মোহাম্মদ আবু সাঈদ : বাংলায় মুসলমান সমাজে নারীদের প্রতিকূলতার ইতিহাস অনস্বীকার্য। নারীদের শিক্ষা, চিকিৎসা, বিবাহ ও অন্যান্য ব্যাপারে ইসলামের উসিলা দিয়ে অনেক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে তত বেশি দূর হচ্ছে এই প্রতিবন্ধকতা। আদতে প্রকৃত ইসলাম যে নারীকে এতটা কোণঠাসা করে রাখতে বলেনি তা উন্মোচিত হচ্ছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। তেমনি একটি বিষয়— ঈদের নামাজে নারীদের অংশগ্রহণ।
এই বিষয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে শতবছর পূর্বে, ব্রিটিশ আমলে। মুসলমানদের বিভিন্ন পত্রিকায় পক্ষে বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন অনেকে। মাওলানা আকরম খাঁ, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মাওলানা রুহুল আমিন, আবদুর রহমান প্রমুখ। এদের মধ্যে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন ব্যতিক্রম। কারণ তিনি লেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন না, বরং ময়দানে কাজের মাধ্যমে মেয়েদের ঈদের জামাত কায়েম করেছেন।
১৯৩৯ সালে ‘সলিমুল্লাহ মুসলিম হল বার্ষিকী’-তে শহীদুল্লাহ একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন— ‘ইসলামে নারীর ধর্ম সম্বন্ধীয় অধিকার। এই প্রবন্ধে তিনি কুরআন ও হাদিসের বিভিন্ন রেফারেন্স উপস্থাপন করে মেয়েদের ঈদের জামাতের পক্ষে নিজের মত প্রকাশ করেছেন। প্রবন্ধের শেষে বলেন: ‘বর্তমান যুগের উলেমা যাহাই বলুন না কেন, এখনও মুসলিম রাজ্যসমূহে নারীরা পুরুষদের সহিত ইসলামের বিধান অনুযায়ী ঈদের ময়দানে ও মসজিদে যোগদান করিয়া থাকেন। বাঙ্গালার প্রাচীন রাজধানী গৌড় ও পাণ্ডুয়ার মসজিদে এখনও নারীদের জন্য পৃথক গ্যালারী দৃষ্ট হয়। আজ ইসলামের নবজাগরণের দিনে হযরতের এই লুপ্ত সুন্নত পুনরায় প্রচলিত করার প্রয়োজন আছে’। (শহীদুল্লাহ : ২০১১, ১৮)
এই প্রবন্ধ লেখার একটি প্রেক্ষাপট আছে। ঢাকার মুসলিম লীগ মহিলা সংস্থার প্রেসিডেন্ট ছিলেন বেগম সারা তৈফুর। তিনি ছিলেন শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের ভাগনী এবং ঢাকার বিখ্যাত ইতিহাসগ্রন্থ Glimpses of Old Dhaka’র লেখক সৈয়দ মোহাম্মদ তৈফুরের স্ত্রী। তিনিই প্রথম বাঙালি মুসলমান মহিলা যিনি বাংলা ভাষায় নবীজীর জীবনী লিখেছিলেন— স্বর্গের জ্যোতি, ১৯১৭। বইটি প্রকাশের পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে একটি প্রশংসাপত্র পাঠিয়েছিলেন। তার উদ্যোগেই সর্বপ্রথম ঢাকায় ঈদের জামাতের প্রস্তুতি আরম্ভ হয়— ১৯৩৭ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সামনে এই জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ইমামতি করেছিলেন ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। সেই ঐতিহাসিক জামাতে অংশগ্রহণ করা দুইজন ব্যক্তির স্মৃতিচারণ উদ্ধার করা হয়েছে। পাঠকসমীপে পেশ করছি।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর বড় মেয়ে মাহযূযা হক লিখেছেন: ‘১৯৩৭ সালে ঢাকায় সারা তৈফুর মুসলিম লীগ মহিলা সংস্থার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তারই এবং সদস্যবৃন্দের উদ্যোগে ওই বছর মহিলাদের ঈদের জামাত ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। ওই জামাতে কোনো মৌলানা ইমাম হতে রাজী না হওয়ায় আব্বার নেতৃত্বে কয়েকজন পুরুষসহ তিনি কার্জন হলের ময়দানে মহিলাদের ঈদের জামাতে ইমামতি করেছিলেন। ওই জামাতে ঢাকার অনেক মহিলা শরিক হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে সারা তৈফুর, সালেহা সুলতানুদ্দিন, ঈফ্ফাত মাহমুদ হাসান এবং আমিও এতে শরিক হয়েছিলাম। আমরা ঘরের মধ্যে আর পুরুষগণ ছিলেন ময়দানে আমাদের সামনে’। (হক: ১৯৯১, ৪৮)
কাজী মোতাহার হোসেনের বড় মেয়ে যোবায়দা মির্যার স্মৃতিচারণ: ‘রোজার শেষের দিকে খুব তোড়জোড় শোনা গেল, এবার মহিলাদের ঈদের নামাযের জামাত হবে কার্জন হলে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হবেন ইমাম। স্কুলে তৈফুর সাহেবের মেয়ে লুলু বিলকিস বানু আমার চেয়ে দুবছরের জুনিয়র ছিল। সেই প্রথম খবরটা দিল আমাকে আর অনুরোধ করল আমরা যেন অতি অবশ্যই যাই। ঢাকায় মহিলাদের অগ্রগতির প্রথম পদক্ষেপই এটা। এর আগে এখানে মহিলাদের জন্যে কখনো কোনো বিশেষ ব্যবস্থা হয়নি, এমন প্রকাশ্য দিবালোকে। অপরপক্ষে ঘোরতর প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। কেউ বলছে, ‘ড. শহীদুল্লাহ তো মেয়েদের ইমাম—তার সাইজ ওই রকমই কিনা!’ কেউ বলে, ‘শহীদুল্লাহ নামেই জয়জয়কার। এবার দেখা যাবে কত দৌড়!’ এক মহল থেকে ফতোয়া জারি হয়ে গেল, ‘এই ইমামুন্নেসাকে কতল করা উচিত।’
এমনি ধরনের আরও আরও কত মতামত। শুনে শুনে ভয়ই পেয়েছিলাম, না জানি কী হয়! সময় মতো ঘটনাস্থলে একদল বীরপুরুষ লাঠিসোঁটা নিয়ে রে-রে করতে করতে বিপুল-বিক্রমে এসে উপস্থিত হলো। মহিলারা জড়সড় প্রাণভয়ে। কিন্তু আসল লোকটি একটুও বিচলিত হলেন না। যেন কিছুই হয়নি এমনি নিশ্চিন্ত মনে এগিয়ে যেয়ে তাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললেন। নানার কোনোই উত্তেজনা নেই, শান্ত-নিরুত্তাপ। লাঠিয়ালরা চুপচাপ মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে চলে গেল। নির্বিঘ্নে নামাজ হলো। ওদিকে সেদিন বোধহয় মহিলাদের কার্জন হলে পাঠিয়ে তাদের কর্তারা ময়দানে ঠিকমত নামায আদায় করতে পারেননি’। (মির্যা: ১৯৮৪, ৫৮)
দুটি স্মৃতিচারণ থেকে সেই ঐতিহাসিক জামাতকে কেন্দ্র করে বিভিন্নভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির দুরভিসন্ধি লক্ষ্য করা যায়।
প্রথমত, বিভ্রান্তিকর ফতোয়ার মাধ্যমে। এই ফতোয়া এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, সেখানে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর প্রাণনাশের হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। এবং এই ফতোয়ার জেরেই কিন্তু ঈদের দিন জামাতের সময় কিছু যুবক লাঠিসোঁটা নিয়ে হাজির হয়েছিলেন কার্জন হলের সামনে। তাদেরকে উস্কানি দিয়েছিলো কারা? যারা অহেতুক ফতোয়া জারি করে সমাজে উত্তেজনা তৈরি করেছে তারাই। তাদের ফতোয়ার উসকানিতেই মূলত যুবকরা এমন মহৎ উদ্যোগের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে চেয়েছিল।
দ্বিতীয়ত, জামাত আয়োজনের জন্য কোনো ইমাম সাহেব রাজি হচ্ছিলেন না। যেই সমস্যার সমাধান করেছেন শহীদুল্লাহ নিজেই— ইমামতির দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে।
জামাতের সময় লাঠিসোঁটা নিয়ে হাজির হওয়া যুবকদেরকে বুঝিয়ে তাদের অপকর্ম থেকে বিরত রাখা এবং কোনো ইমাম সাহেব রাজি না হওয়ায় ইমামতি করা— উভয়ক্ষেত্রে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন শহীদুল্লাহ। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন ফতোয়ার জবাব দেওয়ার দায়িত্বও পালন করেছিলেন তিনি। এই দায়িত্ব পালনার্থেই মূলত উপরোক্ত প্রবন্ধটি প্রকাশ করেছিলেন তিনি।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ গতানুগতিক চিন্তার পক্ষপাতী ছিলেন না, বরং নিজের মেধা ও বুদ্ধি খরচ করে চিন্তা করতে সক্ষম ছিলেন। যে কারণে ইসলাম-চিন্তায়ও গতানুগতিকতার লেশ দেখা যায় সামান্যই। তিনি মেয়েদের ঈদের জামাতের পক্ষে কাজ করেছেন, সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন আবার পাশাপাশি গান-বাজনারও ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। মুসলমানদের শিল্পকলা চর্চা নিয়েও তার রয়েছে ভিন্নমত।
অর্থাৎ, কারো দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে নিজের বুদ্ধি দ্বারা চিন্তা করতেন তিনি, যে কারণে ৮৭ বছর আগে, মহিলাদের ঈদের জামাতের মতো রীতিমতো দুঃসাহসী একটি কর্মসূচিকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে সফল হয়েছিলেন।
গতানুগতিক চিন্তা থেকে বেরিয়ে ইসলামের প্রায়োগিক চর্চায় মনোনিবেশ করতে শিক্ষা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বেগম সারা তৈফুর একজন শিক্ষিত এবং পরিচিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন বলেই এমন বৈপ্লবিক একটি কর্মসূচির আঞ্জাম দিতে পেরেছেন। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং কাজী মোতাহার হোসেনের মেয়েরা সেখানে অংশগ্রহণ করতে পেরেছিলেন, তাদের পিতাদের সম্মতিতেই। তাদের পিতাগণ ছিলেন সে সময়ের মুসলমান সমাজের নবজাগরণের কেন্দ্রবিন্দুতে। শিক্ষিত মুসলমানদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই এমন বৈপ্লবিক একটি কর্মসূচির সফলতা সম্ভব হয়েছে।
আবার নারী-পুরুষের জায়গা থেকে যদি দেখি, পারস্পরিক সহযোগিতার ফলেই কিন্তু জামাতের সুষ্ঠু আয়োজন সম্পন্ন হয়েছিল। যেসব মহিলাগণ উপস্থিত ছিলেন তাদের স্বামী/বাবাদের সমর্থন ছাড়া তাদের উপস্থিতি সম্ভব ছিল না। আবার মহিলাদের উপস্থিতি ছাড়া একা শহীদুল্লাহও কিছু করতে পারতেন না। মহিলাদের পক্ষ থেকে সারা তৈফুর এবং পুরুষদের পক্ষ থেকে শহীদুল্লাহ নিজ নিজ জায়গায় রেখেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। পুরুষ এবং নারীর পারস্পরিক সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাবের মাধ্যমেই যে সমাজের প্রকৃত উন্নতি সম্ভব তার একটি নজির এই ঐতিহাসিক ঘটনাটি।
তথ্যসূত্র:
১. ইসলাম প্রসঙ্গ : ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মাওলা ব্রাদার্স, ২০১১
২. ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবন : মাহযূযা হক, ধানমন্ডি, ঢাকা, ১৯৯১
৩. সেই যে আমার আমার নানারঙের দিনগুলি : যোবায়দা মির্যা, মুক্তধারা, ১৯৮৪
লেখক: মোহাম্মদ আবু সাঈদ
নূরজাহান রোড, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।