ফারুক তাহের: প্রাচীন বাংলার রাজধানী গৌড়ের ফিরোজপুরে শান্ত স্নিগ্ধ সবুজ সমতলে স্থাপিত ‘দারাসবাড়ি মসজিদ’। গৌড়ের তখনকার শাসক সুলতান শামস উদ্দীন ইউসুফ শাহের আদেশে ১৪৭৯ খ্রিষ্টাব্দে এটি নির্মাণ করা হয়। তখন এর নাম ছিল ফিরোজপুর মসজিদ।
পঞ্চদশ শতাব্দীতে ওই এলাকার শাসক নিযুক্ত হন সুলতান হোসেন শাহ। মসজিদের অদূরে হোসেন শাহ এর নির্দেশে ১৫০২ খ্রিষ্টাব্দে নির্মাণ করা হয় দারাসবাড়ি মাদ্রাসা। আরবি দরস অর্থ পাঠ। তাই তৎকালীন শিক্ষাঙ্গনকে বলা হতো দারসবাড়ি বা দারাসবাড়ি।
দারাসবাড়ির সুনাম, সুখ্যাতিতে এলাকার নামের সঙ্গে পাল্টে যায় মসজিদের নামও। পরিচিত হয় ‘দারাসবাড়ি মসজিদ’ নামে।
সমকালীন স্থাপত্যের বিচারে মসজিদটির আয়তন বেশ বড়। যার দৈর্ঘ্যে ৯৯ ফুট ৫ ইঞ্চি, প্রস্থে ৩৪ ফুট ৯ ইঞ্চি। সঙ্গে যুক্ত ১০ ফুট সাত ইঞ্চির একটি বারান্দা। পশ্চিমে কারুকার্য খচিত ৯টি মেহরাব। আর উত্তর এবং দক্ষিণে ৩টি করে জানালা। নির্মাণশৈলী থেকে ধারণা করা যায় যে, এতে মহিলাদের জন্য আলাদা নামাজের ব্যবস্থাও ছিল।
ঐতিহাসিক অনুসন্ধিৎসু মুনশী এলাহী বখশ কর্তৃক আবিস্কৃত একটি আরবী শিলালিপি অনুযায়ী (লিপি-দৈর্ঘ্য ১১ ফুট ৩ ইঞ্চি, প্রস্থ ২ফুট ১ ইঞ্চি) ১৪৭৯ খ্রিস্টাব্দে (হিজরী ৮৮৪) সুলতান শামস উদ্দীন ইউসুফ শাহের রাজত্বকালে তাঁরই আদেশক্রমে এই মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়। বারান্দার খিলানে ৭টি প্রস্থর স্তম্ভের উপরের ৬টি ক্ষুদ্রাকৃতি গম্বুজ এবং মধ্যবর্তীটি অপেক্ষাকৃত বড় ছিল। উপরে ৯টি গম্বুজের চিহ্নাবশেষ রয়েছে। উত্তর দক্ষিণে ৩টি করে জানালা ছিল। উত্তর পশ্চিম কোণে মহিলাদের নামাজের জন্য প্রস্থর স্তম্ভের উপরে একটি ছাদ ছিল। এর পরিচয় স্বরূপ এখনও একটি মেহরাব রয়েছে।
দারাসবাড়ি মসজিদটি বাংলার প্রথম যুগের মুসলিম স্থাপত্যকীর্তির এক উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। এখানে প্রাপ্ত তোগরা অক্ষরে উৎকীর্ণ ইউসুফি শাহী লিপিটি এখন কলকাতা যাদুঘরে রক্ষিত আছে। জেনারেল ক্যানিংহাম তার নিজের ভাষাতে এই মসজিদের কথা উল্লেখ করেছেন।
প্রাচীন এই মসজিদের চারপার্শ্বে দেয়াল ও কয়েকটি প্রস্তর স্তম্ভের মূলদেশ ব্যতীত আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে ছাদ ও গম্বুজ। চারপাশের দেওয়ালও জৌলুস হারিয়ে অযত্নে, অবহেলায় পড়ে আছে প্রাচীন ইতিহাসের এই অনন্য মসজিদটি। তবে যা কিছু অবশিষ্ট রয়েছে সেগুলোর পরতে পরতে রয়েছে সৌন্দর্যের ছোঁয়া আর বাহারি কারুকাজ।
মনের অবসাদ দূর করতে ভ্রমণ বা বিনোদনের কোনো বিকল্প নেই। আর তা যদি হয় কোনও প্রাচীন মসজিদ, তবে তো কথা–ই নেই। যান্ত্রিক জীবনে শতব্যস্ততার বাইরে ভ্রমণপ্রেমীদের জন্য আদর্শ ভ্রমণ স্থান হতে পারে দারাসবাড়ি মসজিদ। এই মসজিদের সৌন্দর্য এবং এর চারপাশের নির্মল পরিবেশ এখনও মুগ্ধ করবে যে কাউকেই। বয়স সাড়ে পাঁচ শত বছর হলেও অপূর্ব সৌন্দর্যের কারুকার্য খচিত মসজিদটির অবশিষ্টাংশ এখনও জৌলুস ছড়াচ্ছে-যা দেখার জন্য হলেও যেতে পারেন।
দারসবাড়ি মসজিদ বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত ঘেঁষা আমের রাজধানী খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। মহানন্দার তীর ধরে কয়েক কিলোমিটার ভেতরে। সোনামসজিদ স্থলবন্দরের অতি সন্নিকটে। মসজিদটির পাশে রয়েছে বিশাল এক দিঘি। দিঘির এপারে মসজিদ। ওপারে দারাসবাড়ি মাদ্রাসা। ভ্রমণপিপাসুদের পিপাসা মুহূর্তের মধ্যে মিটিয়ে দেবে প্রাচীন মসজিদ ও মাদ্রাসার সৌন্দর্য।
এক সময় এ মসজিদের মিনার থেকে মোয়াজ্জিনের সুমধুর আজান ভেসে আসত। মাদ্রাসার শত শত আবাসিক শিক্ষার্থী ও আশপাশের মুসল্লীরা জামাতে আদায় করতেন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ। কিন্তু আজ আর সেই সবের কিছুই নেই। এখান থেকে ভেসে আসে না আর আজানের ধ্বনি। জনমানবহীন এক নির্মল পরিবেশে ছাদহীন নিরালায় দাঁড়িয়ে আছে দারাসবাড়ি মসজিদ। এখন আর ভেসে আসে না কুরআনের ধ্বনি। শেষ রাতে কেউ আর বলে ওঠে না, ‘আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম।’
কালের আবর্তে এক সময়ের সজিব এই মুসলিম স্থাপত্য আজ অস্থিত্ব রক্ষার আকুতি করছে।
লেখক: আবাসিক সম্পাদক, জুমবাংলা.কম
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।