সরকারের ৫০ শতাংশ মালিকানাধীন একটি তেল কোম্পানির দু’শ কোটি টাকার বেশি আত্মসাৎ করেছে দুর্নীতিবাজ এক সিন্ডিকেট। চট্টগ্রামে অবস্থিত কোম্পানিটির নাম স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেড (এসএওসিএল)।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, অর্থ লোপাটের উদ্দেশ্যে ঢাকায় এসএওসিএলের নামের সঙ্গে মিল রেখে অন্য আরেকটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে ওই সিন্ডিকেট। কোম্পানির নাম দেয়া হয় এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেড (এওসিএল)। এরপর এসএওসিএলের পণ্য বিক্রি থেকে প্রাপ্ত চেক, ডিডি, ব্যাংক ড্রাফট জমা করা হয় এওসিএলের ব্যাংক হিসাবে। পরে এ অবৈধ কর্মযজ্ঞ চালাতে খোলা হয় আরও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এভাবে নামে-বেনামে ২শ’ কোটি টাকার বেশি অর্থ আত্মসাৎ করা হয়।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের ভার্চুয়াল বার্ষিক সাধারণ সভায় এ চঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস হয়। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, অর্থ লোপাটের ঘটনায় মিশু মিনহাজ নামে কোম্পানির বেসরকারি অংশের এক প্রভাবশালী পরিচালকের নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেট জড়িত। তিনি এওসিএলের স্বত্বাধিকারীও। মিশু মিনহাজ একাই ১২৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
আরও জানা গেছে, ওই সাধারণ সভায় তোপের মুখে পড়েন পরিচালক মিশু মিনহাজ। ওই দিনই প্রতিষ্ঠানের পাওনা পরিশোধের জন্য তাকে চিঠি দেয়া হয় কোম্পানির পক্ষ থেকে। বিষয়টি জানানো হয় জ্বালানি মন্ত্রণালয়কেও। কিন্তু এখন পর্যন্ত তিনি পাওনা পরিশোধ করছেন না। উল্টো নানাভাবে ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। মন্ত্রণালয়ও এ ঘটনায় মিশু মিনহাজের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এখনও বহাল তবিয়তে আছেন পরিচালকের দায়িত্বে।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, প্রতিষ্ঠানের বেসরকারি অংশের পরিচালক মিশু মিনহাজ দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠানের ৪ শীর্ষ কর্মকর্তার মাধ্যমে এসএওসিএলের তেল বিক্রির টাকা কোম্পানির কোষাগারে জমা না দিয়ে এওসিএলের অ্যাকাউন্টে জমা দিতেন। বিষয়টি ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্তে ওই ৪ কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করার সুপারিশ করা হয়। এরপর বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করে তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের লক্ষ্যে ৩২টি মামলা করা হয়। মামলাগুলো চলমান। জানা গেছে, লোপাট হওয়া ওই ১২৫ কোটি টাকা বেহাত হওয়ার পেছনে এ সিন্ডিকেটের যোগসাজশ রয়েছে। জানা গেছে, এ নিয়ে এখন দুর্নীতি দমন কমিশনও তদন্ত করছে।
সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠানের বেসরকারি পরিচালক মিশু মিনহাজ প্রায় দেড় দশক ধরে এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি (এওসি) নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসএওসিএলের সঙ্গে ব্যবসা করছেন। প্রতিষ্ঠানের হিসাব শাখার কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশ করে প্রতি বছর বিলের অনেক ফাইল লুকিয়ে প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাৎ করে আসছেন। তিনি নিজে এসএওসিএলের পরিচালক এবং এ প্রতিষ্ঠানের ডিলার হওয়ায় বিষয়টি কেউ টের পেত না। অভিযুক্ত ৪ কর্মকর্তাকে আর্থিক কেলেঙ্কারির দায়ে চাকরিচ্যুত করে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে মামলা করার পর তা বেরিয়ে আসে।
এ বিষয়ে মিশু মিনহাজের মন্তব্য নিতে তার মোবাইল ফোনে গত দুই দিন (মঙ্গল ও বুধবার) একাধিকবার ফোন করা হয়। কিন্তু তিনি রিসিভ করেননি। পাশাপাশি এ প্রতিবেদকের পরিচয় দিয়ে তার মোবাইল ফোনে এসএমএস দেয়া হয়। কিন্তু বুধবার রাত ৮টা পর্যন্ত তিনি কোনো জবাব পাঠাননি। তবে এদিন রাত সোয়া ৮টার দিকে মিশু মিনহাজের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হোসেন ইকবাল টেলিফোনে জানান, স্যার (মিশু মিনহাজ) অসুস্থ। তাই কথা বলতে পারছেন না।’ তবে উল্লিখিত অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। মিশু মিনহাজের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি জানান, ‘স্যার বলেছেন, তার (মিশু) কাছে সবমিলিয়ে এক কোটি ১২ টাকা পাবে এসএওসিএল। এরমধ্যে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩৫ লাখ এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৭৭ লাখ টাকা। হুট করে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কিভাবে ১২৫ কোটি টাকা হল- তা বোধগম্য নয়। তাছাড়া বার্ষিক সাধারণ সভা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
এদিকে, বিপুল পরিমাণ অর্থ আটকে যাওয়ার কারণে এসএওসিএল চরম আর্থিক সংকটে পড়েছে। এ ব্যাপারে স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ জমা দিয়েছে গত সপ্তাহে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) প্রকৌশলী মো. শাহেদ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে একটি চক্র প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত ছিল। তার মধ্যে প্রতিষ্ঠানের চার কর্মকর্তা সরাসরি জড়িত। বিষয়টি টের পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই চার কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করে তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের লক্ষ্যে ৩২টি মামলা করা হয়েছে। মামলাগুলো চলমান আছে। বর্তমানে ১২৫ কোটি টাকা বেহাত হওয়ার যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার পেছনেও ওইসব কর্মকর্তার যোগসাজশ রয়েছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারাই মিশু মিনহাজকে এ কাজে সহযোগিতা করেছেন ফাইল লুকিয়ে। তাদের চাকরিচ্যুতির পর ফাইলগুলো একে একে বেরিয়ে আসে। চাকরিচ্যুত একাধিক কর্মকর্তা এ ঘটনার সঙ্গে জিএমের সম্পৃক্ততা রয়েছে প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং পরিকল্পিতভাবে ছড়ানো হচ্ছে। যেহেতু আমার হাত দিয়ে ওদের চাকরিচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে, তাই তারা আত্মসাৎ করা টাকা দেয়ার ভয়ে এটি রটাচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিপিসির চেয়ারম্যান মো. সামছুর রহমান বলেন, ‘এসএওসিএলের অর্থ আত্মসাতের ঘটনা তদন্ত করে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জ্বালানি বিভাগে দাখিল করা হয়েছে। পাশাপাশি পুরো ঘটনাটি দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করে তিনি মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছেন।’
জানা গেছে, বিপিসির তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসএওসিএলের পরিচালক মিশু মিনহাজসহ শীর্ষ ব্যক্তিরা তাদের তথ্য দিয়ে সহায়তা করেনি। সে কারণে প্রকৃত আত্মসাৎকৃত অর্থের পরিমাণ খতিয়ে দেখা সম্ভব হয়নি। ২০১২-১৩ ও ২০১৩-১৪ অর্থবছরের হিসাবপত্র পর্যালোচনা করে আত্মসাতের অর্থের খোঁজ পেয়েছেন তারা। কমিটি একটি বেসরকারি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান দিয়ে (সিএ ফার্ম) এসওসিএলের সব হিসাবপত্র নিরীক্ষার সুপারিশ করেছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা প্রফেসর শামসুল আলম বলেন, ‘জ্বালানি খাতে এটা একটা সাগরচুরি। পুরো জ্বালানি খাতকে আন্তর্জাতিক কোম্পানি দিয়ে তদন্ত করাতে হবে। তাহলে আরও অনেক তথ্য বেরিয়ে আসবে। প্রতিষ্ঠানের কাঠামোতে সচিব, অতিরিক্ত সচিবের দায়িত্ব নিয়েও তিনি প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি নিষ্পত্তি করবে মন্ত্রণালয়। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের সচিব, অতিরিক্ত সচিব যদি বোর্ডের প্রধান হন, তাহলে তারা কিভাবে এর বিচার করবেন?
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, এসএসিওএলের পণ্য বিক্রির অর্থ তুলে তার একটি অংশ ২৫টি ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় রেখেছে সিন্ডিকেট। একটি একটি অংশ দিয়ে সম্পদ গড়ে তোলা হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসএসিওএলের ব্যাংক হিসাব থেকে অর্থ তুলে এশিয়াটিক ওয়েল কোম্পানির (এওসি) ব্যাংক হিসাবে রাখা হয়।
স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানির (এসএওসিএল) জন্ম চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় ৫৫ বছর আগে। শুরুতে প্রতিষ্ঠানটি আমদানি করা লুব বেইজ ওয়েল ব্লেন্ডিং করে বিক্রি করত। ২০০০ সালে প্রথমে এলপি গ্যাস, পরে বিটুমিন, ফার্নেস অয়েল, ডিজেল ও সর্বশেষ জেট ফুয়েল বিক্রি করার অনুমতি পায়। মূলত এরপর থেকেই প্রতিষ্ঠানটিতে দুর্নীতি শুরু হয়। এসএওসিএলের পরিচালনা পর্ষদে সরকারের পক্ষে বোর্ড চেয়ারম্যান জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা এবং বেসরকারি পক্ষের পরিচালক দুই ভাই মঈন উদ্দীন ও মিশু মিনহাজ।
২০১৩ সালের পর অর্থাৎ জ্বালানি বিক্রির অনুমতি পাওয়ার পর থেকে অডিট বন্ধ করে দেন মিশু মিনহাজ। একটি চিঠি ইস্যু করে ঘোষণা দেন সব পণ্যের ইনভয়েস ও ডিডি শুধু এশিয়াটিক অয়েল লিমিটেডের (এওসিএল) নামে হবে। পণ্য বিক্রির টাকা যাবে নিজের এওসিএলের অ্যাকাউন্টে। ২০১১ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত এক হিসাবে দেখা গেছে, ১০৬৬টি পে অর্ডারের ৪৮ কোটি ২৮ লাখ টাকা স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানির নামে জমা না দিয়ে তিনি নিজের মালিকানাধীন এওসির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা করেছেন। অপর এক হিসাবে দেখা গেছে, ২০১৫ সালে ১৭টি রশিদে ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১২১টি রশিদে এওসির ফান্ডে ৪৩ কোটি টাকা জমা হয়। এভাবে বিভিন্ন সময়ে এওসিএলসহ নামে-বেনামে ওই সিন্ডিকেটের বিভিন্ন ব্যক্তির কোম্পানির হিসাবে এসএওসিএলের ২০০ কোটির বেশি অর্থ অবৈধভাবে জমা হয়। সূত্র: যুগান্তর
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।