ফারুক তাহের, চট্টগ্রাম: দক্ষিণ চট্টগ্রামের পটিয়া, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া এই চার উপজেলায় বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর ভেসে ওঠতে শুরু করেছে প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির দৃশ্য।
ভারী বৃষ্টি আর পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলে সৃষ্ট বন্যায় এবারের আউশ-আমনের ফলন ও সবজির আবাদ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া মৎস্য ও প্রাণিসম্পদেরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতি হয়েছে অন্তত ১০০ কিলোমিটারের বেশি মূল সড়ক ও শাখা সড়ক এবং দোহাজারি-কক্সবাজার রেল লাইনের বড় একটি অংশ। ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মানুষের বাড়িঘর ও বসতভিটার।
এবারের বন্যায় দক্ষিণ চট্টগ্রামে ২০ জন নারী-পুরুষ ও শিশুর প্রাণহানি ঘটেছে। আকস্মিক এ বন্যায় দক্ষিণ চট্টগ্রামের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৫’শ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তরের দায়িত্বশীলরা।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, এবারের ভয়াবহ বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মাছ চাষিরা। চার উপজেলার মৎস্য অফিসের তথ্য অনুযায়ী, টানা বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে ভেসে গেছে আনুমানিক ১২ হাজার পুকুর, দিঘি ও মাছের ঘের। চট্টগ্রাম জেলায় ৫০ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
বন্যায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নির্মাণাধীন দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন। ট্রেন চলাচল শুরুর আগেই এখানে লাইনের বিভিন্ন অংশে দেবে গেছে। এমন কি পানির স্রোতে তলিয়ে সরে গেছে লাইনের নিচে থাকা মাটি পাথর।
দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের পরিচালক মফিজুর রহমান জুমবাংলাকে জানান, পানিতে রেললাইনের মাটি ও পাথর সরে গিয়ে ৪৫০ মিটার লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাতকানিয়ার কেরানিহাট ও তেমুহনী কেঁওচিয়া এলাকার দুই কিলোমিটার রেললাইনের অন্তত ২০ স্থানে দেবে গেছে। এসব এলাকায় রেললাইনের উপর দিয়ে দুই দিনের বেশি প্রবল স্রোতে হাটুঁ পরিমাণ পানি প্রবাহিত হয়েছে। অথচ আগামী সেপ্টেম্বর থেকে এই লেন দিয়ে ট্রেন কক্সবাজার যাওয়ার কথা ছিল। সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক এ প্রকল্পে এ পর্যন্ত ৮৭ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
আকস্মিক এমন বন্যার জন্য চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন তৈরিকে দোষছেন স্থানীয়রা। তাদের দাবি, রেললাইনে তৈরির ফলে এই অঞ্চলের বেশ কয়েকটি উপজেলার মাঝামাঝি কৃত্রিম বাঁধের সৃষ্টি হয়েছে। আর তাতে বিঘ্ন ঘটছে পানি প্রবাহের।
পটিয়া উপজেলার সিনিয়র মৎস্য অফিসার স্বপন চন্দ্র দে বলেন, পটিয়ায় মাছ চাষ করা হয় এমন জলাশয় আছে আনুমানিক ৮ হাজারের বেশি। বন্যায় প্রায় ৮০ শতাংশ পুকুর, দিঘি ও মাছের ঘের তলিয়ে গেছে। ফলে কেবল পটিয়ার মাছ চাষিদের প্রায় ১২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আমরা উপজেলার ক্ষয়ক্ষতি বিবরণের রির্পোটটি জেলা অফিসে পাঠিয়েছি। সরকারিভাবে সহায়তা পাওয়া গেলে আমরা তখন ক্ষতিগ্রস্ত মাছ চাষিদের কাছে বিতরণ করতে পারবো।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, টানা বৃষ্টি, জোয়ার-জলোচ্ছ্বাস ও বন্যায় নদ-নদীর পানি প্রবাহিত হওয়ায় যার প্রভাব পড়েছে কৃষি জমিতে। পাহাড়ি ঢল ও বন্যার পানিতে ডুবে যায় আউশ ও আমনের বীজতলা এবং রোপা আমন ও শরৎকালীন সবজি। খাল ও নদীতে পানি কমার পরও ফসলের জমি এখনো পানিতে ডুবে রয়েছে। এ ছাড়াও বন্যায় এই তিন খাতের বাইরে সড়ক যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ স্থাপনার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
পল্লী বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, দক্ষিণ চট্টগ্রামের আটটি উপজেলায় পটিয়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১-এর আওতায় ৬ লাখ ৩৪ হাজার বিদ্যুৎ গ্রাহক রয়েছে। টানা বর্ষণে এসব উপজেলাগুলোর অন্তত ২ লাখ ৫০ হাজার গ্রাহক গত এক সপ্তাহ ধরে বিদ্যুৎবিহীন অন্ধকারে ভয়াবহ বন্যার পানির সাথে মানবেতর জীবনযাপন করছে। স্বাভাবিকভাবে ১৭০ মেগোয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন এই উপজেলাগুলোতে। কিন্তু এর অর্ধেক বিদ্যুৎ ও সরবরাহ করা যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) দক্ষিণ চট্টগ্রামে দোহাজারীতে যে গ্রিড সাব-স্টেশন রয়েছে এটাও বন্ধ হয়ে গেছে বন্যার কারণে। বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়ে পটিয়া, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া ও লোহাগাড়ায় এই পর্যন্ত খুঁটি ভেঙে পড়েছে ৪৪টি, খুঁটি পড়ে গেছে ২৩টি, খুঁটি হেলে পড়েছে ৫৪টি, ট্রান্সফরমার নষ্ট হয়ে গেছে ২৭টি, ক্রস আর্ম নষ্ট হয়ে পড়েছে ৬৩টি, ইনসুলেটর নষ্ট হয়েছে ৪৮টি এবং ৪৫২টি স্পটে তার ছিঁড়ে গেছে। এতে প্রায় কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চট্টগ্রাম মহানগরের পাঁচলাইশ, ডবলমুরিং ও পতেঙ্গা এলাকার ৫ হেক্টর জমিতে লাগানো আউশ ধান, ২০ হেক্টর জমিতে লাগানো আমনের চারা ও ১৪০ হেক্টর জমিতে লাগানো সবজির খেত নষ্ট হয়েছে।
এছাড়া, ১৫ উপজেলায় ৩২ হাজার ৭১৯ হেক্টর জমির আউশ ধানের বীজতলা, ৬ হাজার ৫৬৭ হেক্টর জমির ফসল পিানিতে নিমজ্জিত হয়। এসব উপজেলায় কিছুদিন আগে ৫১ হাজার ১৩০ হেক্টর জমিতে লাগানো হয় আমনের চারা। এর মধ্যে ১৫ হাজার ৩৩০ হেক্টর জমিতে নতুন লাগানো চারার ক্ষতি হয়েছে। আউশ ধান কাটার কথা চলতি মাসের শেষে।
চট্টগ্রামের শস্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত রাঙ্গুনিয়ার বৃহত্তর গুমাই বিল এক সপ্তাহ ধরে বন্যার পানির নিচে ছিলো। সবমিলিয়ে শরৎকালীন সবজিসহ চট্টগ্রামে বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে ২৬ হাজার ৯৬৪ হেক্টর জমির ফসল।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক ড. অরবিন্দ কুমার রায় জানান, ‘বিভিন্ন এলাকা থেকে বন্যার পানি এখনো পুরোপুরি নামেনি। প্রাথমিকভাবে ৫০ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে বলে আমরা ধারণা করছি।’
গত ১ আগস্ট থেকে চট্টগ্রামে বৃষ্টিপাত শুরু হয়। ৪ আগস্ট নগরী ও জেলা জুড়ে বন্যা দেখা দেয়। ধীরে ধীরে পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। এর মধ্যে ৭ আগস্ট পর্যন্ত চার দিন টানা জলাবদ্ধতা ছিলো চট্টগ্রাম নগরীতে। গত এক সপ্তাহে চট্টগ্রামে ৬৬৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। যা বিগত ৩০ বছরের মধ্যে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি বলে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে। অতি বৃষ্টির সঙ্গে যোগ হয় পাহাড়ি ঢল। পাহাড়ি নদী সাঙ্গু, মাতামুহুরী, ডলু, কর্ণফুলী ও হালদার পানি বেড়েছে প্রতিদিন।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান জুমবাংলাকে বলেন, ‘বন্যায় চট্টগ্রাম জেলায় কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের আপাতত ত্রাণ সামগ্রী ও নগদ টাকা দিয়ে সহযোগিতা করে যাচ্ছি। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান ও ধণাঢ্য ব্যক্তিদেরও এগিয়ে আসতে হবে। ইতোমধ্যে অনেকেই নানানভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।