জুমবাংলা ডেস্ক: বাংলাদেশে বড় ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার পাশাপাশি নির্ধারিত সময়ে শেষ না হওয়ায় ব্যয় তিন থেকে চারগুণ বেড়ে যায়৷ ডয়চে ভেলেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে জানালেন সিপিডি’র বিশেষ ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান৷
ডয়চে ভেলে : কয়েক বছর আগে আপনারা বাংলাদেশে সড়ক নির্মাণে কিলোমিটার প্রতি ব্যয়ের সঙ্গে একটি আন্তর্জাতিক তুলনা করেছিলেন? সেই হিসাবটা কেমন?
অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান: আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যারা এটা নিয়ে হিসেব নিকেশ করে থাকেন, তাদের যে গবেষণা সেখান থেকেই জেনেছিলাম, আমাদের প্রতি কিলোমিটারে যে খরচ পড়ে সেটা ভারতের থেকেও বেশি৷ কোন কোন ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে যে খরচ পড়ে সেটার কাছাকাছি৷ এটাও খেয়াল রাখতে হবে যে, শুধু এককালীন খরচ না, এগুলো ব্যবস্থাপনায়ও একটা খরচ থাকে৷ অনেক সময় দেখা যায়, একটা সড়ক নির্মাণের পর দুই তিন বছরের মধ্যে হয়তো অনেক বেশি সংস্কার করতে হচ্ছে৷ সবমিলিয়ে যদি আপনি হিসেব করেন তাহলে এক্ষেত্রে খরচ অনেক বেশি৷
সরকারি প্রকল্প প্রণয়নের সময় তো অতিরিক্ত ব্যয় ধরা হয়৷ তার উপর সময় বাড়ার কারণে ব্যয় কয়েকগুণ বেড়ে যায়৷ এ বিষয়ে আপনাদের কোন গবেষণা আছে?
এটা নিয়ে আমাদের প্ল্যানিং কমিশনের যে জেনারেল ইকোনমিক ডিভিশন আছে এবং সেখানে যে আইএমইডি আছে, ইমপ্লিমেন্টশন ইভ্যালুয়েশন মনিটরিং ডিপার্টমেন্ট আছে তারা নিজেরাই কিন্তু হিসেব করেছেন৷ সেই হিসেবেও দেখা যাচ্ছে, আমাদের হিসেবে তো বটেই, প্রাথমিক যে প্রাক্কলন করা হয় সেখানেই দেখা গেছে কত বেশি লাগে এবং এটার যে ব্যয় সেটাও কত বেশি৷ ক্ষেত্র বিশেষে এটা দেড় থেকে দুই গুণ৷ আমরা সিপিডির পক্ষ থেকে প্রজেক্ট ধরে ধরে বিশ্লেষণ করেছি৷ সেখানে আমরা দেখেছি, নির্ধারিত সময়ে শেষ না হওয়ার কারণে তিন থেকে চার গুণ খরচ বাড়ে৷ এর ফলে এই প্রকল্প থেকে যে রেট অব রিটার্ন আসার কথা তার উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে৷
সরকারি প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধিতে অর্থনীতি ও বাজেট ব্যবস্থাপনায় কী ধরনের প্রভাব পড়ছে?
ব্যয় বৃদ্ধির ফলে অবশ্যই একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে৷ আমাদের যে অবকাঠামোগত প্রকল্প আছে, সেখানে ৫০ টাকারটা যদি ১০০ টাকা হয় তাহলে আমি যেখানে ৪০০ টাকায় ৮টি প্রজেক্ট করতে পারতাম৷ সেখানে ৪টি করতে হচ্ছে৷ এটা তো অবশ্যই বাজেটের উপর একটা বড় চাপ সৃষ্টি করে৷ সেটা আমাদের করদাতাদের টাকা হোক আর অভ্যন্তরীণ সম্পদ অথবা বৈদেশিক ঋণ দিয়েই হোক৷ এটার খরচ যখন বেশি হয়, তখন চাপটা হয় ভোক্তার উপর পড়ে বা উৎপাদকের উপর পড়ে৷ আমি যদি একটা পাওয়ার প্ল্যান্ট করি সেটার খরচ যদি বেশি হয়, তাহলে সেখান থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম বেশি হবে৷ এতে গ্রাহককেও বেশি দাম দিতে হবে এবং উৎপাদকের খরচও বাড়বে৷
প্রকল্প ব্যয় কমানোর জন্য কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন?
প্রকল্প ব্যয় কমানোর জন্য সরকারের আইএমইডি থেকে বা যারা সংশ্লিষ্ট আছে তাদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় উদ্যোগ যে নেওয়া হয়নি তা নয়৷ কিছু ক্ষেত্রে উদ্যোগের চেষ্টা করা হয়েছে৷ কিছু কিছু জায়গায় এটা সফলও হয়েছে৷ আমরা এমন প্রকল্পও দেখেছি, প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে কম টাকায় যা শেষ হয়েছে৷ তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয়তো সেটা হয়নি৷ ধরেন একটা ব্রিজ করা হবে৷ সেখানে অর্থায়ন কোথা থেকে হবে? প্রজেক্ট প্লানিং কীভাবে হবে? সবকিছু শেষ করে জমি অধিগ্রহণ করতে গেলে অনেক সময় লেগে যেত৷ এখন প্যারালালি প্রজেক্টের সঙ্গে সঙ্গে জমি অধিগ্রহণও শুরু করা হয়৷ এতে সময় অনেক কমে গেছে৷ অর্থ ছাড়ের ক্ষেত্রে আগে দেখা যেত, বছরের শেষে অর্থ ছাড় হতো৷ ঠিকাদাররা অনেক সময় ঠিকমতো টাকা পাচ্ছে না৷ ফলে কাজে দেরি হতো৷ ব্যয় বেড়ে যেত৷ অর্থছাড়ের ক্ষেত্রে এখন কিছুটা পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে৷ প্রকিউরমেন্টেও পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে৷ আগে বাক্সে টেন্ডার ফেলতে হতো৷ তাদের প্রায়ই মারামারি হতো৷ এখন ই-টেন্ডারের মাধ্যমে এটা করা হয়৷ আরেকটা হল আগে ঘন ঘন প্রজেক্ট পরিচালককে বদলি করা হতো৷ এখন যেটা করা হয়েছে, ভালো পরিচালক হলে তাকে এক জায়গায় রেখে প্রকল্পটা শেষ করা হচ্ছে৷ আইএমইডি থেকে এমন ভালো কিছু সুপারিশ করা হয়েছিল৷ কিছু কিছু জায়গায় এটা বাস্তবায়িতও হয়েছিল৷ তা সত্ত্বেও বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতি বা অব্যবস্থাপনা কিন্তু থেকে যাচ্ছে৷
করোনার কারণে বাজেটের চাপ সামলাতে প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে কী ধরনের পরিবর্তন প্রয়োজন?
শুধু করোনার কারণে নয়, সাধারণভাবেই আমাদের পরিবর্তন আনতে হবে৷ এটা সুশাসন ও সুব্যবস্থাপনার বিষয়৷ করোনার কারণে এর প্রয়োজনটা অনেক বেড়ে গেছে৷ করোনার কারণে আমাদের অর্থনীতি একটা ধাক্কা খেয়েছে৷ প্রবৃদ্ধির উপর একটা আঘাত এসেছে৷ গত অর্থবছরে আমাদের যে রাজস্ব আদায় হয়েছে এবার তার থেকে শতকরা প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি ধরা হয়েছে৷ কোভিডের বছরে এখনই বলে দেওয়া যায়, এটা টার্গেট সফল হবে না৷ তাহলে টাকাটা আসবে কোথা থেকে? হয়তো বৈদেশিক ঋণ নিতে হবে বা ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হবে৷ ফলে সব দিক থেকেই কোভিডের কারণে এগুলো সাশ্রয়ীভাবে করা এবং সুশাসনের সাথে করা, সময়মত করার যে তাগিদটা সেটা আগের যে কোন সময়ের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে৷
প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি কতটা যুক্তিসঙ্গত? আর দুর্নীতি কি এই ব্যয় বৃদ্ধির অন্যতম কারণ? নাকি অন্য কিছু?
ব্যয় বৃদ্ধির অনেকগুলো কারণ আছে৷ একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তো একটা প্রকল্পের বিভিন্ন স্তর পার হয়৷ সেখানে দেখা যায়, অনেক সময় বাড়তি এলিমেন্ট সেখানে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়৷ আবার অনেক সময় যে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয় সেটা বাজার মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না৷ আবার একটা প্রকল্প নেওয়ার পর নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে৷ যেমন ধারণা করা হয়েছিল, বিদেশ থেকে সাহায্য পাওয়া যাবে৷ কিন্তু সেটা পাওয়া গেল না৷ আবার অনেক সময় প্রকিউরমেন্টে দুর্নীতি হয়৷ প্রকল্প বিলম্ব হলে মূল যে প্রকল্প প্রস্তাব সেটা কিন্তু পুনর্বিবেচনা করতে হয়৷ এটা যারা করেন তারা কিন্তু অনেক সময় এগুলোর সুযোগ নেয়৷ ফলে দুর্নীতি সেখানে ঢোকার সম্ভাবনাটা বেড়ে যায়৷
সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পেও সময়ের সঙ্গে ব্যয় বাড়ছে৷ যেমন পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল প্রকল্পের কথা আমরা বলতে পারি৷ এগুলো কেন সঠিক সময়ে বা সঠিক খরচে করা সম্ভব হয় না?
আমাদের দেশে একটা বাস্তব অবস্থা, আরেকটা প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা৷ বাস্তব অবস্থা যেটা সেটা হল বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের যে সক্ষমতা সেটা আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর গড়ে ওঠেনি৷ সমান্তরালভাবে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের একটা দুর্বলতা তো আছেই৷
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।