এ কে এম শাহনাওয়াজ : জমিদার বাবুর বাগনে একটি বৃক্ষ ছিল। ত্রিশ বছরেও ফল দেয়নি। এই প্রথম ফলে ফলে ভরে গেল। বাহারি রঙে ঝলমল করছে। যে দেখে তারই একটি ফল পাওয়ার লোভ হয়। জমিদার বাবু জেনেছেন এটি বিষবৃক্ষ। এ ফল মুখে দিলেই মৃত্যু অনিবার্য। তাই জমিদার জনস্বার্থে পাহারা বসিয়েছেন। কেউ যাতে বাগানের ত্রিসীমানায় না আসে। মানুষকে বোঝানোও হল। কিন্তু অবুঝ মানুষ উল্টো বুঝল। ভাবল তাদের ফাঁকি দেয়া হচ্ছে। রক্ষীদের বাধা কেউ মানতে চায় না। বিরক্ত হয়ে জমিদার বাধা সরিয়ে নিলেন। খুলে দেয়া হল বাগানের দরজা। ফল পাড়ার মচ্ছবে মেতে গেল মানুষ। ফল মুখে দিতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে লাগল।
আমাদের দশাও তাই। বিষবৃক্ষ নামের করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। নিজেদের বাঁচার প্রধান পথ ঘরবন্দি থাকা। এ সত্য নানাভাবে প্রচার করা হচ্ছে। তবুও একশ্রেণির মানুষ বুঝতে চাইছে না। নানা অর্থনৈতিক সংকট তাদের বুঝতেও দিচ্ছে না। তারপরও সচেতন মানুষ চেষ্টা করছে লকডাউন মানতে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও চেষ্টা করছে মানুষকে ঘরে রাখতে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে। শতভাগ সফল না হলেও কিছুটা নিয়ন্ত্রণেই চলছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছিলেন আমাদের দেশে মে মাসে ভাইরাস ছড়ানোর প্রকোপ বেশি বাড়বে। সুতরাং অন্তত ঈদ পর্যন্ত যদি মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রিত হতো, যদি ঘরে আটকে থাকার চেষ্টা করা হতো তবে হয়তো করোনা সংক্রমণের গতি অনেকটা কমিয়ে ফেলা সম্ভব হতো।
কিন্তু দেশের নীতি-নির্ধারকরা নানা তাপ-চাপে পড়ে গল্পের জমিদার বাবুর মতো বিরক্ত হয়ে উল্টো সিদ্ধান্ত নিলেন। সংক্রমণ ছড়ানোর এই কঠিন সময়ে যখন মানুষকে আরও কঠিনভাবে ঘরবন্দি রাখার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার কথা, তখনই ‘সীমিত’ভাবে পোশাক কারখানা খুলে দেয়া হল। স্রোতের মতো শ্রমিকরা আসতে থাকল শহরে। আমাদের দেশের বাস্তবতায় এই অবস্থায় সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা কঠিন। ফলে যা হওয়ার তা-ই হল। দেশে করোনা পরীক্ষার চরম দুর্বলতার পরেও আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে আক্রান্তের সংখ্যা। সরকারি হিসাবেই একশ-এর নিচে থাকা মৃত্যুর সংখ্যা হু-হু করে দুইশ ছাড়িয়ে গেল। খুব স্বাভাবিকভাবেই পোশাক কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকল। অপ্রতিরোধ্য স্রোত থামাতে গিয়ে করোনা প্রতিরোধে নজরদারি করতে গিয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পুলিশ-র্যাব সদস্য আক্রান্ত হলেন। মৃত্যুবরণের ঘটনাও ঘটতে থাকল। দুর্বল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কারণে অনেক ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হতে থাকলেন। তাদের মাধ্যমে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকল।
আমাদের মতো দেশে যতই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথা বলি না কেন, অধিকাংশ সাধারণ মানুষের আর্থিক সামর্থ্যরে জায়গাটি এখনও অনেক দুর্বল। এ সংকটে এসে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা বিপুল সংখ্যক মানুষের বাস্তবতা স্পষ্ট হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনার প্রভাবে আরও ৮০ লাখ থেকে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবে। তাই এ সময়ে অর্থনৈতিক স্থবিরতা থেকে বেরুনোও খুব জরুরি।
স্বাস্থ্য খাত ও সুষম বণ্টনের বিচারে দেশের অর্থনৈতিক খাত নাজুক অবস্থায় রয়েছে। তাই এ মহাসংকটে এই দুই খাত যথেষ্ট চাপের মুখে। সরকার শুরু থেকেই যথাসাধ্য চেষ্টা চালাচ্ছে পরিস্থিতি মোকাবেলায়। এ সময় নানামুখী তাপ-চাপের কাছে আত্মসমর্পণ না করে সুপরামর্শের ভিত্তিতে নীতিনির্ধারণ করা প্রয়োজন। দেশের অর্থনীতির চাকা কিছুটা সচল রাখা আমাদের মতো দেশগুলোর জন্য জরুরি। যেখানে উন্নত ও সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশও অর্থনৈতিক গতিশীলতার স্বার্থে ধীরে ধীরে শিল্পকারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের দরজা একটু একটু করে খুলে দিচ্ছে- শিথিল করছে লকডাউন, সেখানে আমরা হাত পা ছেড়ে বসে থেকে নিজেদের কি রক্ষা করতে পারব?
কিন্তু এর পাশাপাশি আমাদের দেশের বাস্তবতার বিষয়টিও ভাবনায় রাখতে হবে। বিপুল জনসংখ্যার ছোট্ট দেশ এটি। মুখে বলতে পারলেও বাস্তব কারণেই ক্ষুদ্র আয়ের মানুষের চাকরি বাঁচাতে ও ক্ষুধার অন্ন জোগাতে স্বাস্থ্যবিধি মানা কঠিন। এ অবস্থায় দেশের অর্থ কাঠামো বাঁচাতে যদি তাড়াহুড়ায় মহামারীর পথ প্রশস্ত করে দেই, তাহলে ব্যাপক নৈরাজ্য তৈরি হবে। তেমন অবস্থায় অর্থনীতির সব চাকাই শ্লথ হওয়ার কথা। এই সত্য বিবেচনায় আনলে দাঁতে দাঁত চেপে হলেও বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কার মে মাসটিকে গুরুত্ব দিতে পারতাম। উপরন্তু, এই সংকটের মাসটিতে শক্তিপ্রয়োগ করে হলেও লকডাউনকে কড়াকড়িভাবে মানানোর চেষ্টা করতে পারতাম। ঈদের পর পরিস্থিতি বিবেচনায় শিল্পকারখানা, অফিস আদালত কি কি প্রস্তুতি রেখে খোলা যায়, সেসব ভাবা যেত। এর মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগকে সমন্বিত করে সব মানুষের খাদ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করা যেত। কিন্তু প্রশাসন সে পথে হাঁটেনি।
কোনো চিন্তাই আমরা দূরদর্শিতা নিয়ে করি না। মুশকিল হচ্ছে ঠেকেও শিখতে চাই না। যেমন- একসময় করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, দোকানপাট বন্ধ করার ঘোষণা দিয়ে মানুষকে কঠোরভাবে ঘরবন্দি থাকার কথা বলা উচিত ছিল। তখনই আমরা ‘ছুটি’ ঘোষণা করে দিলাম। যে দেশের মানুষ সাপ্তাহিক বন্ধের সঙ্গে এক-দুদিন ছুটি পেয়ে গেলে শহর ছেড়ে গ্রামের টানে ছুটে, সেখানে এরা এমন লম্বা ছুটিতে ছড়িয়ে পড়বে এটিই স্বাভাবিক। এই সত্য বিবেচনায় না এনে লাগাম ছাড়া হয়ে করোনা ছড়িয়ে দেয়ার পথ করে দিলাম।
ম্যানচেস্টার প্রবাসী আমার এক ভাই হতাশার সঙ্গে লিখল- ও ভেবে কিনারা করতে পারছে না এমন সংকটে করোনা থেকে আত্মরক্ষার চিন্তা যখন প্রধান, তখন কেমন করে ঈদের কেনাকাটার কথা বলে শপিংমল ও দোকানপাট খুলে দেয়ার ঘোষণা আসে। বিষয়টি যে বাস্তব তা বোঝা গেল ঢাকা শহরের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শপিংমল ও মার্কেটের পরিচালকরা তাদের দোকানপাট ঈদের আগে না খোলার সিদ্ধান্ত নেয়ায়। ইতোমধ্যে ১৪ দল থেকেও দোকানপাট না খোলার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ জানানো হয়েছে। এসব কারণে মনে হচ্ছে সরকারকে বিভ্রান্ত করার মতো পরামর্শদাতা রয়েছে।
এখন আরেকটি আশঙ্কার জায়গা থেকে সরকারকে সতর্ক থাকার অনুরোধ করব। ঈদের আগে অফিস-আদালত খুলে দেয়ার কথা রয়েছে। জানি না ছুটি আরও বাড়ানো হবে কি না। এমনিতে অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধই আছে। কিন্তু বরাবরের মতো নীতিনির্ধারকরা যাতে ‘ঈদের ছুটি’ শব্দ ব্যবহার না করেন। বরং উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে করোনামুক্তির জন্য এই ঈদে যাতে আমরা যার যার অবস্থানেই নিজেদের আটকে রাখি। সামর্থ্যবানরা যাতে ঈদের বাজেট অভুক্তদের সহযোগিতার জন্য ব্যয় করেন। একটি চাপ আছে এবং বাড়বে ঈদের আগে গণপরিবহন খুলে দিতে। এই খাতের মালিক-শ্রমিক সবাই সংকটে আছেন। আমরা নানা পরিসংখ্যানে জানতে পারি চাঁদার শতকোটি টাকা জমা আছে শ্রমিক ও মালিক সংগঠনগুলোর হাতে। এ মুহূর্তে রাজনৈতিক স্বার্থকে বিবেচনায় না এনে যদি সরকারি ব্যবস্থাপনায় এসব অর্থ বিপন্ন শ্রমিকদের টিকে থাকার জন্য ব্যয় করা হয়, তবে এ সংকটে গণপরিবহন না খোলার সিদ্ধান্ত দেয়া যেতে পারে। মনে রাখতে হবে ‘ঈদের ছুটি’ আর গণপরিবহনের ব্যবস্থা থাকলে স্বাস্থ্য সুরক্ষার সব বলয় ভেঙে যাবে। আমরা এমনিতেই খুব ‘নাড়ির টান অনুভব করি’। ঈদে টানের টানাটানিটা বেশি থাকে। সুতরাং বাস্তবের উঠোনে দাঁড়িয়ে কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। বেঁচে থাকলে- ভালো থাকলে আরও অনেক ঈদ পরিজনদের সঙ্গে করা যাবে।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।