উত্তরের জেলা রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও গাইবান্ধার নদী অববাহিকা থেকে নামতে শুরু করেছে পানি। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও দুর্ভোগ বেড়েছে উত্তরের তিস্তাপাড়ে মানুষের। রোপা আমন খেত পচে গলে নষ্ট হওয়ায় দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে তিস্তাপাড়ের কৃষকদের কপালে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় ভেসে উঠছে ক্ষত চিহ্ন। পানি কমতে থাকায় গত ২৪ ঘণ্টায় তিস্তার গর্ভে ৩৩টি বসতবাড়ি বিলীন হয়েছে বলে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের রংপুর অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আহসান হাবিব।
তিনি জানান, এই পাঁচ জেলায় ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে অন্তত ১৪৩টি বসতবাড়ি। এসব বসতবাড়ি দ্রুত সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একইভাবে গত ৪ দিনের বন্যায় এই ৫ জেলার ৩ হাজার ২০০ হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন, রংপুর কৃষি অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ শফিকুল ইসলাম। এ কর্মকর্তা জানান, চার দিনের বন্যায় পলি জমে সম্পন্ন ক্ষতি হতে পারে প্রায় ৩ হাজার হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসল, আংশিক ক্ষতি হতে পারে ৪ হাজার ৭০০ হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসল। যেসব কৃষক ক্ষতির মুখে পড়বে, তাদের প্রণোদনার আওতায় আনা হবে।
জানা গেছে, উজানের ঢল ও টানা ভারী বৃষ্টিতে হু হু করে বাড়ে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ। গেল সোমবার রাতে ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ বিপৎসীমা অতিক্রম করে। গত মঙ্গলবার সকাল থেকে বন্যায় প্লাবিত হয় তিস্তা নদীর বাম তীরের জেলা লালমনিরহাটের ৫টি উপজেলা অধিকাংশ এলাকা। টানা ৪ দিনের বন্যায় ডুবে যায় নদী তীরবর্তী অঞ্চলের ফসলি খেত। পানিবন্দি হয়ে পড়ে ৫ জেলার প্রায় ৪০ হাজার পরিবার। পানির তোরে ভেসে গেছে মৎস্যচাষিদের পুকুরের মাছ। বিশেষ করে আমন খেত ও বীজতলা ডুবে যাওয়ায় কৃষিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে তিস্তাপাড়ে। গতকাল পানি কমে গেলে জেগে উঠে বন্যার ক্ষত।
আমনের লাগানো চারা বন্যার পানিতে পচে গলে নষ্ট হয়েছে। অধিকাংশ খেতে শুধু মাটি বালু পড়ে রয়েছে, নেই কোনো আমনের চারা। কিছু খেতে চারা গাছ দেখা গেলেও গতকার প্রচ- রোদে তা গলে পচে নষ্ট হচ্ছে। মাত্র এক সপ্তাহ আগে দ্বিতীয় দফার বন্যায় নষ্ট হওয়া আমন খেতে নতুন করে চারা লাগান নদীপাড়ের কৃষকেরা। সেটাও তৃতীয় দফার বন্যায় ৩-৪ দিন ডুবে থেকে নষ্ট হয়েছে। নতুন করে লাগানোর মতো চারা নেই অধিকাংশ চাষির। ফলে আমন নিয়ে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে তিস্তাপাড়ের চাষিদের কপালে।
টানা তিন-চার দিন পর বাড়িঘর থেকে বন্যার পানি নেমে গেলেও দুর্ভোগ কমেনি নদীপাড়ে। পানির তোড়ে নষ্ট হওয়া ঘরবাড়ি বেড়া মেরামত করছেন। বন্যার পানির সঙ্গে ভেসে আসা ময়লা আবর্জনা ডুকে পড়েছে প্রতিটি বাড়িতে। ঝোপঝাড়ে আশ্রয় নিয়েছে সাপ-পোকামাকড়। এসব সংস্কার করতে ব্যস্থ সময় যাচ্ছে পানিবন্দি পরিবারগুলো। বন্যার পানিতে অনেকের গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র ভিজে নষ্ট হয়েছে। বন্যার পানিতে ডুবে নষ্ট হয়েছে নদীপাড়ের বেশ কিছু বিদ্যালয়ের আসবাবপত্র।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, তৃতীয় দফার বন্যায় ৫ জেলার ৪ হাজার ৭১৫ হেক্টর জমির আমন খেতে ও অন্যান্য ফসল নিমজ্জিত হয়েছে। যার সামান্য কিছু নষ্ট হলেও নতুন করে রোপণ করার সময় রয়েছে। তবে কৃষি বিভাগে এ তথ্য মানতে নারাজ স্থানীয় চাষিরা। তাদের মতে, শুধু নদী পাড়ে বন্যায় ফসল খেত ডুবেনি। টানা ভারী বৃষ্টিতে এই ৫ জেলার নিম্নাঞ্চলের খেত ডুবেছে। পানিতে তলিয়ে আছে ৪-৫ দিন ধরে। ফলে কৃষিতে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি বলে দাবি চাষিদের।
হাতীবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারী ইউনিয়নের কৃষক আব্দুর রহমান বলেন, ‘আমরা অনেক কষ্ট করে চাষাবাদ করি। কিছু দিন আগে একবার বন্যায় ডুবে গিয়ে আমার ৩ বিঘা জমির আমন ধান নষ্ট হয়েছিল। চারা ক্রয় করে দ্বিতীয় দফায় রোপণ করেছিলাম। সেটাও এক সপ্তাহের ব্যবধানের বন্যার পানিতে ডুবে নষ্ট হলো। এখন চারা কেনার টাকাও নেই। চারা রোপণ না করলে পরিবার খাবে কী? আমরা কীভাবে বাঁচব জানি না।’
তিস্তাপাড়ের বাসিন্দা মর্জিনা বেগম বলেন, ‘তিস্তা আমাদের সর্বনাশ করে দিয়েছে। বছরের পর বছর চাষাবাদে অনেক খরচ করেও আমরা লাভবান হতে পারি না, যা আবাদ করি, ঠিকমতো তার দাম পাই না। কিন্তু এবারের বন্যায় আমাদের সবকিছু শেষ করে দিল। সামনের দিনগুলো কেমন যাবে, আমরা কীভাবে বাঁচব, সেটা কেউই জানি না। ত্রাণসহ তিস্তার স্থায়ী বাঁধ চাই।’
গতকাল তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া পয়েন্টে দিনভর বিপৎসীমার নিচে প্রবাহিত হয়। ফলে বন্যা পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। তিস্তা নদীতে পানি কমে যাওয়ায় বেড়ে ভাঙন। তিস্তা নদীর বাম তীরে বেশ কয়েকটি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। কালীগঞ্জে দক্ষিণ ভোটমারী, হাতীবান্ধার সিন্দুর্না এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে সিন্দুর্না সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ অসংখ্যা বসতভিটা ফসলি জমি আর স্থাপনা। তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে, রংপুরের গংগাচড়া, পীরগাছা, রাজারহাট, নীলফামারীর ডিমলা, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ২৩টি পয়েন্টে ।
সিন্দুর্না ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আরিফুর ইসলাম বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের তিস্তা চরের আমন খেতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বন্যার পানি নেমে গেলে বেড়েছে ভাঙন। চরাঞ্চলের সিন্দুর্না সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নদীভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে। ভাঙন রোধে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান তিনি।’
কৃষি কর্মকর্তারা বলেন, বন্যার পানিতে ডুবে থাকায় আমন খেত সামান্য কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে নদীপাড়ের চাষিরা বন্যাকালীন আপনাদের জন্য উঁচু এলাকায় আমনের বলান করে রাখেন। পানি নেমে গেছে নষ্ট হওয়া খেতে সেই আমনের বলান করা চারা রোপণ করতে চাষিদের প্রতি পরামর্শ দেন তিনি। আমনের চারা রোপণের এখনো সময় রয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড রংপুর অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আহসান হাবিব বলেন, তিস্তা নদীর পানি কমে যাওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। পানিবন্দি পরিবারগুলোর মুক্তি মিলেছে। পানি কমলে নদীতে ভাঙন দেখা দেয়। সেদিক থেকে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে নদীপাড়ে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।