১৯৫০ সালের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম পারমাণবিক যুগে প্রবেশ করে। ১৯৪০-এর দশকে ওয়াশিংটনে নির্মিত হয় হ্যানফোর্ড পারমাণবিক কেন্দ্র। ম্যানহাটন প্রকল্পের অংশ হিসেবে নির্মিত এই হ্যানফোর্ড ছিল পারমাণবিক অস্ত্রের জন্য অপরিহার্য প্লুটোনিয়াম উৎপাদন কেন্দ্র।
প্রতি কিলোগ্রাম প্লুটোনিয়াম তৈরির জন্য হাজার গ্যালন তেজস্ক্রিয় বর্জ্য তৈরি হতো এখানে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা মনে করেছিলেন, এই বর্জ্য থেকেও মুনাফা অর্জন করা সম্ভব। কিন্তু তেজস্ক্রিয় বর্জ্য থেকে মুনাফা অর্জনের এ চেষ্টা ব্যর্থ হয়। বিষাক্ত বর্জ্য সঠিকভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থাও ছিল না সেখানে। এই অবহেলার পরিণাম ছিল ভয়াবহ। বছরের পর বছর অস্থায়ী ভূগর্ভস্থ বর্জ্যের ট্যাঙ্কগুলো ধীরে ধীরে স্থায়ী হয়ে ওঠে। পরে তাতে ফাটল ধরে এবং বিষাক্ত তেজস্ক্রিয় পদার্থ মাটিতে মিশে যায়। পারমাণবিক শক্তি কমিশনও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কোনো আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়।
কিরগিজস্তানের একটি শহর মেইলু-সু। এককালে পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার জন্য ব্যবহৃত হতো শহরটি। কারণ, প্রাকৃতিকভাবেই এই এলাকা ছিল ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন এখানে খনন কাজ শুরু করে এবং খনি থেকে উত্তোলিত ইউরেনিয়াম ব্যবহার করে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য।
খনন কাজের সময় প্রচুর তেজস্ক্রিয় বর্জ্য উৎপন্ন হয়। সেগুলো শহরের চারপাশে মাটি চাপা দিয়ে এবং কূপ বানিয়ে রাখা হতো। প্রায় দুই মিলিয়ন ঘনমিটার তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ২৩টি ভিন্ন ডাম্পিং সাইটে ফেলে রাখা হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে পরিবেশ দূষণ করতে থাকে সেগুলো। ১৯৯২ সালে ভূমিধ্বসে একটি বর্জ্য-কূপ ভেঙে ১ হাজার ঘনমিটার তেজস্ক্রিয় পদার্থ নদীতে মিশে যায়।
২০১১ সালে জাপানের প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। ফলে ফুকুশিমা দাইচি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিধ্বংসী আঘাত হানে ৫০ ফুট উচ্চতার সুনামি! বিদ্যুৎকেন্দ্রের নকশা অনুযায়ী, বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেটা বন্ধ হওয়ার ব্যবস্থা ছিল।
কিন্তু এত ভয়ংকর দুর্ঘটনার কথা সে সময় কেউ কল্পনা করেনি। ভূমিকম্প ও সুনামির যুগ্ম আঘাতে ভয়ংকরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। ভূমিকম্পের ফলে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার পর জরুরি জেনারেটরগুলো চুল্লিগুলোকে ঠান্ডা রাখতে ব্যর্থ হয়। ফলে গলতে শুরু করে তেজস্ক্রিয় জ্বালানি এবং পরে বিস্ফোরণ ঘটে। তিনটি সক্রিয় চুল্লি থেকে তেজস্ক্রিয় পদার্থ ছড়িয়ে পড়ে বায়ুমণ্ডলে।
১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল ইতিহাসের ভয়ঙ্করতম অধ্যায়ের সাক্ষী হয় চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। একটি পরীক্ষার কারণে ভয়াবহ এ বিপর্যয়ের সূচনা হয়। এক্সটার্নাল পাওয়ার এবং কুল্যান্ট বা শীতক পাইপে একই সঙ্গে সমস্যা দেখা দিলেও স্টিম বা বাষ্পীয় টারবাইন ইমার্জেন্সি ফিডওয়াটার পাম্প, অর্থাৎ নিরাপদ শীতলীকরণ ব্যবস্থা কতটুকু যথাযথভাবে চালাতে পারে, এ নিয়ে সেদিন গভীর রাতে কেন্দ্রের চতুর্থ চুল্লিতে একটি পরীক্ষা চালানো হয়।
কিন্তু কর্মীদের ভুলে এ সময় বিদ্যুৎকেন্দ্রের পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় বন্ধ হয়ে যায় পারমাণবিক চুল্লিও। ফলে কর্মীরা রিঅ্যাক্ট্যার রিস্টার্ট দেয় টারবাইন টেস্টের জন্য। এ সময় তারা কন্ট্রোল রড যেভাবে ব্যবহার করা উচিত নয়, সেরকম একটি কনফিগারেশনে রিঅ্যাক্টর চালু করে। পরীক্ষা শেষে রিঅ্যাক্টর পুরোপুরি বন্ধ বা শাটডাউন করে দেওয়া হয় রক্ষণাবেক্ষণের জন্য। এ সময় বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটে রিঅ্যাক্টরে, নষ্ট হয়ে যায় শীতলীকরণ ব্যবস্থা। ফলে উত্তপ্ত হতে থাকে চুল্লি। এই উত্তাপের কারণে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে।
সাইবেরিয়ান কেমিক্যাল কম্বাইন ছিল সাইবেরিয়ার একটি পুরোনো ইউরেনিয়াম-সমৃদ্ধি কারখানা। দীর্ঘদিন ধরে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য সংরক্ষণের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছিল এতে। সোভিয়েত আমলে এই পদ্ধতিতে কারখানার তরল তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ভূগর্ভস্থ পানির কূপে ফেলে দেওয়া হতো। ১৯৯৩ সালে কারখানার রেডিও-টেকনোলজি প্ল্যান্টে একটি বিস্ফোরণ ঘটে। ফলে এ কেন্দ্রের দুই তলা ভবন ধ্বসে যায়। প্লুটোনিয়াম ও ইউরেনিয়ামের ট্যাঙ্ক দুটি ধ্বংস হয়ে গেলে এই দুর্ঘটনা আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।