রক্রিয়াজাত পণ্য তৈরির কারখানা স্থাপন করা গেলে স্থানীয়ভাবে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে এবং চাষিরা আরও বেশি লাভবান হবেন।
তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো হিমাগারের অভাব। লিচু দ্রুত পচনশীল হওয়ায় সংরক্ষণের অভাবে অনেক সময় চাষিরা নামমাত্র মূল্যে ফল বিক্রি করতে বাধ্য হন। এছাড়া পরিবহন খরচ বৃদ্ধি এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে উৎপাদকরা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হন।
ঠাকুরগাঁও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মাজেদুল ইসলাম বলেন, ঠাকুরগাঁওয়ের আবহাওয়া ও মাটি লিচু চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী হওয়ায় প্রতিবছরই চাষের আওতা বাড়ছে। এ বছর জেলায় ২৮১ হেক্টর জমিতে ৬৪১টি লিচু বাগান রয়েছে। ১১২ কোটি ৩৯ লক্ষ ৯৮ হাজার টাকার লিচু বিক্রি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলেও জানান তিনি। আমরা চাষিদের উন্নত জাত নির্বাচন, রোগবালাই দমন এবং আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতির বিষয়ে সব ধরনের পরামর্শ ও সহযোগিতা দিয়ে আসছি। হিমাগার স্থাপনের বিষয়টিও সরকারের বিবেচনায় রয়েছে।”
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।