জুমবাংলা ডেস্ক : রাজশাহী জেলার মাটিকাটা ইউনিয়নের বেনিপুরের মো. ওয়াদুদ আলীর (৬২) ছেলে মাজাহারুল ইসলাম (৩০)। বাবার সংসারে অভাব মেটাতে ২০১৩ সালে পাড়ি জমান দক্ষিণ কোরিয়ায়। ৫ বছর পর কিছু অর্থ নিয়ে দেশে ফিরেই বাবার সঙ্গে আবারো শুরু করেন কৃষিকাজ। তবে এবার কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি, শ্রম ও নিষ্ঠার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে হয়ে উঠেন কোটিপতি।
আধুনিক চিন্তাধারার মাজহারুল কেনেন ‘ইয়ানমার কম্বাইন হারভেস্টার’ নামের একটি কৃষিযান। এটি মূলত ধান কাটাই, মাড়াই-ঝাড়াই ও বস্তাভর্তি করার একটি আধুনিক মেশিন। মেশিনটি তিনি ৫০% সরকারি ভর্তুকিতে ১৪ লাখ টাকায় নেন।
তবে কিছুদিন যেতে না যেতেই যন্ত্রটি নিয়ে পড়েন বিপাকে। এতে প্রায়শই দ্বারস্থ হতে হতো উপজেলা কৃষি অফিসারের নিকট। এতে হারভেস্টার মেশিনটির নানা সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি তিনি ধারণা পান বিভিন্ন লাভজনক চাষাবাদ ও ট্রেনিং।
এরপর বাবার কাছে থেকে নেন দেড় বিঘা জমি। সেখানে পরীক্ষামূলকভাবে নিজেই চায়না জাতের ‘বল সুন্দরী’ বড়ই চাষাবাদ শুরু করেন। এছাড়াও চাষ করেন- মাল্টা, কমলা, পেয়ারা ও সিডলেস লেবু। এতে সহায়তা করেন তৎকালীন উপজেলা কৃষি অফিসার মো. শফিকুল ইসলাম ও গোদাগাড়ী কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার মো. মতিউর রহমান।
লাভের আশা দেখতে পাওয়ায় প্রবাসফেরত চার বন্ধুকে করেন অংশীদার। নিজ গ্রামে লিজ নেন ৪৫ বিঘা জমি। নিজে কাজ করার শর্তে অংশীদার হন ৫০ ভাগ এবং বাকি তিনজন নিবেন ৫০ ভাগ লাভের অংশ। নিজ জমিসহ মোট সাড়ে ৪৬ বিঘা জমিতে শুরু করেন ফল ও সাথী ফসলের চাষাবাদ। এই সাড়ে ৪৬ বিঘা জমির মধ্যে ৭ বিঘা জমিতে ১৪০০ চায়না জাতে শীতকালীন ফল ‘বল সুন্দরী’ বড়ই গাছ লাগান। এছাড়াও মাল্টা, সিডলেস লেবু ও কমলা গাছের ১২ ফিট ব্যবধানের মাঝখানে আরো ২২০০ বড়ই গাছ লাগান সাথী ফসল হিসেবে।
এদিকে জুনের মাঝে ৬ বিঘা জমিতে লাগান ২৪০০ থাই গোল্ডেন পেয়ারার গাছ। চায়না, দার্জিলিং, মান্দারিন জাতের ৭০০টি কমলা গাছ লাগান ৬ বিঘায়। ‘বারি-১’ জাতের ৭০০টি মাল্টার গাছ লাগান আরো ৬ বিঘায়। আবার বারমাসি ৬০০০ ‘সিডলেস লেবু’ লাগিয়েছেন ১৮ বিঘা জমির ওপর। সারাবছর ফলন হওয়ায় লাভও হয় অনেক। অন্যদিকে, ১০০টি কাজু বাদাম রোপণ করেছেন ১ বিঘায়।
এছাড়াও সৌখিন মাজাহারুল আড়াই বিঘা জমিতে লাগিয়েছেন- জাপানের জাতীয় ফল পারসিমন, পাকিস্তানি আনার, তুরস্কেও ত্বীন, থাইল্যান্ডের লংগন (কাঠলিচু), অস্ট্রেলিয়ার সাত মসলা (১/২টি পাতায় দিলেই সাতটি মসলার কাজ করে), ব্রুনায়ের জাতীয় ফল রাম ভুটান যা অনেকটা ক রো না র ছবির মতন দেখতে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জাতের ফুল ও সবজির আবাদ করেছেন তিনি।
মাজহারুল বড়ই, কমলা ও পেয়ারা চারা সংগ্রহ করেছেন চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন নার্সারি থেকে। লেবু ও মাল্টা এনেছেন টাঙ্গাইল থেকে। সাথী ফসল হিসেবে লাগানো হয়েছে- ২২০০ বড়ই গাছ, ১২০০ টমেটো গাছ, ফুলকপি ২০০০, বাধাকপি ৪০০০, ব্রোকলি ১০০ এবং ক্যাপসিক্যাম ১০০টি।
চাষাবাদে সফলতার বিষয়ে প্রবাসী মাজাহারুল বলছেন, চলতি বছর জমিতে সাথী ফসল বড়ই বিক্রি করেছেন। এতে আয় হয়েছে প্রায় ৩০ লাখ টাকার। অন্যদিকে, সাথী ফসল ফুলকপি, বাধাকপি, টমেটো বেঁচে পেয়েছেন আরো ৫ লাখ। এসব ঢাকার যাত্রাবাড়ী ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন পাইকারি আড়তদারদের কাছে বিক্রি করেছেন। তবে সাথী ফসল হিসেবে ব্রোকলি ও ক্যাপসিক্যাম লাগালেও তা বিলিয়ে দেন গ্রামবাসীদের।
মাজহারুলের বলেন, ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত পেয়ারা থেকে আরো ১৫ লাখ টাকা এসেছে। এছাড়া, গত রোজার ঈদে লেবু থেকেই আয় হয়েছে ৪৫ লাখ টাকা। এদিকে মাল্টা ও কমলা থেকে এসেছে প্রায় ৩৫ লাখের মতো। সবমিলিয়ে বিনিয়োগের ৩০ লাখসহ ঘরে মুনাফা এনেছেন কোটি টাকার।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়ে সফল এই প্রবাসী উদ্যোক্তা বলেন, ‘আবাদকৃত জমির পাশেই আরো ৭০ বিঘা লিজ নেয়ার কথাবার্তা চলছে। সেখানে ৪০ বিঘায় বড়ই ও ৩০ বিঘায় সিডলেস লেবুর চাষাবাদের পরিকল্পনা আছে। এছাড়া ভবিষ্যতে লেবু ও বড়ই এর চারা সংরক্ষণও করতে চাই।’
লেবু ও বড়ই চারা সংরক্ষণের কারণ হিসেবে এ উদ্যোক্তা বলেন, এসব চারা আমি খুব কষ্ট করে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংগ্রহ করেছি। এতে শ্রম, সময় ও অর্থ সবই বেশি দিতে হয়েছে। ভবিষ্যতে যেন আমার মতো এমন কাউকে কষ্ট না করতে হয়, সেজন্যই আমি এসব চারা সংরক্ষণ করতে চাই। আমার গ্রামের কাছে লেবু ও বড়ই চারা নিলে তাদের কম দামে বিক্রি করব।
উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, কৃষিকাজও একটি ব্যবসা। ব্যবসায় শ্রম-সময় দিলে সাফল্য আসবেই। আমার গ্রামের কৃষক কিংবা শিক্ষিত তরুণ যদি আমার মতো কৃষিতে সফল হতে চান, তাদের আমি কৃষি বিষয়ে সম্পূর্ণ বুদ্ধি-পরামর্শ দেবো। শুধু তাই নয়, আমার নার্সারির চারাও শিক্ষিত তরুণদের অর্ধেক দামে দেবো।
সফল উদ্যোক্তা মাজাহারুলের বিষয়ে গোদাগাড়ী কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার মতিউর রহমান বলেন, মাজহার নিজের দেড় বিঘা জমিতে নিজ উদ্যোগেই বল সুন্দরী বরই গাছ লাগান। পরে জমিগুলোতে মাল্টা, লেবু, কমলা ও পেয়ারাসহ সাথী ফলস চাষের বিষয়ে আমরা তাকে কৃষি সহায়তা প্রদান করি। নিজের শ্রম ও মেধা খাটিয়ে সে সফল হয়েছে এবং তার বন্ধুদেরও সফল লাভবান করেছে। তার জমিতে এ পর্যন্ত ১৫০ জনের অধিক ব্যক্তি কৃষিবিষয়ক বিভিন্ন ট্রেনিং, পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার জন্য এসেছেন। তার এ সফলতা সত্যিই প্রশংসনীয়।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ দফতরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক আব্দুল্লাহ হীল কাফি বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলে উঁচু জমিতে পানির সঙ্কটের কারণে ধান-গমের চাইতে ফল চাষ অধিক উপযোগী, পানিও কম লাগে। সেক্ষেত্রে মাজাহারুলকে চিরাচরিত চাষাবাদের পরিবর্তে লাভজনক ফল চাষের জন্য কৃষি সম্প্রসারণ থেকে পরামর্শসহ সব সরকারি সহায়তা দেওয়া হয়। যার কারণে সে সফল হয়েছে।
মাজহারুলের সফলতার বিষয়ে তিনি বলেন, কৃষিতে স্বনির্ভরতা দেশের জন্য আর্শীবাদ। তাই মাজাহারুলের সফলতা দেখে আরো ১০ জন এগিয়ে এসে কৃষিতে বিপ্লব ঘটাক এবং লাভজনক চাষাবাদের মাধ্যমে সফল ও স্বনির্ভর হোক এটাই বর্তমান সরকারের কাম্য।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।