গরমের সময় সারা দিনের পরিশ্রম শেষে ঘরে ফিরেই অনেকে এক গ্লাস পানি খোঁজেন। ঠান্ডা পানি হলে তো কথাই নেই। তৃষ্ণার্ত অবস্থায় পানির চেয়ে স্বস্তিদায়ক আর কিছু হয় না। এক গ্লাস পানি দিনের কষ্ট যেন নিমিষেই কমিয়ে দেয়। পানি পান করা মাত্রই একধরনের প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ে সারা দেহে।
বিষয়টা এত স্বাভাবিক যে আমরা আলাদা করে এটা নিয়ে ভাবিও না। তৃষ্ণার্ত না থাকলে পানি এত সুস্বাদু লাগে না। কিন্তু কেন এমন হয়? এর কারণ খুঁজতে গেলে শরীরের ভেতরের বেশকিছু চমৎকার কাজকর্ম দেখতে পাবো আমরা। তবে সে আলাপে যাওয়ার আগে জানা দরকার আমরা কেন তৃষ্ণার্ত হই।
বয়সভেদে মানুষের শরীরের ৫০-৭৫ ভাগ পানি থাকে। শরীর ঠিকভাবে কাজ করার জন্য পানি অত্যন্ত জরুরি। মস্তিষ্ক এই বিষয়টা খুব গুরুত্বের সঙ্গে খেয়াল রাখে। শারীরিক পরিশ্রম করলে কিংবা পরিবেশের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে আমাদের শরীর ঘামে। তখন শরীর থেকে লবণ ও পানি বেরিয়ে যায়। কমে রক্তের পরিমাণ। মস্তিষ্কের বেশিরভাগ অঞ্চল একটি অর্ধভেদ্য পর্দার সাহায্যে পরস্পর থেকে আলাদা থাকে। একে ইংরেজিতে বলে ব্লাড-ব্রেইন বেরিয়ার।
এটা মস্তিষ্ককে বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থ এবং রোগজীবাণুর হাত থেকে সুরক্ষা দেয়। তবে মস্তিষ্কের কিছু অংশ পর্দার বাইরে উন্মুক্ত অবস্থায় থাকে। ফলে শরীরে রক্তের মধ্যে কোনো পরিবর্তন হলে তাৎক্ষণিকভাবে তা শনাক্ত করতে পারে এ অংশগুলো। শারীরিক পরিশ্রম অথবা অতিরিক্ত লবণাক্ত খাবার খাওয়ার ফলে রক্তের আয়তন কমে গেলে মস্তিষ্কের এসব অংশের কোষগুলো সিগন্যাল পাঠানো শুরু করে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে। তাতে মুখের ভেতরটা শুকিয়ে যায়। শুকিয়ে আসে গলাটাও। তৈরি হয় তৃষ্ণা বোধ।
এই দ্রুত প্রতিক্রিয়া বেঁচে থাকার জন্য খুব জরুরি। এই প্রতিক্রিয়া শুরু হতে দেরি হলে মানুষ পানিশূন্যতায় ভুগতে পারে।—এমনটা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির জীববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ইউকি ওকা।
সাবফনিক্যাল অর্গান বা এসএফও, অর্গানাম ভাস্কুলোসাম লামিনা টারমিনালি বা ওভিএলটি এবং মেডিয়ান প্রিঅপটিক নিউক্লিয়াস বা এমএনওপি—মস্তিষ্কের এই তিনটি অংশ তৃষ্ণার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে। এসএফও এবং ওবিএলটি— অংশ দুটি মস্তিষ্কের ব্লাড-ব্রেইন বেরিয়ারের বাইরে থাকে।
২০১৮ সালে অধ্যাপক ওকা ইঁদুরের মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা করে এটি আবিষ্কার করেন। এ অংশগুলোর স্নায়ুকোষ বা নিউরন উত্তেজিত হলে তৃষ্ণা বোধ তৈরি হয়। এখানে এমএনওপি অংশটি পুরো প্রক্রিয়ায় মধ্যে বার্তাবাহকের ভূমিকা পালন করে। এসএফও এবং ওভিএলটি থেকে তৃষ্ণার্ত অনুভূতির সিগন্যাল শরীরের বিভিন্ন অংশে পৌঁছায়।
পানি পান করার পর শরীরের কোষে তা শোষিত হওয়ার জন্য ১৫-২০ মিনিট সময় লাগে। সে ক্ষেত্রে কিন্তু পানি খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই স্বস্তি লাগার কথা নয়। এখানেই একটু চালাকি করে আমাদের দেহ। ভেতরে পানি প্রবেশ করা মাত্র শরীর মস্তিষ্ককে নতুন সংকেত পাঠানো শুরু করে। বলতে থাকে, পানি শূন্য হওয়ার আগেই সে পানি গ্রহণ করা শুরু করেছে। প্রথম চুমুকেই মস্তিষ্ক যখন এই সিগন্যাল পায়, তখন সে ডোপামিন রিলিজ করা শুরু করে।
মানুষের আনন্দ অনুভূতি ও অনুপ্রেরণার পেছনে ডোপামিনের ভূমিকা রয়েছে বলে একমত বেশিরভাগ বিজ্ঞানীরা। অনেকের মতে, ডোপামিন প্রাণীদের এমন সব কাজে শক্তি ব্যয় করতে অনুপ্রেরণা দেয়, যেগুলো থেকে সরাসরি আমরা আনন্দ পাই বা বেঁচে থাকার জন্য কাজগুলো করা জরুরি। খাবার খাওয়া বা পানি পান করাও এর মধ্যে পরে। যখন নির্দিষ্ট কোনো কাজের কারণে ডোপামিন নিঃসরণ হয়, তখন প্রাণী ওই কাজটি বারবার করে করতে থাকে। এটা ইতিবাচক সিগন্যাল।
পানি পান করার মাধ্যমে ঠিক কীভাবে ডোপামিন নিঃসৃত হয়, তা এখনো অজানা। কিন্তু ২০১৯ সালে নিউরন জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে অধ্যাপক ওকা এবং তাঁর সহকর্মীরা দেখান, তৃষ্ণার্ত ইঁদুর পানি পান করলে ওদের মস্তিষ্ক থেকে ডোপামিন নিসৃত হয়। কিন্তু সরাসরি ইঁদুরের পেটে পানি গেলে ডোপামিন নিসৃত হয় না।
অর্থাৎ, তৃষ্ণার্ত অবস্থায় পানি পান করলে আমাদের মধ্যে যে তৃপ্তি কাজ করে, তা ডোপামিনের মতো নিউরোট্রান্সমিটার নিঃসৃত হওয়ার কারণেই হয়। ফলে একই পানি অন্য সময় পান করে আমরা সমান স্বাদ বা আনন্দ অনুভব করতে পারি না।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।