শাহানা হুদা রঞ্জনা : বাংলাদেশের আইনে যেখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, ধর্ষণ বা ধর্ষণের পর হত্যা ঘটনায় বাদি-বিবাদির মধ্যে আপস-মীমাংসার কোনো প্রশ্নই আসে না, সেখানে কেন বারবার এইধরনের মামলার আসামি ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে বিয়ে করার সুযোগ পাচ্ছে? এবং সেই সূত্রে বিচারের হাত থেকে পার পেয়ে যাচ্ছে?
ধর্ষণের ঘটনায় কোনো সালিশ হয় না, অথচ দেখছি ধর্ষণের শিকার নারীর সঙ্গে ধর্ষকের বিয়ের ঘটনা বিচারিক আদালতে উঠে আসছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আদালতের নির্দেশে ধর্ষকের সঙ্গে ভুক্তভোগীর বিয়ের বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন এ প্রসঙ্গে স্পষ্ট করে বলেছেন যে ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে কোনো সমাধান নয়, এবং আইন অনুযায়ী ধর্ষকের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
প্রথম আলোতে ২০০২ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ৯ বছরে অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে সাড়ে ৬ বছরের শিশু থেকে শুরু করে কিশোরী ও তরুণী ভুক্তভোগীর বিয়ের অন্তত ২০টি খবর প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে ১১টি বিয়ে টিকে না থাকার তথ্যের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
ধর্ষকের সঙ্গে ধর্ষণের শিকার শিশু ও নারীর বিয়ের এই অবমাননাকর এই উদ্যোগ বন্ধ হোক। আমাদের জোর দাবি জানাতে হবে, কথা বলতে হবে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আন্দোলন এবং নারী অধিকার সংস্থাগুলোর চাপে এই প্রথা অনেক দেশে বাতিল হয়েছে। দুই পক্ষের আপোসের মাধ্যমে আসামির জামিন করানোর জন্য এমন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আরও কঠোর অবস্থান নেয়া উচিত।
এর মানে হচ্ছে এই ধরনের বিয়েকে ‘মুক্তি বা জামিন পাওয়ার ফাঁদ’ হিসেবে ব্যবহার করে অপরাধী ও তার পরিবার। মেয়েপক্ষও মেয়েকে ’ধর্ষণের শিকার হওয়ার’ ও ‘ধর্ষণের কারণে গর্ভবতী হয়ে পড়ার লজ্জার’ হাত থেকে রক্ষার জন্য এই বন্দোবস্ত মেনে নিতে বাধ্য হন।
‘ল্যান্ডমার্ক জাজমেন্টস অন ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন অব বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান’ শীর্ষক বইটিতে বিচারপতি গোলাম রাব্বানী মন্তব্য করেছিলেন, “ধর্ষণ এমন একটি অপরাধ, যা শুধু ভুক্তভোগীকে নয়, পুরো সমাজকে আঘাত করে।” কাজেই সেরকম একটি অপরাধ করে অপরাধী বিয়ে করে পার পেয়ে যায় কোন যুক্তিতে?
বাংলাদেশে ধর্ষকের সঙ্গে ভুক্তভোগীর বিয়ের প্রথা আইনসিদ্ধ নয়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ অনুযায়ী ধর্ষণ একটি গুরুতর অপরাধ, এবং এর কোনো আপস-মীমাংসা বা বিয়ের মাধ্যমে সমাধানের বিধান নেই। এই আইনের ধারা ৯ অনুযায়ী ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে, এবং এটি একটি অ-আপসযোগ্য অপরাধ। তবে বাস্তবে কিছু ক্ষেত্রে সামাজিক চাপ, পারিবারিক সিদ্ধান্ত বা স্থানীয় মধ্যস্থতার কারণে ধর্ষকের সঙ্গে ভুক্তভোগীর বিয়ের ঘটনা ঘটতে দেখা যায়, যা আইনের চেতনার পরিপন্থি।
পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কেউ ভাবে না একজন ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে হলে সেই মেয়ে মানসিকভাবে কতটা বিপর্যস্ত হতে পারে। এমনও দেখা গেছে, বিয়ে করার পর ধর্ষকের জামিন হয়ে গেলে মেয়েটিকে সে তালাক দিয়ে দেয়, তখন কারো কিছু আর বলার থাকে না। বরং ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে তাকে আবারও নির্যাতন সহ্য করার নতুন একটা ব্যবস্থা করা হয়।
এরকমই অন্য একটি মামলা প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শারমিন আক্তার ধর্ষকের সঙ্গে ভুক্তভোগীর বিয়ে প্রসঙ্গে গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, বিয়েটাকে ‘জামিনের একটা গ্রাউন্ড’ হিসেবে ব্যবহার করে অপরাধীরা। বিচারকেরা যখন দেখেন যে বিয়ে হয়ে গেছে, কাজেই জামিন দিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু পরে এই মামলাগুলো আর এগিয়ে যায় না। কারণ, ওই আসামির প্রতি মামলা চালানোর ইচ্ছাটা বাদীর আর থাকে না, কিন্তু মামলা চালু থাকে।
তিনি মনে করেন, এর মাধ্যমে সমাজে একটা ভুল বার্তা যায়। কারণ তখন ধর্ষক মনে করে, ‘আমি ধর্ষণ করলাম এবং যাকে ধর্ষণ করলাম, তাকে বিয়ে করার মাধ্যমে মুক্তি পেয়ে গেলাম।’ সেক্ষেত্রে ধর্ষণের জন্য যে বিচার ও শাস্তি সেটা আর তাকে ভোগ করতে হয় না, মামলার কোনো ফলোআপ থাকে না।
এমন অসংখ্য ঘটনা আছে, যেখানে সমঝোতার মাধ্যমে অভিযুক্তের সঙ্গে বিয়ের পর মেয়েগুলো নির্যাতনের শিকার হয়, বিবাহবিচ্ছেদ হয় বা বিয়ে টেকে না। প্রথম আলো গত চার বছরের মধ্যে অভিযুক্তের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে এমন ৮ জন ভুক্তভোগী ও পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলেছে। তারা সংসার তো করতে পারেনই-নি, উপরন্তু ধর্ষণের ফলে জন্ম নেওয়া সন্তানের স্বীকৃতি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। একজন ভুক্তভোগী হত্যারও শিকার হয়েছেন। এছাড়া আরও ৫ জন ভুক্তভোগী ও পরিবারগুলো জানিয়েছে তারা লোকলজ্জার ভয়ে নিজেরাই অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ের মাধ্যমে সমাধান চাইছে। যে কিশোরী ও তরুণী ধর্ষণের ফলে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছেন, তাদের পরিবারের সদস্যরা ‘বিয়ে ছাড়া উপায় নেই’ এমন অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন।
জাতিসংঘের সিডও এবং অন্যান্য মানবাধিকার সনদে ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ের প্রথাকে নারীর অধিকারের লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ফলে, অনেক দেশ এই প্রথা বাতিল করেছে। বর্তমানে কোনো দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ের রায় দেওয়ার আইনি বিধান নেই, কারণ এটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের পরিপন্থি। তবে, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের মতো কিছু দেশে সামাজিক চাপ বা আদালতের বাইরে আপস-মীমাংসার মাধ্যমে এমন ঘটনা ঘটে থাকে, যা আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে অগ্রহণযোগ্য।
আমাদের সমাজে ধর্ষণ মামলার আপস-মীমাংসার নামে যেটা হয়, সেটা হলো বিভিন্ন মহল থেকে নানা চাপ ও টাকার লোভ দেখিয়ে মামলা তুলে নেওয়ার একটি উপায় বের করা। সেক্ষেত্রে এই বিয়ের প্রস্তাবটাও একধরনের প্রলোভন। নির্লজ্জ সমাজ একবারও ভাবে না যে ধর্ষকের সঙ্গে জীবন কাটানোটা একজন নারীর পক্ষে কতটা লজ্জার ও কষ্টের হতে পারে? পরিবার থেকেও মেয়েটিকেও বাধ্য করা হয় এই রফা মেনে নিতে। ভুক্তভোগী মেয়ে বা নারী ধর্ষণের বিচারতো পানই না, উপরন্তু অপরাধীর সঙ্গে সংসার করার জন্য তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
ধর্ষণের শিকার মেয়েটির পরিবার যদি দরিদ্র হন, তারা হয়তো ভাবেন, বিয়ের মাধ্যমে মেয়েটির একটি হিল্লে হবে বা সমাজে মুখ দেখানোর একটা ব্যবস্থা হবে। তা না হলে ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে নিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হবে। এই মেয়েটিকে ভবিষ্যতে কে বিয়ে করবে? তাই বাদী ও বিবাদী ফয়সালা করে এক অমানুষের সঙ্গে মেয়েটিকে থাকতে বাধ্য করে।
ধর্ষণের অভিযোগে আটক নোবেলের সাম্প্রতিক মামলার রায় নিয়ে এই আলোচনা আবার উঠে এলো। যে মেয়েটি নোবেলের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও আটকে রাখার অভিযোগ করেছেন, সেই মেয়েটিকেই আদালতের রায়ে বিয়ে করেছেন গায়ক নোবেল। কারা কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান ফটকে তাদের বিয়ে হয়। বাদী ও আসামি দুইপক্ষের সম্মতি সাপেক্ষে বিয়ের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
ডেমরা থানার পুলিশ আদালতকে লিখিতভাবে জানিয়েছিল, গত বছরের ১২ নভেম্বর ডেমরায় নোবেলের স্টুডিও দেখানোর জন্য ওই মেয়েটিকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাকে নেবেল ধর্ষণ করে এবং ধর্ষণের সেই ভিডিও ধারণ করে। ভয় দেখিয়ে সাত মাস ধরে ওই বাসায় মেয়েটিকে আটকে রাখা হয়েছিল। অতঃপর বিয়ের মাধ্যমে হয়তো নোবেলের সাজা মওকুফ হয়ে যাবে। পাশাপাশি মেয়েটিকে আটকে রেখে ধর্ষণের ভিডিওধারণ করার অপরাধের বিচারও হয়তো মিটমাট হয়ে যাবে।
বিশ্বে আদালতের রায়ে ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে বিয়ের কোনো নজির কি আছে? অন্যান্য দেশে মানবাধিকারের দৃষ্টিতে এই পদ্ধতিকে কীভাবে দেখা হয়? বর্তমানে বিশ্বের অধিকাংশ দেশে ধর্ষকের সঙ্গে ভুক্তভোগীর বিয়ের রায় দেওয়ার প্রথা আইনগতভাবে গ্রহণযোগ্য নয় এবং এটি মানবাধিকারের পরিপন্থি হিসেবে বিবেচিত হয়। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ের কোনো আইনি বা সামাজিক প্রথা নেই। ধর্ষণের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে, এবং এমন কোনো রায়ের নজির পাওয়া যায় না। তবে, অতীতে বা কিছু নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক ও আইনি প্রেক্ষাপটে কিছু দেশে এমন প্রথা ছিল, যেখানে ধর্ষণের শিকার নারীকে ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে বিষয়টির “সমাধান” করার চেষ্টা করা হতো। বর্তমানে এই প্রথা বেশিরভাগ দেশে নিষিদ্ধ।
মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ যেমন জর্ডান, লেবানন, মরক্কো (২০১৪) তিউনিসিয়াতে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ধর্ষক যদি ভুক্তভোগীকে বিয়ে করতে সম্মত হতো, তবে তার শাস্তি মওকুফ করা হতো। তবে, নারী অধিকারকর্মীদের আন্দোলনের ফলে এই আইন বাতিল করা হয় প্রায় সবদেশেই। মরক্কোতে ২০১২ সালে ধর্ষণের শিকার আমিনা ফিলালি নামে এক কিশোরীর আত্মহত্যার ঘটনার পর এই আইনের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন হয়, যা সংস্কারের পথ তৈরি করে।
আফ্রিকার দেশ মিশর, নাইজেরিয়ার মতো কিছু দেশে অতীতে কিছু ক্ষেত্রে সামাজিক প্রথার কারণে ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ের প্রচলন ছিল, তবে বর্তমানে এটি আইনগতভাবে সমর্থিত নয়। পেরু, বলিভিয়া, ব্রাজিল এবং কোস্টারিকাতে ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে এবং ২০০০-এ এই ধরনের আইনগুলো বাতিল করা হয়।
ভারতে ধর্ষণ একটি গুরুতর অপরাধ এবং আইনত বিয়ের মাধ্যমে শাস্তি মওকুফের কোনো বিধান নেই। তবে, কিছু ক্ষেত্রে সামাজিক চাপে বা আদালতের বাইরে আপস-মীমাংসার মাধ্যমে এমন ঘটনা ঘটতে পারে। পাকিস্তানে শরিয়া আইন এবং স্থানীয় প্রথার কারণে গ্রামীণ এলাকায় কিছু ক্ষেত্রে ধর্ষণের ঘটনায় বিয়ের মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করা হয়। তবে, পাকিস্তানের আইনে ধর্ষণের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে, এবং বিয়ের মাধ্যমে শাস্তি মওকুফের কোনো আইনি বিধান নেই।
একজন ধর্ষকের সঙ্গে ধর্ষণের শিকার মেয়েটির বিয়ে দেওয়া মানে মেয়েটিকে আগুনে ছুঁড়ে ফেলার নামান্তর। সেই অগ্নিকুণ্ডে সে আরও ঝাঁঝরা হবে, পুড়ে যাবে তার স্বপ্ন, সাধ ও পরিচয়। মহামান্য বিচারক সাবেরা সুলতানা খানম এক রায়ে বলেছিলেন, ‘মেয়েটার পুরো ভবিষ্যৎ সামনে পড়ে আছে। সবাই মিলে কীভাবে মেয়েটিকে প্রতিষ্ঠিত করা যায়, সেই চেষ্টা করুন। ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে দিয়েন না। মেয়েটি প্রতিষ্ঠিত হলে অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়াবে।’
আমরাও চাই, সমাজ নারীর এ অমর্যাদাকে প্রতিহত করুক। ধর্ষকের সঙ্গে ধর্ষণের শিকার শিশু ও নারীর বিয়ের এই অবমাননাকর এই উদ্যোগ বন্ধ হোক। আমাদের জোর দাবি জানাতে হবে, কথা বলতে হবে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আন্দোলন এবং নারী অধিকার সংস্থাগুলোর চাপে এই প্রথা অনেক দেশে বাতিল হয়েছে। দুই পক্ষের আপোসের মাধ্যমে আসামির জামিন করানোর জন্য এমন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আরও কঠোর অবস্থান নেয়া উচিত।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।