বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক : তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে স্বয়ংসম্পূর্ণ শিল্পে পরিণত করার পথে আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর যদি একটি তালিকা করি তাহলে ট্যাক্স হলিডে অব্যাহত রাখা, তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য জামানতবিহীন ঋণ জোগাড়, শক্ত অবকাঠামো তৈরি, আন্তর্জাতিক বাজারে নিজেদের জায়গা তৈরি, বিক্রয়-পরবর্তী সেবায় দক্ষতা অর্জন; এর পর আর খুব একটা পাওয়া যায় না। কিন্তু আমি বলব, দীর্ঘ মেয়াদে এখন আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ পর্যাপ্ত দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা।
এই খাতের বাকি সমস্যাগুলো সরকার ও বেসরকারি উদ্যোগে রাতারাতি সমাধান করা সম্ভব। সরকার চাইলেই ট্যাক্স হলিডে অব্যাহত রাখতে পারে। বিনিয়োগকারীরা চাইলেই অবকাঠামো তৈরি করে ফেলতে পারবেন। ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলো অত্যাধুনিক ক্রেডিট রেটিং ব্যবহার করে বিনা জামানতে ঋণ দিতে পারবে। কিন্তু চোখের পলকেই মানবসম্পদের ঘাটতি মেটানো সম্ভব নয়। এ জন্য দরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, সে অনুসারে এগিয়ে চলা।
অথচ বাংলাদেশের যে কোনো খাতে সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা হওয়ার কথা মানবসম্পদ। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডে এখন বাংলাদেশ তার ইতিহাসের সেরা অবস্থানে আছে। তার মানে, এই দেশে তরুণ, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীই সবচেয়ে বেশি। তাহলে আমরা আইসিটি খাতের জন্য কেন যথেষ্ট প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ পাচ্ছি না?
হিসাব বলছে, প্রতিবছর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে কয়েক লাখ শিক্ষার্থী আইসিটিতে ডিগ্রি নিয়ে বের হচ্ছেন। কিন্তু প্রতিযোগিতামূলক কর্মক্ষেত্রে এর ঠিক কতজন নিজেদের মানানসই করে নিতে পারছেন?
আমি নিজে একটি তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান নগদ লিমিটেডের সঙ্গে জড়িত সেই শুরু থেকে। একেবারে যাত্রার শুরু থেকে আমাদের লক্ষ্য ছিল দেশীয় প্রযুক্তি, দেশীয় সফটওয়্যার এবং দেশীয় মানবসম্পদ দিয়ে আমরা এই কাজ এগিয়ে নেব। তা যে করতে পারিনি আমরা, তা নয়। কিন্তু এই কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, সার্টিফিকেট আছে এমন অসংখ্য তরুণ এই বাজারের কাজের জন্য তৈরি নন। কারণ, তারা যা পড়েছেন, তার সঙ্গে ব্যবহারিক কর্মক্ষেত্রের মিল প্রায় নেই বললেই চলে।
এই জায়গায় আমাদের সরকার ও প্রাইভেট খাত, সবার অনেক কিছু করার আছে। প্রথমত আইসিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের কারিকুলাম ব্যবহারিক জগতের সঙ্গে মানানসই করে তৈরি করতে হবে। আজকে সারাবিশ্ব যখন আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে কাজ করছে, তখন আমরা প্রাচীন কোডিং শেখাচ্ছি; এটা হতে পারে না। হাতে লিখে লিখে কোডিং করার দিন যে শেষ হয়ে আসছে; বিশ্ব এর পরের ধাপে চলে গেছে– এটা আমাদের মেনে নিতে হবে এবং সে অনুযায়ী পাঠক্রম তৈরি করতে হবে।
আমাদের আইসিটির ইন্ডাস্ট্রিওয়াইজ বিভিন্ন পাঠক্রম তৈরি করতে হবে। আউটসোর্সিং থেকে শুরু করে গেম ডেভেলপমেন্টের জন্য আলাদা কোর্স থাকতে হবে। আমি মনে করি, এই জায়গায় বেসিস (বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিস) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। তারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে পার্টনারশিপে কাজ করতে পারে। এখানে বড় একটা কাজ হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে মিলে এই খাতের জন্য একটি কার্যকর ডেটা ব্যাংক তৈরি করা।
আমি প্রায়ই বলি, আমরা হাওয়ার ওপর কাজ করছি। আমাদের কোথায় কোথায় সুযোগ আছে, কোথায় চাহিদা আছে; পরিষ্কার জানি না। এই ট্রেন্ডিং বিষয়গুলোর যদি একটা ভালো ডেটাবেজ থাকে, তাহলে সে অনুযায়ী আমাদের কোর্সের ডিজাইন করতে পারব। বেসিসের ইতোমধ্যে বিআইটিএম নামে একটা ইনস্টিটিউট আছে। তাদের কাজ হলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে আসা এই গ্র্যাজুয়েটদের কর্মক্ষেত্রে
প্রবেশের আগ পর্যন্ত বিভিন্ন সাপোর্ট দেওয়া। এই প্রতিষ্ঠানকে সত্যিকারে সক্রিয় করতে হবে, যাতে এখান থেকে দক্ষ মানবসম্পদ বেরিয়ে আসা নিশ্চিত করা যায়।
সরকারের সঙ্গে কোলাবরেশন করেও কিছু কাজ করার সুযোগ আছে বেসিসের। বেসিস নিজেই তরুণ জনশক্তি ও নতুন তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারে। তাদের দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। এ ছাড়া সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকারের দুটি ভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সিসিপ ও অ্যাসেট নামে দুটি প্রকল্প আসছে। এ দুটি প্রকল্পই তথ্যপ্রযুক্তি খাতে প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ করবে। বেসিসের সুযোগ আছে এখানে সরকারের সঙ্গী হিসেবে কাজ করার।
এসব কিছু করার জন্য তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দরকার দৃঢ় নেতৃত্ব। সেই নেতৃত্বের পক্ষেই সম্ভব দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করে এ খাতকে সত্যিকারের একটি রপ্তানিমুখী শিল্পে পরিণত করা, যা শুধু দেশের চাহিদাই মেটাবে না, বৈদেশিক মুদ্রা আনতেও বড় ভূমিকা রাখবে।
নিয়াজ মোর্শেদ এলিট: তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা
এবং নির্বাহী পরিচালক, নগদ লিমিটেড
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।