অভিজাত ধানমন্ডি এলাকার জনগণের জন্য তৈরি করা খেলার মাঠটি এক দশকের বেশি সময় বেদখল। অবৈধভাবে তৈরি করা হয়েছে স্থায়ী অবকাঠামো। বাণিজ্যিকভাবে ফুটবল, ক্রিকেট ও টেবিল টেনিস খেলার কোচিং করানো হয়। পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সরকারের সময়ে শেখ জামাল ক্লাবের নামে ওই বাণিজ্যিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের পর শেখ জামাল নাম পরিবর্তন করে ধানমন্ডি স্পোর্টস ক্লাব করা হয়েছে। ক্লাবটি ঘিরে সবকিছু চলছে বহাল তবিয়তে। মাঠ দখলের বৈধতা পেতে এর ইজারা নিতে ধানমন্ডি সোসাইটি নতুন করে চেষ্টা শুরু করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
সরেজমিন তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর ধানমন্ডি এলাকার বিভিন্ন পক্ষ মাঠটির দখল নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। তবে গণপূর্ত অধিদপ্তর এবং ধানমন্ডি সোসাইটির বাধায় সেটি সম্ভব হয়নি। বর্তমানে ওই মাঠের তদারকি রয়েছে গণপূর্ত ও ধানমন্ডি সোসাইটির হাতে। রুটিন করে তারা দায়িত্ব পালন করছে। তবে ওই মাঠে গড়ে তোলা অবৈধ অফিস ভবন, বসার স্থানের অবকাঠামো, টেবিল টেনিস কোর্ট, ক্রিকেট অনুশীলন ভবন এবং ফুটবল একাডেমি বাণিজ্যিকভাবে বহাল তবিয়তে চলছে। আগে যারা কোচিংয়ের নামে টাকা নিয়ে একাডেমি পরিচালনা করতেন, তারাই পরিচালনা করছেন।
সূত্র জানায়, খেলার মাঠ বেদখলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছিল। নিজের ভাইয়ের নামে ক্লাব হওয়ায় তার পছন্দেই ঠিক করা হতো পরিচালনা পর্ষদ। মাঠের বেআইনি দখলে পক্ষ নিয়েছিল তৎকালীন সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ক্রীড়াসংশ্লিষ্টরা।
সরেজমিন দেখা যায়, ধানমন্ডি ৮ ও ৯ নম্বর সড়কের মাঝখানে অবস্থিত খেলার মাঠটি ব্যবহার করে টাকার বিনিময়ে একাডেমিতে ভর্তিকৃতরা মাঠে খেলার সুযোগ পাচ্ছে। এর বাইরে এলাকার কেউ প্রবেশ করে কোথাও খেলবে, তেমন কোনো জায়গা বা সুযোগ নেই। টেবিল টেনিস কোর্ট, ফুটবল মাঠ ও ক্রিকেট খেলার জন্য আলাদা আলাদা করে স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। কেউ প্রবেশ করলে কেন এসেছেন, কার কাছে যাবেন-এমন বিভিন্ন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। ওই মাঠে একাডেমির সদস্যদের বসার জন্য স্থানও তৈরি করা হয়েছে। সেখানে বাইরের কেউ বসতে পারেন না। সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ এখনো ওই একাডেমির দায়িত্বপ্রাপ্তদের হাতে।
এলাকাবাসী মনে করেন, একটি খেলার মাঠ কোনো ক্লাবের হতে পারে না। এটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকতে হবে। নগরীর অন্য ১০টি খেলার মাঠ যেভাবে চলছে; ধানমন্ডি মাঠও সেভাবে পরিচালিত হতে হবে। কিন্তু বহু বছর সেভাবে চলছে না। সরকারসংশ্লিষ্টদের ছত্রছায়ায় মাঠটি বারবার বেদখল হয়েছে। আর বরাবর চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা সিটি করপোরেশন এবং মাঠের মালিক গণপূর্ত অধিদপ্তর। এখন মাঠ দখলমুক্ত করার উপযুক্ত সময়। ওই মাঠে অবৈধভাবে নির্মিত সব স্থাপনা ভেঙে দিতে হবে। সেখানে গণপূর্ত, সিটি করপোরেশন এবং এলাকাবাসী নতুনভাবে পরিকল্পনা করে মাঠের উন্নয়নকাজ করবে। বিদ্যমান মাঠ পরিচালনার নীতিমালা অনুসরণ করবে, প্রয়োজন হলে নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করবে। এর বাইরে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে মাঠের ইজারা দেওয়া যাবে না। এর বাইরে কোনো সিদ্ধান্ত হলে ধানমন্ডি মাঠ দখলমুক্ত হবে না।
জানা যায়, মিরপুর রোডসংলগ্ন ধানমন্ডির এ মাঠটি প্রায় ১৪ বিঘা জমির ওপর। জমি অধিগ্রহণ সূত্রে মাঠের মালিকানা গণপূর্ত অধিদপ্তরের। তবে ১৯৮৩ সালের ৩০ অক্টোবর মাঠটি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে তৎকালীন ঢাকা মিউনিসিপলিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। খেলার মাঠটি সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তরের উদ্দেশ্য ছিল-মাঠ ও পার্ক হিসাবে ওই জায়গাটি রক্ষণাবেক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় উন্নয়নকাজ করা। মাঠের দায়িত্ব গ্রহণ করেও ঢাকার প্রধান নগর সংস্থা বর্তমানে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কর্তব্য পালনে মারাত্মক গাফিলতি করেছে। যে কারণে মাঠটি বেহাত হয়েছে।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ২০০৪ থেকে ২০০৫ সালে ওই মাঠ প্রথম বেদখল হয়। ওই সময় থেকে মাঠ দখলের বিরুদ্ধে সোচ্চার এলাকাবাসী। তখন দখলকারীরা ধানমন্ডি মাঠকে নিজেদের ঘোষণা করে মাঠের চারপাশে সীমানা প্রাচীর গড়ে তোলে। একই সঙ্গে মাঠে নিজেদের মালিকানা দাবি করে সাইনবোর্ডও টানিয়ে দেয়। তখন এলাকাবাসী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তারা বলেছিলেন মাঠটি জনগণের। সরকারি কোনো নোটিশ ছাড়া এটি দখল করা অবৈধ।
এরপর ২০০৬ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে ধানমন্ডি মাঠের দখলদারি বন্ধ এবং খেলার মাঠের পরিবেশ উন্নয়নে পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) নেতৃত্বে নাগরিক উদ্যোগ, সেভ দি এনভায়রনমেন্টাল মুভমেন্ট (সেভ) আন্দোলন করে। এ সময় সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন, মৌনমিছিলসহ বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালন করা হয়। দখল-উচ্ছেদ খেলা চলতে থাকে। এর মধ্যে ২০১৪ সালে সেখানে শেখ জামাল স্পোর্টস ক্লাবের ব্যানারে ঢুকে পড়ে পতিত সরকারের প্রভাবশালী চক্র। তারা সেখানে পোক্তভাবে স্থাপনা নির্মাণকাজ শুরু করে। তখনো ধানমন্ডি খেলার মাঠ সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার দাবিতে আন্দোলনে নামে অর্ধশত পরিবেশবাদী সংগঠন। ওই সময় মাঠের ফটক ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করার অপরাধে পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়। মামলা করেছিলেন তৎকালীন শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক। ওই মামলায় মরহুম স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন, স্থপতি ইকবাল হাবিব, সালমা এ সফি, কামরুন্নাহারসহ ২০০ জনকে আসামি করা হয়। এ ঘটনায় কয়েকজন সমাজসেবক ও পরিবেশ আন্দোলনকর্মীকে কারাবরণও করতে হয়েছে। অবৈধ দখলের পক্ষে অবস্থান নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন পালিয়ে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পছন্দের মানুষ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সাবেক সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সাবেক সভাপতি কাজী মো. সালাউদ্দিন এবং বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের (বিওএ) সাবেক মহাসচিব সৈয়দ শাহেদ রেজা এবং শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবের তৎকালীন সভাপতি মনজুর কাদেরসহ অনেকে।
তথ্যানুসন্ধানে আরও জানা যায়, ধানমন্ডি মাঠ দখলের প্রতিবাদে হাইকোর্টে রিট করা হয়। ২০১১ সালে ওই রিট মামলার রায়ে বলা হয়-ধানমন্ডি মাঠ জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত স্থান হিসাবে থাকবে। এটি কোনো ক্লাবের মালিকানাধীন মাঠ নয়। মাঠে স্থাপনা নির্মাণ, প্রাচীর তোলা বা গেট বসানো অবৈধ। এরপর সিটি করপোরেশন গেট খুলে দিলেও তা আবার ক্লাব কর্তৃপক্ষ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। মাঠটি পরিচালনার জন্য সিটি করপোরেশন দায়িত্বপ্রাপ্ত। কিন্তু তারা দায় নেয়নি। ফলে তাদের দায়িত্বহীনতার সুযোগে দখলদারচক্র বারবার মাঠটি দখলে নিয়েছে। অথচ ধানমন্ডি মাঠটি বহু বছর ধরে একটি পরিত্যক্ত মাঠ হিসাবে ব্যবহার হয়েছে। তখন আশপাশের বাসিন্দা, স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী, খেলোয়াড় এবং ক্রীড়া সংগঠকরা এটি ব্যবহার করতেন। স্থানীয়রা বলছেন, এটি (ধানমন্ডি মাঠ) এখন আর কোনো মাঠ নয়। একটি ক্লাব কমপ্লেক্সে পরিণত হয়েছে। সরকারি একটি মাঠ এভাবে চলতে পারে না।
এ প্রসঙ্গে স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ধানমন্ডি মাঠ সাধারণ জনগণের। এটি কোনো ক্লাব বা গোষ্ঠীর হতে পারে না। মাঠ দখলমুক্ত করে সাধারণ জনগণের প্রবেশ অবাধ করতে হবে। পাশাপাশি সেখানে যেসব অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে, সেসব ভেঙে ফেলতে হবে। গণপূর্ত ও সিটি করপোরেশন এলাকাবাসীর সঙ্গে আলোচনা করে মাঠের প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে পারে। মাঠে গড়ে ওঠা সব ধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে।
তিনি জানান, ধানমন্ডি মাঠের দখলদারদের বিরুদ্ধে কথা বলায় তার নামে মামলা হয়েছে। ওই মামলায় জেল-হাজতও খাটতে হয়েছে। তিনিসহ আরও অনেকের নামে মামলা হয়, তবু তারা কথা বলেছেন, প্রতিবাদ করে গেছেন। এখন মাঠটি দখলমুক্ত করার সময় এসেছে।
এ প্রসঙ্গে ধানমন্ডি সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক নাজমুল ওয়াসিক হক অলক বলেন, ধানমন্ডি মাঠটি এতদিন বেদখল ছিল। সেখানে এলাকার সাধারণ মানুষ প্রবেশ করতে পারত না। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর এলাকার মস্তানরা মাঠটির দখল নিতে চেষ্টা করেছিল। ধানমন্ডি সোসাইটি তাদের হটিয়ে দেয়। এরপর গণপূর্ত অধিদপ্তরের নিরাপত্তাকর্মী এবং সোসাইটির নিরাপত্তাকর্মীদের সহায়তায় মাঠটি দখলমুক্ত রাখা হয়েছে। এখন মাঠে সর্বসাধারণের প্রবেশে কোনো বাধা নেই।
তিনি জানান, মাঠটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে গণপূর্ত অধিদপ্তর এবং সিটি করপোরেশনের কাছে ইজারা পেতে আবেদন করেছেন। ইজারার আবেদন দুটি প্রতিবেদকে দিতে বললে দেবেন বলে তার অফিসে দেখা করতে বলেন। ধানমন্ডি সোসাইটির অফিসে গিয়ে দেখা করলেও তিনি ওই আবেদনের কপি দেননি। এমনকি হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাবেন বললেও তা পাঠাননি।
এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সম্পত্তি কর্মকর্তা হাসিবা খান বলেন, ধানমন্ডি মাঠটি সিটি করপোরেশনের কি না, সে বিষয়ে কোনো তথ্য আমার জানা নেই। আর এ সংক্রান্ত কোনো ফাইলও সম্পত্তি বিভাগে নেই।
এ বিষয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার বলেন, ধানমন্ডি মাঠটি গণপূর্তের। এটি সঠিক। তবে এটি সিটি করপোরেশনকে দেওয়া হয়েছিল রক্ষণাবেক্ষণের জন্য। মাঠটির অবস্থান এখনো আগের মতোই। তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর সেখানে গণপূর্ত থেকে নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন করা হয়েছে। এখন সর্বসাধারণের প্রবেশের অনুমতি রয়েছে।
তিনি জানান, মাঠটির অবৈধ স্থাপনার কী হবে এবং নতুন ব্যবস্থাপনা কেমন হবে-এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলব। হয় এটি সিটি করপোরেশন করবে, না হয় গণপূর্তে ফেরত আনা হবে। তবে সবকিছু নির্ভর করছে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের ওপর।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও জানান, ধানমন্ডি মাঠের ইজারা নিতে ধানমন্ডি সোসাইটি আবেদন করেছে। গণপূর্তের পাশাপাশি তারা সিটি করপোরেশনেও আবেদন করেছে। কেউ আবেদন করলেই তারা মাঠের দায়িত্ব পেয়ে গেছেন, বিষয়টি এমন নয়। মাঠটি জনগণের ব্যবহারের উপযোগী করে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।