আন্তর্জাতিক ডেস্ক : একসঙ্গে তিন বোন মিলে ঘুমন্ত অবস্থায় বাবাকে ছুরিকাঘাতে হত্যার ঘটনায় উত্তাল হয়ে ওঠেছে রাশিয়া। এর মধ্যেই ৩ লাখ মানুষ একটি পিটিশন সই করে তাদের মুক্তির আহ্বান জানিয়েছে। এই বোনদের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ থাকলেও তাদের ভবিষ্যত কী হবে, এ নিয়ে রাশিয়ায় ঘটনার পর থেকেই তুমুল বিতর্ক চলমান রয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, তারা অপরাধী নন, ভুক্তভোগী। কারণ নির্যাতনকারী বাবার কবল থেকে বাইরের সাহায্য চাওয়ার কোনো জায়গা বা সুরক্ষা তাদের ছিল না।
ঘটনার সূত্রপাত প্রায় এক বছর আগে। তখন ২০১৮ সালের ২৭ জুলাই। বাবা মিখাইল খাচাতুরান নিজ বাড়িতে ঘুমিয়ে ছিলেন। সে সময় একসঙ্গে তিন বোন ছুরিকাঘাতে তার বাবাকে হত্যা করেছিল। রাশিয়ার মস্কোর একটি ফ্ল্যাটে এ ঘটনা ঘটে। শুধু রাশিয়ায় নয়, গোটা বিশ্বে ওই হত্যাকাণ্ড আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
অনেকেরই ধারণা ছিল না, ঠিক কি কারণে তিন বোন মিলে ঘুমন্ত বাবাকে খুন করেছিল। পরে তদন্ত শুরু হলে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে খুনের নেপথ্যের প্রকৃত কারণ।
হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া তিন বোনের সেই সময়ের বয়স- ক্রিস্টিনা (১৯) অ্যাঞ্জেলিনা (১৮) এবং মারিয়া (১৭)। তাদের ভাষ্য, ঘটনার দিন তিন বোনের বাবা একে একে তাদেরকে ঘরে ডাকেন। এরপর ঘর পরিষ্কার না করার জন্য প্রচণ্ড গালমন্দ করেন এবং তাদের মুখে পিপার স্প্রে করেন।
এদিন রাতেই তিন বোন ঘুমন্ত বাবার ওপর ছুরি, হাতুড়ি এবং পিপার স্প্রে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা একসঙ্গে তাদের বাবার মাথা, ঘাড় ও বুকে কমপক্ষে ৩০টি আঘাত করে হত্যা করে। এরপরই তারা পুলিশকে খবর দেয়।
এদিকে শুধু বকাঝকার কারণেই বাবাকে এভাবে কেউ হত্যা করতে পারে, তদন্তকারী কর্মকর্তারা তা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। এরপরই নামেন তদন্তে। তখনই ওই পরিবারের পারিবারিক সহিংসতার দীর্ঘ ইতিহাস জানতে পারেন। তাদের তদন্তে টানা তিন বছর ধরে তাদের বাবা কিভাবে মারধোর করতেন, কয়েদিদের মতো আটকে রাখতেন এবং নিয়মিত তাদের ওপর যৌন অত্যাচার চালাতেন, সেসব ঘটনা ওঠে আসে।
পরে হত্যাকাণ্ডের পেছনের ঘটনা জানার পর রাশিয়ার অধিকাংশ মানুষই ওই তিন বোনের পক্ষ নেন। মানবাধিকার কর্মীরাও সোচ্চার হন। তারা মত দেন, তিন বোন অপরাধী নয়, তারা ঘটনার শিকার মাত্র। কারণ অত্যাচারী বাবার যৌন নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পেতেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের মুক্তির জন্য ওই সময় অনলাইনে তিন লাখেরও বেশি মানুষ স্বাক্ষর করেন।
জানা গেছে, রাশিয়ায় পারিবারিক সহিংসতা রোধে কোনো আইন নেই। ২০১৭ সালের একটা আইনে বলা হয়েছে, পরিবারের সদস্যরা মারধোর শিকার হয়েছেন, কিন্তু হাসপাতালে যাওয়ার মতো খারাপ অবস্থা করেননি- এমন অপরাধে জরিমানা বা সর্বোচ্চ দুই সপ্তাহ শাস্তি হতে পারে। দেশটিতে পারিবারিক সহিংসতাকে পারিবারিক বিষয় বলেই ভাবা হয়। এ কারণে পুলিশ সেখানে কোনো হস্তক্ষেপ করে না।
অন্যদিকে আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডটির মামলা খুব ধীরগতিতে এগুচ্ছে। অভিযুক্ত ওই তিন বোনকে কারাগারে না রাখলেও কড়া নজরদাড়িতে রাখা হয়েছে। তারা কোনো সাংবাদিক বা অন্য কারো সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলতে পারছেন না। তিন বোনের মানসিক চিকিৎসারও ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে বাদীপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মিখাইলকে হত্যা করা হয়। কারণ তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন এবং তিন বোন ছুরি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তাদের উদ্দেশ্যই ছিল প্রতিশোধ নেয়া।
অন্যদিকে আসামী পক্ষের আইনজীবীদের মতে, এ ঘটনা নিজেদের বাঁচাতেই তারা ঘটিয়েছে। রাশিয়ার আইনে নিজেকে বাঁচাতে তাৎক্ষণিক ‘আত্মরক্ষা’ আইন ছাড়াও ধারাবাহিকভাবে নির্যাতনের ক্ষেত্রে ‘আত্মরক্ষা’ আইন প্রচলিত রয়েছে।
আসামী পক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, তিন বোন দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এ কারণে তাদের মুক্তি দেয়া হোক। আত্মরক্ষা আইনে শিগগিরই তিনবোন মুক্তি পাবে বলে আশাপ্রকাশও করেছেন।
আইন বিশেষজ্ঞারা বলছেন, তিন বোনের বিরুদ্ধে আনা হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে তাদের সর্বোচ্চ ২০ বছরের সাজা হতে পারে।
এদিকে রাশিয়ার সাধারণ মানুষ ও মানবাধিকার কর্মীদের অনেকেই পারিবারিক সহিংসতা রোধে বিদ্যমান আইনটির পরিবর্তন হওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। সূত্র- বিবিসি
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।