ধর্ম ডেস্ক : ধৈর্য এমন এক মহাবস্তু যা আপনাকে অপমান থেকে রক্ষা করবে, বিপদ থেকে বাঁচিয়ে দেবে, কষ্টের পরে সুখ দেবে, সহজেই সফলতা এনে দেবে।
ধনুক থেকে তির নিক্ষেপ হলে যেমন তাকে ফেরানো যায় না, তেমনি ধৈর্যের সফলতাকে রুখা যায় না। ধৈর্য একটি নীরব বিপ্লব বা সাধনা যা মানুষকে আস্তে আস্তে আকাশচুম্বি মর্যাদায় আসীন করে। মনুষ্য চরিত্রের সবচে’ কঠিনতম দিক হলো ধৈর্য।
যে চরিত্রে ধৈর্য নেই তাতে উন্নতি নেই। চরিত্রের স্বর্ণ ভূষণ হলো ধৈর্য। সমাজে প্রচলন আছে ধৈর্য তিতা কিন্তু ধৈর্যের ফল খুবই মিষ্টি ও সুস্বাদু। যুগে যুগে কালের ধৈর্য পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হয়েছেন তারাই পেয়েছেন সফলতা স্বর্ণস্বাদ। দুনিয়াবি হোক আর পরকালীন হোক সকল সফলতার পেছনের গল্পগুলো হলো ধৈর্যের। হজরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকলেই ছিলেন ধৈর্যের শক্ত ও সবল পিরামিড। নববী চরিত্রের প্রধান ও অন্যতম উপাদান হলো ধৈর্য।
ধৈর্যের পরিচয়: ধৈর্য এমন এমন দ্রুততর ঘোড়া যা কখনো পথ হারায় না বা হোঁচট খায় না। ধৈর্য এমন এমন মজবুত তরবারি যা কখনো মচকায় না। ধৈর্য এমন রশি যা কখনো ছিঁড়ে না। বিপদ অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে মন মেজাজ ঠিক রেখে যুক্তিসই আচার আচরণ বিচরণকে ধৈর্য বলে। যে মানুষ ধৈর্যশীল হয় সেই ঈমানের ওপর অটল থাকতে পারে; বেশি থেকে বেশি ভালো কাজ করতে পারে; বদকাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারে। তাই তার অন্তর যাবতীয় হতাশা-নিরাশা ও চঞ্চলতা থেকে মুক্ত থাকে এবং সে জীবনে সফলতা অর্জন করতে পারে। কুরআন পাকে সত্তরেরও অধিক স্থানে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বহু হাদিসে সবর ও এর ফায়েদার কথা বর্ণিত হয়েছে। যেমন মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যম সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যধারীদের সঙ্গে আছেন। (সূরাতুল বাকারাহ, আয়াত: ১৫৩)। বিখ্যাত বুজুর্গ জুনাইদ বোগদাদি (রহ.)-কে ধৈর্য কী জিজ্ঞেস করা হলে তিনি উত্তরে বলেন হতাশা-নিরাশা ও অভিযোগ প্রকাশ ব্যতীত ধারাবাহিক বিপদের তিক্ততা সহ্য করে বেড়ানোর নাম ধৈর্য। হজরত জুননুন মিসরি (রহ.) বলেন, সর্বদা আল্লাহ তায়ালার বিরোধিতা থেকে দূরে থাকা, বিপদের সময় প্রশান্ত মনে স্থির থাকা এবং দারিদ্রের সময় প্রাচুর্য প্রকাশ করার নামই ধৈর্য। বিখ্যাত সাহাবি হজরত সাইদ ইবনে জুবাইর (রাযি.) বলেন, ধৈর্য সবর ও সহ্য ক্ষমতা হচ্ছে বান্দার মানিত বদনে হাস্যোজ্জ্বল মুখে সব বিপদ ভয় সহ্য করে আল্লাহর দরবারে সওয়াবের আশা করা।
আমাদের বিশ্বাসগ্রন্থ আল কোরআনে স্থানে স্থানে ধৈর্যের আদেশ দিয়ে আসছে। শুধু আদেশ নয়; ধৈর্যের উপকারিতা, ধৈর্যের ফলাফল ও ধৈর্যশীলদের পুরস্কারের কথা ব্যক্ত করা হয়েছে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন আঙ্গিকে। আমরা এখন কোরআন থেকে শুনবো ধৈর্যের বর্ণনা। আল্লাহ তায়ালা ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন। ঘোষণা হচ্ছে, ‘আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করবে পরস্পর ঝগড়া বিবাদ করবে না, অন্যথায় তোমরা দুর্বল হয়ে পড়বে এবং তোমাদের হওয়া প্রভাব বিলুপ্ত হবে। আর ধৈর্য ধারণ করবে নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।’ (সূরাতুল আনফাল, আয়াত: ৪৬)।
কণ্টকাকীর্ণ জীবন, বিপদময় দিনাতিপাত, উষ্ঠাগত উৎপীড়ন দুর্ভিক্ষ ও দুর্দিন দিবে আল্লাহ তায়ালা। এগুলো যারা ধৈর্যের হাতিয়ার দিবে মুকাবিলা করবে তাদের জন্য রয়েছে শুভ সংবাদ। ঘোষণা হচ্ছে, আর আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করবো (কখনো) কিছুটা ভয়ভীতি দ্বারা, (কখনো) ক্ষুধা দ্বারা এবং কখনো জান-মাল ও ফল ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা। সুসংবাদ শোনাও তাদেরকে, যারা (এরূপ অবস্থায়) সবরের পরিচয় দেয়। (সূরাতুল বাকারাহ, আয়াত: ১৫৫)।
ধৈর্যশীলরা একাল ও পরকালে সফলতম ব্যক্তি। বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ নেয়ামত লাভে ধন্য। মহান আল্লাহ ধৈর্য ও দৃঢ়বিশ্বাস অর্জনের সঙ্গে ধর্মীয় নেতৃত্ব সংযুক্ত করে দিয়েছেন। ঘোষণা হচ্ছে-
وَجَعَلْنَا مِنْهُمْ أَئِمَّةً يَهْدُونَ بِأَمْرِنَا لَمَّا صَبَرُوا وَكَانُوا بِآيَاتِنَا يُوقِنُونَ
তরজমা : ‘আমি তাদের মধ্য থেকে নেতা মনোনীত করেছিলাম যারা পথপ্রদর্শন করতো আমার নির্দেশ অনুসারে। যেহেতু তারা ধৈর্যধারণ করেছিল এবং তারা ছিল আমার আয়াতের ওপর দৃঢ়বিশ্বাসী। (সূরা আসসাজদাহ, আয়াত: ২৪)।
চরম সুযোগ ও সংকটের সময়ও যদি কেউ ধৈর্য ধারণ করে তার জন্য রয়েছে পুরস্কার ও সম্মান। সুযোগ থাকার পরও প্রতিশোধ না নিয়ে ধৈর্যের পরিচয় প্রদানকারীদের জন্য রয়েছে সমূহমঙ্গল। ঘোষণা হচ্ছে, ‘তোমরা যদি (কোনো জুলুমের) প্রতিশোধ নাও, তবে ঠিক ততটুকুই নেবে, যতটুকু জুলুম তোমাদের ওপর করা হয়েছে আর যদি সবর কর, তবে নিশ্চয়ই সবর অবলম্বনকারীদের পক্ষে তাই শ্রেয় এবং (হে নবী!) তুমি সবর অবলম্বন করো। তোমার সবর তো আল্লাহরই সাহায্যে হবে। তুমি কাফেরদের জন্য দুঃখ করো না এবং তারা যে ষড়যন্ত্র করে তার কারণে কুণ্ঠিত হয়ো না।’ (সূরাতুন নাহল, আয়াত: ১২৬-১২৭)।
যদি মানুষ চতুর্মুখি ষড়যন্ত্র কিংবা কোনো দুর্যোগ-দুর্বিপাকের মধ্যে পড়ে। সেখানেও চাই ধৈর্যের পরিচয়। যদি ওই অবস্থায়ও কেউ ধৈর্যের সাথি হতে পারে! ধৈর্যের কষ্ট যাতনা গায়ে নিতে পারে! তবে তার জন্য কোনো ষড়যন্ত্রই সফল হবে না। আল্লাহ ঘোষণা করছে সেই কথা, ‘তোমাদের যদি কোনো কল্যাণ লাভ হয়, তাদের খারাপ লাগে, পক্ষান্তরে তেমাাদের মন্দ কিছু ঘটলে তারা তাতে খুশি হয়। তেমারা সবর ও তাকওয়া অবলম্বন করলে তাদের চক্রান্ত তোমাদের কোনো ক্ষতি সাধন করতে পারবে না। তারা যা কিছু করছে তা সবই আল্লাহর (জ্ঞান ও শক্তির) আওতাভুক্ত।’ (সূরাতু আলে ইমরান, আয়াত: ১২০)।
একজন মুমিনের চূড়ান্ত প্রাপ্তি কী? প্রতিজন মুমিন চায় সে আল্লাহর ভালোবাসা পাক। ভালোবাসার পাবার হাজারো মাধ্যমের উল্লেখযোগ্য একটি মাধ্যম হলো ধৈর্য। ঘোষণা হচ্ছে, ‘এমন কতো নবী রয়েছে যাদের সঙ্গে মিলে আল্লাহ ওয়ালারা যুদ্ধ করেছে। এর ফলে আল্লাহর পথে তাদের যে কষ্টক্লেশ ভোগ করতে হয়েছে, তাতে তারা হিম্মত হারায়নি দুর্বল হয়ে পড়েনি এবং তারা নতি স্বীকারও করেনি। আল্লাহ ধৈর্যশীল লোকদের ভালোবাসেন।’ (সূরাতু আলে ইমরান, আয়াত: ১৪৫)।
মুমিনের আরেকটি বড়ো প্রাপ্তির হলো জাহান্নাম থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে জান্নাতের অধিবাসী হওয়া। সেই জান্নাতের অধিবাসী হওয়ার বহু পথ ও তরিকা রয়েছে। কিন্তু কোরআন বহুপথ ও তরিকা থেকে ধৈর্যের পথকে উল্লেখ করছে-
إِنِّي جَزَيْتُهُمُ الْيَوْمَ بِمَا صَبَرُوا أَنَّهُمْ هُمُ الْفَائِزُونَ
তরজমা : ‘আজ আমি তাদের ধৈর্যধারণের কারণে এমন প্রতিদান দিয়েছি যে, তারাই হচ্ছে সফলকাম।’ (সূরাতুল মু’মিনুন, আয়াত: ১১১)।
আল কোরআনুর কারিমে যেভাবে ধৈর্যের আদেশ দেয়া হয়েছে এবং গুণাগুণ বর্ণনা করা হয়েছে তেমনি হাদিস শরিফেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বিষয়ে পর্যাপ্ত উপদেশ দিয়েছেন। হাদিসে রয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা রাযিআল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘মুসলমানদের ওপর যে সব বালা মুসিবত যাতনা রোগ ব্যাধি উদ্বিগ্ন-উৎকণ্ঠা দুশ্চিন্তা কষ্ট পেরেশানি আপতিত হয়, এমনকি তার গায়ে যে কাটা বিঁধে; এসবের জন্যও তাকে আল্লাহ তায়ালা তার গুনাহ মাফ করে দেবেন।’ (বুখারি, হাদিস নম্বর ৫৩১৮)।
আম্মাজান হজরত আয়েশা ছিদ্দিকা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, কোনো মুসলমান বিপদে পড়লে আল্লাহ তায়ালা বিনিময়ে তার গোনাহ ক্ষমা করে দেন। এমনকি (সেই বিপদ) পথের কাটা হোক না কেন, যার ব্যথা সে অনুভব করে। (বুখারি)। অন্য এক হাদিসে এসেছে ‘মুমিন ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাত করার আগ পর্যন্ত জান-মাল, সন্তান- সন্তুতির ওপর ধারাবাহিক বিপদ আসতেই থাকবে। অতপর যখন সে প্রভুর সঙ্গে মিলিত হবে তখন তার কোনো গোনাহ অবশিষ্ট থাকবে না।’ (মুসনাসে আহমদ ৮৭৫৬)।
আল কোরআনে ধৈর্যের আলোচনা: আমরা প্রবন্ধের আল কোরআন থেকে একাধিক ধৈর্যসম্পর্কিত আয়াত উল্লেখ করছি। এছাড়াও আরো কিছু আয়াত রয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ সাহায্য কামনা করো ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে। নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।’ (সূরাতুল বাকারাহ: আয়াত নম্বর ১৫৩)।
অপর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘পূণ্য তো কেবল এটাই নয় যে, তোমরা নিজেদের চেহারা পূর্ব বা পশ্চিম দিকে ফেরাবে, রবং পূণ্য হলো সেই ব্যক্তির কার্যাবলি যে ঈমান রাখে আল্লাহর ওপর শেষ দিনের ও ফিরিশতাদের প্রতি এবং (আল্লাহর) কিতাব ও নবীগণের প্রতি। আর আল্লাহর ভালোবাসায় নিজ সম্পদ দান করে আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতিম মিসকিন মুসাফির ও সওয়ালকারীদেরকে এবং দাসমুক্তিতে এবং সালাত কায়েম করে ও জাকাত দেয় এবং যারা কোনো প্রতিশ্রতি দিলে তা পূরণে যত্নবান থাকে এবং সঙ্কটে কষ্টে যুদ্ধকালে ধৈর্যধারণ করে। এরাই তারা, যারা সাচ্চা (নামে অভিহিত হওয়ার উপযুক্ত) এবং এরাই মুত্তাকি। আরো বলা হয়েছে, ‘অতপর তালুত যখন সৈন্যদের সঙ্গে রওয়ানা হলো, তখন সে (সৈন্যদেরকে) বলল, আল্লাহ একটি নদীর দ্বারা তোমাদেরকে পরীক্ষা করবেন। যে ব্যক্তি সে নদীর পানি পান করবে, সে আমার লোক নয়। আর যে তা আস্বাদন করবে না, সে আমার লোক। অবশ্য কেউ নিজ হাত দ্বারা এক আঁজলা ভরে নিলে কোনো দোষ নেই। তারপর (এই ঘটল যে,) তাদের অল্প সংখ্যক লোক ছাড়া বাকি সকলে নদী থেকে প্রচুর পানি পান করলো। সুতরাং যখন সে (তালুত) এবং তার সঙ্গের মুমিনগণ নদীর ওপারে পৌঁছল, তখন তারা (যারা তালুতের আদেশ মানেনি) বলতে লাগল, আজ জালুত ও তার সৈন্যদের সঙ্গে লড়াই করার কোনো শক্তি আমাদের নেই। (কিন্তু) যাদের বিশ্বাস ছিল যে, তারা অবশ্যই আল্লাহর সঙ্গে গিয়ে মিলিত হবে, তারা বলল, এমন কত ছোট সদলই না রয়েছে, যারা আল্লাহর হুকুমে বড় দলের ওপর জয়যুক্ত হয়েছে! আর আল্লাহ তাদের সঙ্গে রয়েছেন যারা সবরের পরিচয় দেয়।’ (সূরাতুল বাকারাহ, আয়াত নম্বর ২৪৯)।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।