জুমবাংলা ডেস্ক : সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্প ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ অনিশ্চয়তায় পড়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিরোধের জেরে ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের ঋণ আটকে গেছে। ফলে বিমানবন্দর থেকে এফডিসি পর্যন্ত চলমান এই দ্রুতগতির উড়ালসড়ক প্রকল্পের বাকি অংশের নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে গেছে।
প্রকল্পটির অধিকাংশ সাইটে কোনো কাজ হচ্ছে না। উদ্বোধনের অল্প সময়ের মধ্যে ব্যবহারকারীদের কাছে জনপ্রিয় হওয়া এই উড়ালসড়কের তিন বিদেশি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মামলায় জড়িয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির চেষ্টা করছে। মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের পর দেশের দ্বিতীয় ও বৃহত্তম সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) প্রকল্পটিতে বাংলাদেশ ছাড়াও থাইল্যান্ডের একটি ও চীনের দুটি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ এবং নির্মাণকাজের মাধ্যমে অংশীদার। প্রতিষ্ঠান তিনটি হলো থাইল্যান্ডভিত্তিক ইতালিয়ান-থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি লিমিটেড, চীনের শ্যানডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপ ও সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড।
এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে-এফডিইই কোম্পানি লিমিটেড নামের কোম্পানি গঠন করে ইতালিয়ান-থাই ডেভেলপমেন্ট। কোম্পানির অংশীদার তিন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার যথাক্রমে ৫১, ৩৪ ও ১৫ শতাংশ। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ হলো এক্সপ্রেসওয়ের নির্বাহক প্রতিষ্ঠান। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে কাওলা থেকে রেললাইন ধরে তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর হয়ে যাত্রাবাড়ীর কাছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালীতে গিয়ে শেষ হবে এই উড়ালসড়ক। পুরো উড়ালসড়কের দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর বিমানবন্দর সংলগ্ন কাওলার থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত সাড়ে ১১ কিলোমিটার দূরত্ব অংশ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরদিন ৩ সেপ্টেম্বর এই অংশে যানবাহন চলাচল শুরু হয়। গত ২০ মার্চ বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) গেট-সংলগ্ন র্যাম্প যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে প্রকল্পে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা।
বিনিয়োগকারীর সঙ্গে চুক্তি অনুসারে, উড়ালসড়ক দিয়ে দিনে সর্বোচ্চ প্রায় ৮০ হাজার যানবাহন চলাচল করবে বলে ধারণা করা হয়, আর সর্বনিম্ন যানবাহন চলাচল করতে পারে সাড়ে ১৩ হাজার। ৮০ হাজারের বেশি যানবাহন চলাচল করলে বাড়তি যে টোল আদায় হবে, এর ২৫ শতাংশ বাংলাদেশ পাবে। অন্যদিকে সাড়ে ১৩ হাজারের চেয়ে কম যানবাহন চলাচল করলে বিনিয়োগকারীকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে সরকারের।
চুক্তিতে বলা আছে, একটানা ১৫ দিন দৈনিক গড়ে সাড়ে ১৩ হাজারের কম যানবাহন চলাচল করলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে বিনিয়োগকারীকে চুক্তির চেয়ে বাড়তি সময় টোল আদায় করার সুযোগ দিতে হবে। বিনিয়োগকারীর সঙ্গে চুক্তি অনুসারে, উড়ালসড়কটি ২৫ বছর তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এর মধ্যে নির্মাণ সময় সাড়ে তিন বছর। অর্থাৎ বিনিয়োগকারী সাড়ে ২১ বছর টোল আদায় করে অর্থ নিয়ে যাবে। এ সময়ের মধ্যে কখনো টানা ১৫ দিন সাড়ে ১৩ হাজারের কম যানবাহন চলাচল করলে সময় বাড়িয়ে ক্ষতিপূরণ শোধ করতে হবে।
এদিকে গত ২ সেপ্টেম্বর উড়াল সড়ক আংশিক চালুর পর গত ছয় মাসে অর্ধেক অংশে যানবাহন চলাচলের গড় খুবই সন্তোষজনক। গত ৪ এপ্রিল এক দিনে সর্বোচ্চ ৫২ হাজার ৬১২টি গাড়ি চলাচল করেছে। গড়ে ৩৫ হাজারের বেশি যান চলছে দিনে। সেতু বিভাগের কর্মকর্তাদের আশা, র্যাম্পসহ পুরো প্রকল্পটি চালু হলে দিনে গাড়ি চলাচলের সংখ্যা শুরুতেই লাখ ছাড়িয়ে যাবে। কারণ, যানজটের এই নগরীতে জট এড়িয়ে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প হয়ে উঠেছে এই দ্রুতগতির উড়ালসড়ক।
সম্প্রতি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কয়েকটি ওয়ার্কস্টেশন ঘুরে দেখা গেছে, কোথাও কোনো কর্মচাঞ্চল্য নেই। অধিকাংশ পয়েন্টে এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু হাতিরঝিল আর পান্থপথে অল্প পরিসরে কিছু শ্রমিক কাজ করছে। বাকি চারটি জায়গায় (কাওলা, মগবাজার, মালিবাগ ও কমলাপুর) অল্পসংখ্যক নিরাপত্তাকর্মী, বৈদ্যুতিক মিস্ত্রিসহ কিছু কর্মী রাখা হয়েছে। প্রকল্পের কর্মীরা জানান, কোথাও দুই মাস ধরে কাজ বন্ধ, কোথাও তিন মাস কাজ হচ্ছে না। সরকারের অগ্রাধিকারমূলক এই প্রকল্পের কাজ চলতি বছরের ডিসেম্বরেই শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটি আর হচ্ছে না। এরই মধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দ্বন্দ্ব গিয়ে আদালতে পৌঁছেছে।
সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন বলেছেন, কিছু আইনগত বিষয় নিয়ে মামলা হয়েছে। সেই মামলাটি তাদের নিজেদের বিষয়। এতে আমাদের কোনো ভূমিকা নেই। আমরা মামলাটির ফলাফলের অপেক্ষায় রয়েছি। আমরা দুই পক্ষকে লিখিতভাবে অনুরোধ করেছি, তারা যেন কোনোভাবে কাজটা বন্ধ না করে। কারণ, আমরা কাজটা দ্রুত শেষ করতে চাই। প্রকল্পের চুক্তি অনুযায়ী, কোনো পক্ষ অর্থ জোগাড়ে ব্যর্থ হলে বাকি প্রতিষ্ঠান চাইলেই তার শেয়ার নিয়ে নিতে পারবে। সেদিকেই আগ্রহ দুই চীনা প্রতিষ্ঠানের। অন্যদিকে অর্থের জোগান না দিয়েই নিজেদের শেয়ার ধরে রাখতে চায় ইতাল থাই। এই টানাপোড়েন ও মামলার জেরে অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছে চাইনিজ ব্যাংক।
প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা জানান, ঋণ বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শেয়ার নিয়ে দ্বন্দ্ব থেকেও প্রকল্পের নির্মাণকাজ ব্যাহত হচ্ছে। চলতি বছরের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ হবে না জেনে গত ১৭ জানুয়ারি ঋণ আটকে দিয়েছে চীনের দুটি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান চায়না এক্সিম ব্যাংক ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়না (আইসিবিসি)।
এই প্রেক্ষাপটে প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় পড়েছে। পিপিপি প্রকল্পের চুক্তির শর্ত অনুসারে, মূল কাঠামো নির্মাণব্যয়ের ৭৩ শতাংশ জোগান দেবে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। বাকি ২৭ শতাংশ দেবে বাংলাদেশ সরকার, যা ভায়াবিলিটি গ্যাপ ফান্ডিং (ভিজিএফ) নামে পরিচিত। ২৫ বছরে নির্মাণ ও পরিচালন ব্যয় তুলে নিয়ে সরকারকে প্রকল্পটি হস্তান্তর করবে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।
অবশ্য প্রকল্পের পরিচালক এ এইচ এম সাখাওয়াত আখতার গণমাধ্যমকে জানান, নির্মাণকাজ বন্ধ নেই। কাজ চলছে সীমিত পরিসরে। তবে ঋণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রকল্পের কাজ শেষ করতে এক বছর বেশি সময় লাগতে পারে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থায়নের নতুন উৎস খুঁজছে।
তরুণদের কাজে লাগাতে পারলেই অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে : তাজুল ইসলাম
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।