মহাবিশ্বের প্রায় এক–চতুর্থাংশ জুড়ে থাকা রহস্যময় পদার্থ ‘ডার্ক ম্যাটার’ বা অন্ধকার পদার্থকে এবার প্রথমবারের মতো চিহ্নিত করার দাবি করেছেন গবেষকেরা। এতদিন ধরে টেলিস্কোপে ধরা না পড়া এই অদৃশ্য পদার্থের অস্তিত্ব নিয়ে পদার্থবিদেরা ধারণা করলেও সরাসরি প্রমাণ পাওয়া যায়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় এবং জার্মানির লাইবনিজ ইনস্টিটিউট ফর অ্যাস্ট্রোফিজিকস–এর বিজ্ঞানীরা এবার বলছেন, তারা সেই প্রমাণের কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন।

ডার্ক ম্যাটার নিজে কোনও আলো বা শক্তি বিকিরণ করে না। তবে এই পদার্থের কণাগুলো একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হলে সেখান থেকে গামা রশ্মি বা উচ্চ–শক্তির বিকিরণ তৈরি হয়। গবেষকদের ধারণা, আমাদের আকাশগঙ্গার কেন্দ্র থেকে পাওয়া এক রহস্যময় গামা রশ্মির আলো–ই হতে পারে ডার্ক ম্যাটারের অবস্থান নির্দেশক সংকেত। যদি এটি সত্যি হয়, তবে এটি হবে ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্বের প্রথম বাস্তব প্রমাণ।
জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোসেফ সিল্ক, যিনি গবেষণাটির সহ–লেখক, তিনি বলেন— ‘ডার্ক ম্যাটার মহাবিশ্বকে প্রভাবিত করে এবং গ্যালাক্সিগুলোকে একত্রে ধরে রাখে। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং আমরা সব সময় ভাবি কীভাবে এটিকে শনাক্ত করা যায়। গামা রশ্মি, বিশেষ করে গ্যালাক্সির কেন্দ্রের অতিরিক্ত আলোক বিচ্ছুরণ, হয়তো আমাদের প্রথম সূত্র।’
বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরেই জানেন, গ্যালাক্সিগুলোর দৃশ্যমান ভরের বাইরে আরও একধরনের অদৃশ্য পদার্থ রয়েছে, যা মাধ্যাকর্ষণ তৈরি করে — সেটিই ডার্ক ম্যাটার। কিন্তু এটি আলো বিকিরণ না করায় এতদিন পর্যন্ত টেলিস্কোপে দেখা যায়নি।
২০০৮ সাল থেকে নাসার ফেরমি স্যাটেলাইট ধীরে ধীরে গামা রশ্মির সাহায্যে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির একটি মানচিত্র তৈরি করছে। সেই ছবিতে দেখা যায়, আকাশগঙ্গার কেন্দ্র থেকে একধরনের অজানা গামা বিকিরণ বের হচ্ছে, যা কোনও নির্দিষ্ট তারকা বা উৎস থেকে আসছে বলে মনে হয় না।
এই আলো কোথা থেকে আসছে, তা নিয়ে দুইটি মতামত ছিল:
একদল বিজ্ঞানীর মতে, এটি মৃতপ্রায় তারার ঘূর্ণায়মান কেন্দ্র (পালসার) থেকে আসছে; আর অন্যদের মতে, এটি ডার্ক ম্যাটারের কণার সংঘর্ষের ফল। তবে কোন ব্যাখ্যাটি সঠিক, তা প্রমাণ করা এতদিনে কঠিন হয়ে উঠেছিল।
ফিজিক্যাল রিভিউ লেটারস জার্নালে প্রকাশিত নতুন গবেষণায় বিজ্ঞানীরা সুপারকম্পিউটার ব্যবহার করে মিল্কিওয়ের ডার্ক ম্যাটারের বন্টনের একটি মানচিত্র তৈরি করেছেন। তাদের বিশেষত্ব হলো—এই মডেল তৈরিতে তারা গ্যালাক্সির গঠনের ইতিহাসকেও বিবেচনায় নিয়েছেন।
অধ্যাপক সিল্ক ব্যাখ্যা করে জানান, ‘আমাদের গ্যালাক্সি মূলত বিশাল এক ডার্ক ম্যাটারের মেঘ থেকে গঠিত হয়েছিল। পরবর্তীতে সাধারণ পদার্থ ঠান্ডা হয়ে কেন্দ্রের দিকে পতিত হয় এবং কিছু ডার্ক ম্যাটারকেও সঙ্গে টেনে আনে।’
বিলিয়ন বছর ধরে এই ডার্ক ম্যাটার ঘন কেন্দ্রের দিকে জমা হতে থাকে এবং কণার সংঘর্ষের পরিমাণ বাড়ে। যখন গবেষকেরা এই মডেলটি ফেরমি স্যাটেলাইটের বাস্তব পর্যবেক্ষণের সঙ্গে তুলনা করেন, দেখা যায়—দুইটির ফলাফল আশ্চর্যজনকভাবে মিলছে।
গবেষণার প্রধান লেখক ড. মোরিটস মুরু বলেন, ‘এর আগে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছিলেন ডার্ক ম্যাটার গ্যালাক্সির কেন্দ্রে পুরোপুরি গোলাকারভাবে বিতরণ ছিল। কিন্তু আমাদের সিমুলেশনে দেখা গেছে, এটি আসলে কিছুটা চাপা বা চ্যাপ্টা আকৃতির। এই কারণেই আগের মডেলগুলোর সঙ্গে পর্যবেক্ষণের অমিল দেখা দিয়েছিল।’
যদিও এটি এখনও ডার্ক ম্যাটারের চূড়ান্ত প্রমাণ নয়, তবে এই গবেষণা দৃঢ়ভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে আকাশগঙ্গার কেন্দ্রের গামা রশ্মির উজ্জ্বলতা সত্যিই ডার্ক ম্যাটার থেকেই আসছে। তবুও বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটি হয়তো মিলিসেকেন্ড পালসার বা দ্রুত ঘূর্ণনশীল নিউট্রন তারার বিকিরণও হতে পারে।
ড. মোরিটস বলেন, ‘আমাদের ফলাফল অনুযায়ী, গামা রশ্মির এ আলো পালসার থেকে আসছে—এ সম্ভাবনা এখন অনেকটাই কমে গেছে। এটি এখনও প্রমাণ নয়, কিন্তু ডার্ক ম্যাটার বোঝার পথে বড় এক ধাপ।’
অধ্যাপক সিল্কের আশা, শিগগিরই নির্মিতব্য চিলির সেরেনকভ টেলিস্কোপ অ্যারে এই রহস্যের চূড়ান্ত সমাধান দিতে পারবে। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী গামা রশ্মি টেলিস্কোপটি ডার্ক ম্যাটার ও পালসার–উৎপন্ন বিকিরণের সূক্ষ্ম পার্থক্য নির্ণয়ে সক্ষম হবে। পাশাপাশি এটি নিকটবর্তী ডার্ক ম্যাটারে সমৃদ্ধ বামন গ্যালাক্সি–গুলোকেও পর্যবেক্ষণ করতে পারবে।
অধ্যাপক সিল্ক বলেন, ‘যদি আমরা বামন গ্যালাক্সিতেও মিল্কিওয়ের কেন্দ্রের মতো একই সিগন্যাল পাই, তবে সেটিই হবে ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্বের অকাট্য প্রমাণ।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।



