কনকনে শীতে কাঁপছে কুড়িগ্রামের চরাঞ্চল
জুমবাংলা ডেস্ক : কুড়িগ্রাম শহরের ঘোষপাড়ার হোটেল শ্রমিক মালেক। কনকনে ঠান্ডার কারণে কয়েক দিন ধরে কাজে যেতে পারছেন না।
বুধবার তিনি বলেন, ‘মহাজন ভোর থাকি কামোত আসপের কয়। এই ঠান্ডাত কেমন করি বাড়ি থাকি বের হই। ঠান্ডা পানি নাড়তে নাড়তে গাত জ্বর ধরছে।’
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের শীপেরপাচি গ্রামে মাটি কেটে জীবন নির্বাহ করেন বিধবা নারী মালেকা বেওয়া। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘বাবারে কাঁইয়ো খোঁজও নিলে না, একটা কম্বলও দিলে না।’ চর কুড়িগ্রামের অটোরিকশাচালক জয়নাল বলেন, ‘ঠান্ডাত হাত-পাও শিক নাগি যায়। কাঁশতে কাঁশতে অবস্থা খারাপ। দুদিন বসি আছলং। পেটের দায়ে ফির অটো নিয়া বেরাইছি।’ জেলার দরিদ্র, খেটে খাওয়া ছিন্নমূল মানুষের অবস্থা এমনই। বিশেষ করে দুর্গম চরাঞ্চলের মানুষ শীতে কাঁপছে। তাদের গরম কাপড় নেই। ঠান্ডায় কাজে যেতে না পারায় হাতে নেই টাকা। ফলে চরম কষ্টে দিন কাটছে। তাদের অভিযোগ, শীতবস্ত্রের সরকারি বরাদ্দ খুবই কম। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক দল বা বেসরকারি সংস্থা তাদের পাশে দাঁড়ায়নি। উল্টো জেলার উলিপুরে সরকারি বরাদ্দের কম্বল ভাগ-ভাটোয়ার অভিযোগ উঠেছে।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর মিয়া জানান, প্রতিবছর চরের মানুষ কমবেশি সহযোগিতা পেলেও এবার তেমন সাড়া মিলছে না। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের ৫ শতাধিক কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। যারা পায়নি তারা পরিষদে এসে ভিড় করছেন।
স্থানীয় সমাজসেবী আবুল হোসেন বলেন, যাত্রাপুর ইউনিয়নের পার্শ্ববর্তী শিপেরপাচী, খাসেরচর, পোড়ারচর ও চর পার্বতীপুরে ৫ শতাধিক দরিদ্র পরিবার আছে। যারা প্রতিদিন শীতবস্ত্রের জন্য নদী পার হয়ে মেইনল্যান্ডে ভিড় করছেন। কিন্তু এবার কেউ তাদের পাশে দাঁড়ায়নি।
শিপেরপাচীর বুদ্ধি প্রতিবন্ধী লোকমান ও বিধবা মালেকা জানান, চরে প্রায় ১৫০টি খানা রয়েছে। এখন পর্যন্ত কেউ শীতবস্ত্র বিতরণ করেনি। খাসের চরের দিনমজুর ছুরমান ও মজিবর বলেন, নদী ভাঙার পর আমরা ৪০টি পরিবার এখানে আশ্রয় নিয়েছি। আমাদের কেউ কোনো খোঁজখবর নেয়নি। একই কথা জানান পোড়ারচরের শরীফুল মাস্টার ও মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা নাদু শেখ।
হলোখানা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম রেজা বলেন, টানা শৈত্যপ্রবাহের ফলে নিম্ন আয়ের মানুষের খুব সমস্যা হচ্ছে। তারা কাজে যেতে পারছে না। প্রতিবছর বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বৃত্তবানরা গরম কাপড় দিয়ে সহায়তা করলেও এবার কোনো সাড়া মিলছে না। বিশেষ করে শিশুদের জন্য গড়ম কাপড় ও নারীদের চাদরের চাহিদা রয়েছে। সরকারি বরাদ্দও একেবারে অপ্রতুল।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আব্দুল হাই সরকার জানান, ডিসেম্বরে ৭৩টি ইউনিয়ন ও তিনটি পৌরসভায় ৫শ’র মতো করে মোট ৩৮ হাজার কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। নতুন করে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে এক লাখ কম্বল এবং ১০ হাজার শিশু পোশাক। এর মধ্যে ১৫ হাজার কম্বল বরাদ্দের চিঠি পেয়েছি কিন্তু এখন পর্যন্ত কম্বল পৌঁছেনি। এ ছাড়াও বেসরকারিভাবে প্রাপ্ত ২ হাজার কম্বল বিভিন্ন পিছিয়ে পরা জনগোষ্ঠীর মাঝে বিতরণ করা হয়েছে।
রাজারহাট আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তুহিন মিয়া জানান, বুধবার সকালে জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে এ অঞ্চলের তাপমাত্রা ৯ থেকে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে।
জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সাঈদ হাসান লোবান বলেন, সরকারিভাবে শীতবস্ত্র বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। আর দলগতভাবে আমরা এখনো শীতবস্ত্র বিতরণ করতে পারিনি। তবে পরিকল্পনা রয়েছে সব ইউনিয়নে প্রতি বছরের মতো এবারও শীতবস্ত্র বিতরণ করা হবে।
জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক সোহেল হোসনাইন কায়কোবাদ সোহেল বলেন, সরকারের দায়িত্ব এসব অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো। কিন্তু সরকার সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা খুব শিগগিরই সাধ্যমতো শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়াব।
উলিপুর (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি জানান উপজেলা দুর্যোগ ও ত্রাণ অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ডিসেম্বরে এ উপজেলার জন্য ৭ হাজার কম্বল আসে। ৫০০টি করে কম্বল উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার জন্য। কিন্তু ইউনিয়নগুলোতে ৫০০ পিস কম্বলের পরিবর্তে ২৮৫ পিস করে বিতরণ করা হয়েছে। স্থানীয় সংসদ-সদস্যকে ৪০০ পিস, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানকে ৩০০ পিস, পুরুষ ও মহিলা উপজেলা পরিষদ ভাইস চেয়ারম্যানদের ৩০০ পিস করে দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে উলিপুর পৌরসভার মেয়র মামুন সরকার মিঠু বলেন, প্রথমে উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অফিস থেকে জানানো হয় পৌরসভার জন্য ৫০০ কম্বল বরাদ্দ রয়েছে। পরে কম্বল নিতে গেলে ২৮৫টি কম্বল নিতে বলে। এ কারণে কম্বল উত্তোলন করা হয়নি। বিভিন্নভাবে বরাদ্দের কম্বল ভাগ-বাটোয়ারা করা হয়েছে।
উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ কর্মকর্তা সিরাজদৌল্লা বলেন, এমপি স্যার, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, ইতিমখানাসহ বিভিন্ন গণ্যমান্য ব্যক্তি সংগঠন সবাইকে দিতে হয়। এ কারণে ইউনিয়নগুলোতে কম্বল কম দেওয়া হয়েছে।
উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম হোসেন মন্টু বলেন, এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে ৭ হাজার কম্বল পাওয়া গেছে। কিছু কম্বল ইউনিয়নগুলোতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আর কিছু কম্বল রাখা হয়েছে। বিভিন্নভাবে ছিন্নমুল মানুষ আসে তাদেরকে দেওয়ার জন্য।
এ বিষয়ে কুড়িগ্রাম-৩ আসনের সংসদ-সদস্য অধ্যাপক এমএ মতিন জানান, কিছু কম্বল বয়স্কদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে আরও ২-৩ হাজার কম্বল কিনে তা বিতরণ করবেন তিনি।
চিলমারী প্রতিনিধি জানান, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. রুকুনুজ্জামান শাহীন বলেছেন, সরকারিভাবে উপজেলায় মোট ৩ হাজার কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়াও তিনি শীতার্তদের মাঝে ২০০ কম্বল বিতরণ করেছেন।
ফুলবাড়ী প্রতিনিধি জানান, উপজেলা প্রশাসনের ত্রাণ শাখা ৩ দিনে প্রায় ৩ হাজার শীতার্ত দরিদ্র পরিবারের মাঝে কম্বল বিতরণ করেছে।
নাগেশ্বরী প্রতিনিধি জানান, কুড়িগ্রাম-১ আসনের সংসদ-সদস্য আছলাম হোসেন সওদাগর বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে ৫০০ কম্বল বিতরণ করেছি। কিন্তু চাহিদা আরও অনেক বেশি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।