রানা সরকার: গতরাতের ঢাকায় নেমেছিল ঝুম বৃষ্টি। সেই অঝোর বর্ষণের মধ্যেই গোপালগঞ্জের পথে যাত্রা শুরু করি আমরা। বৃষ্টির তীব্রতা যেন বাড়তেই থাকছিল, ড্রাইভিং হয়ে উঠছিল কঠিন, কিন্তু পিছু ফেরার কোনো সুযোগ ছিল না— কারণ এ যাত্রা শুধু কোনো শহর দর্শনের নয়, ছিল ন্যায় বিচারের প্রশ্নে এক নীরব অথচ গভীর প্রতিবাদের অংশ।
রাতের শেষ প্রহরে থামলাম খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন সাড়ে তিনটা বাজে। আমরা দাঁড়িয়ে আছি শহীদ মীর মুগ্ধ তোরণের সামনে। চারপাশে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, হিমেল বাতাস। বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা গায়ে পড়তেই মনে পড়ে যাচ্ছিল মীর মুগ্ধর সেই শেষ কথা— “পানি লাগবে, পানি।” বুকের ভিতর হঠাৎ অজানা ব্যথা কেঁদে উঠলো। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না।
ফজরের আজানের পর আমরা রওনা হলাম সাতক্ষীরার দিকে— নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ আসিফ ভাইয়ের বাড়ি। আমাদের দেখে তাঁর বাবা আর ছোট ভাই চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না। কবর জিয়ারতের সময় তাঁর মা হঠাৎ কেঁদে উঠলেন, বললেন—
“আমার পাগলটা তো আর এমন ভোরে ঢাকা থেকে আসে না রে বাবা… আমার হাতে রান্না ভাত খায় না আর। তোমাদের দেখলেই আসিফের কথা মনে পড়ে।”
চোখ ভিজে যাচ্ছিল আমাদের। তাঁর বাবা উঠানের পেয়ারা গাছ দেখিয়ে বললেন—
“এই গাছটা আসিফ লাগাইছিলো, দেখতেছো কত পেয়ারা ধরছে!”
কান্না লুকোতে পারিনি। হঠাৎ আসিফ ভাইয়ের যমজ ভাই জিজ্ঞেস করলো,
“ভাই, আমার ভাইয়ের খুনের বিচার কবে হবে?”
মাটির দিকে তাকিয়ে কেবল বলতে পারলাম— “হবে ইনশাআল্লাহ।” অথচ বুকের ভেতর গুমরে উঠছিল এক বেদনাময় প্রশ্ন— কবে? আর কতকাল?
সাতক্ষীরা ছাড়তেই আবার ঝুম বৃষ্টি। এবার গন্তব্য যশোর— সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ জাবির ভাইয়ের বাড়ি। জুমার নামাজের ঠিক আগে পৌঁছাই। নামাজ শেষে মসজিদের পাশে জাবির ভাইয়ের কবর জিয়ারত করি বৃষ্টিভেজা মাটির ওপর দাঁড়িয়ে।
জাবির ভাইয়ের মায়ের সাথে দেখা হলো। কথা বলতে বলতে হঠাৎই তিনি জড়িয়ে ধরে হাহাকার করে কাঁদতে লাগলেন। কান্নায় কেঁপে উঠলেন তাঁর বাবাও। আমরা যেন এক বুক দুঃখ, দীর্ঘশ্বাস, আর হারানোর হাহাকার শুনছিলাম সেই ঘরে। আবারও সেই একই প্রশ্ন—
“আমার ছেলের খুনের বিচার কবে হবে, বাবা?”
একই দিনে দুই মায়ের বুকফাটা কান্না শুনলাম। একটি ফজরের নামাজের পর, আরেকটি জুমার নামাজের পর। যেন এক বিষণ্ণ, বৃষ্টিভেজা শুক্রবার আমাদের সাক্ষী বানালো অনন্য এক ব্যথার ইতিহাসে। আমরা কেঁদেছি, মন পড়ে রইল সেই মায়েদের চোখে, সেই নিঃসীম শূন্যতায়।
এই সরকারের কাছে আমাদের কোনো রাজনৈতিক দাবি নেই। একটিই মানবিক আবেদন— এই মায়েদের চোখের পানি যেন কিছুটা হলেও থামে। যদি তা থামাতে না পারেন, তবে মনে রাখুন— এই অশ্রু বিন্দুর প্রতিটির জবাবদিহি একদিন আপনাদেরও করতে হবে, আমাদেরও করতে হবে।
২৫ জুলাই ২০২৫
ঝিকরগাছা, যশোর
লেখক: ইয়ুথ অ্যাক্টিভিস্ট ও শিক্ষার্থী সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয় (আইন বিভাগ)
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।