ঢাকার অফিস ফেরত সন্ধ্যায়, গুলশান-১ এ লালবাতির দীর্ঘ সারির সামনে দাঁড়িয়ে, ইঞ্জিনের গর্জন আর পেট্রোলের গন্ধে মাথা ভারী হয়ে আসে। চোখে পড়ে পাশের লেনে হাওয়া করে চলে যাওয়া একটি নিঃশব্দ ইলেকট্রিক বাইক। তার চালকের মুখে একরাশ স্বস্তির হাসি। সেই মুহূর্তেই মনে প্রশ্ন জাগে: এই নতুন ইলেকট্রিক বাইক গুলো কি আসলেই আমাদের দৈনন্দিন যুদ্ধক্ষেত্র, এই রাস্তার জন্য উপযুক্ত সমাধান? শুধু ট্রেন্ড নয়, টাকা ও সময় বাঁচানোর হাতিয়ার? নাকি শুধুই চকচকে প্রোমোশনের ফাঁপা প্রতিশ্রুতি? ঢাকার রাস্তায় এক সপ্তাহ ধরে চালিয়ে, চার্জ দিতে দিতে, ডিলারশোরুম ঘুরে ঘুরে, এবং বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছি আমরা। এই রিভিউ শুধু স্পেসিফিকেশন টেবিল নয়; এটা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নতুন ইলেকট্রিক বাইক এর বাস্তবতা, সম্ভাবনা এবং সত্যিকারের “সেরা পছন্দ” কে খুঁজে বের করার অভিযাত্রা।
নতুন ইলেকট্রিক বাইক রিভিউ: শুধু পরিবেশ নয়, পকেটেরও বন্ধু?
বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে জ্বালানির দাম আকাশছোঁয়া, আর পরিবেশ দূষণ চরমে, নতুন ইলেকট্রিক বাইক শুধু ট্রেন্ড নয়, এক প্রয়োজনীয়তা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (BRTA) এর সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, দেশে রেজিস্ট্রিকৃত গাড়ির সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ছে, যার চাপ সরাসরি পড়ছে জ্বালানি আমদানি এবং বায়ু দূষণের উপর। পরিবেশ অধিদপ্তরের ২০২৩ সালের এক প্রতিবেদনে ঢাকার বায়ু দূষণের মাত্রাকে “অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর” বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে যানবাহনের ধোঁয়া অন্যতম প্রধান কারণ। এ অবস্থায় নতুন ইলেকট্রিক বাইক শূন্য নির্গমন নিশ্চিত করে সরাসরি বায়ু দূষণ কমাতে ভূমিকা রাখে।
কিন্তু শুধু পরিবেশ নয়, আসল লাভটা হয় পকেটে। চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত পেট্রোলের দাম বিবেচনায় নিয়ে হিসেব করলে দেখা যায়:
- জ্বালানি সাশ্রয়: একটি সাধারণ ১০০-১৫০সিসি পেট্রোল বাইকে প্রতি কিলোমিটারে খরচ পড়ে প্রায় ৳২-৳২.৫ টাকা (গড় মাইলেজ ৪০-৫০ কিমি/লিটার ধরে)। অন্যদিকে, একটি নতুন ইলেকট্রিক বাইক (যেমন ৩ কিলোওয়াট-আওয়ার ব্যাটারি, ৮০-১০০ কিমি রেঞ্জ) সম্পূর্ণ চার্জে বিদ্যুতের খরচ পড়ে মাত্র ৳১৫-৳২০ টাকা (ইউনিট প্রতি ৳৮ টাকা ধরে)। অর্থাৎ, প্রতি কিলোমিটারে খরচ মাত্র ৳০.১৫-৳০.২৫ টাকা! মাসিক ভিত্তিতে একজন দৈনিক ৩০ কিমি চালক প্রায় ৳১৫০০-৳২০০০ টাকা জ্বালানিতে সাশ্রয় করতে পারেন।
- রক্ষণাবেক্ষণ খরচ কম: ইলেকট্রিক বাইকে নেই ইঞ্জিন অয়েল, নেই স্পার্ক প্লাগ, নেই এয়ার ফিল্টার, নেই জটিল গিয়ারবক্স। এর মানে রেগুলার সার্ভিসিং খরচ পেট্রোল বাইকের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। শুধু ব্রেক, টায়ার এবং কদাচিৎ কুল্যান্ট ফ্লুইড চেকই প্রধান রক্ষণাবেক্ষণ।
নতুন ইলেকট্রিক বাইক শুধু পরিবেশবান্ধবই নয়, এটি মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য অর্থনৈতিকভাবে খুবই সাশ্রয়ী একটি সমাধান হতে পারে, বিশেষ করে শহুরে যাতায়াতের ক্ষেত্রে,” বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান। “জ্বালানি সাবসিডির চাপ কমাতে এবং আমদানি নির্ভরতা কমানোর ক্ষেত্রেও এটি সরকারের জন্য সহায়ক।”
বাজারে নতুন ইলেকট্রিক বাইক: কোন মডেল কী দিচ্ছে?
বাংলাদেশের বাজারে এখন বেশ কয়েকটি ব্র্যান্ডের নতুন ইলেকট্রিক বাইক জায়গা করে নিয়েছে। প্রতিটিরই আছে নিজস্ব শক্তি, দুর্বলতা এবং মূল্যবিন্দু। ঢাকার বিভিন্ন শোরুম ঘুরে এবং ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে সরাসরি ফিডব্যাক নিয়ে কয়েকটি জনপ্রিয় মডেলের গভীর রিভিউ:
ওয়াল্টন ই-বাইক জেডএস ৮০ (Walton e-Bike ZS 80):
- স্পেসিফিকেশন: ৩ কিলোওয়াট-আওয়ার লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি, ক্লেইমড রেঞ্জ ৮০-১০০ কিমি (সিটিসি), ৩ কিলোওয়াট মোটর, টপ স্পীড ৮০ কিমি/ঘন্টা, ডিজিটাল ড্যাশবোর্ড, রিজেনারেটিভ ব্রেকিং, লিড-অ্যাসিড অপশনও আছে।
- বাস্তব অভিজ্ঞতা (ঢাকা শহরে): গুলশান থেকে মিরপুর পর্যন্ত দৈনিক যাতায়াত (প্রায় ৩৫ কিমি) করার অভিজ্ঞতায় ব্যাটারি ৪০-৫০% চার্জ থাকত। ট্রাফিক জ্যামে স্টার্ট-স্টপে পারফরম্যান্স ভালো, ত্বরণ মসৃণ। তবে পূর্ণ লোডে (রাইডার + পillion) রেঞ্জ কমে ৬০-৭০ কিমি হতে পারে। আরামদায়ক সিট। প্রাইস পয়েন্টে ভালো ভ্যালু (লিথিয়াম ভার্সন ~ ৳২,০০,০০০ – ৳২,২০,০০০, লিড-অ্যাসিড ~ ৳১,৭০,০০০ – ৳১,৮০,০০০)। দেশীয় ব্র্যান্ড হিসেবে সার্ভিস নেটওয়ার্ক ভালো। ওয়াল্টন গ্রুপের অফিশিয়াল সাইটে বিস্তারিত জানুন।
- সেরা কার জন্য: দৈনন্দিন শহুরে কমিউটিং, যারা ভালো ভ্যালু ও দেশীয় সার্ভিস সাপোর্ট চান।
TVS iQube Electric:
- স্পেসিফিকেশন: ৩.৪ কিলোওয়াট-আওয়ার লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি, ক্লেইমড রেঞ্জ ৭৫ কিমি (IDC), ৪.৪ কিলোওয়াট মিড-ড্রাইভ মোটর, টপ স্পীড ৭৮ কিমি/ঘন্টা, ফুল ডিজিটাল TFT কনসোল, মাল্টি রাইডিং মোড, বিল্ট-ইন নেভিগেশন (ব্লুটুথ সংযোগে), রিজেনারেটিভ ব্রেকিং।
- বাস্তব অভিজ্ঞতা: প্রিমিয়াম ফিল। TFT ডিসপ্লে, স্মার্ট কানেক্টিভিটি ফিচার (ফোন অ্যাপের মাধ্যমে বাইক লক/আনলক, রিয়েল-টাইম লোকেশন, রাইড স্ট্যাটাস) অভিজ্ঞতাকে ভিন্ন মাত্রা দেয়। ত্বরণ খুব শক্তিশালী, মিড-ড্রাইভ মোটরের সুবিধা টেক-অফে। রাইড কোয়ালিটি খুব ভালো, ঢাকার খারাপ রাস্তাতেও আরামদায়ক। তবে মূল্য তুলনামূলকভাবে উচ্চ (~ ৳৩,৫০,০০০ – ৳৩,৭০,০০০)। রেঞ্জ রিয়েল-ওয়ার্ল্ডে ৫০-৬৫ কিমি (এগ্রেসিভ রাইডিংয়ে কমে যেতে পারে)। TVS এর ইস্টাবলিশড সার্ভিস নেটওয়ার্ক প্লাস পয়েন্ট।
- সেরা কার জন্য: যারা প্রিমিয়াম ফিচার, স্মার্ট টেকনোলজি, সেরা পারফরম্যান্স এবং ব্র্যান্ড ভ্যালু চান, বাজেট যাদের কাছে সেকেন্ডারি।
- হিরো ইলেকট্রিক অ্যাথন+ (Hero Electric Optima + / NYX HX):
- স্পেসিফিকেশন: (অ্যাথন+ / NYX HX মডেলভেদে) ১.৫ কিলোওয়াট-আওয়ার থেকে ৩.৫ কিলোওয়াট-আওয়ার লিথিয়াম বা লিড-অ্যাসিড ব্যাটারি, ক্লেইমড রেঞ্জ ৮০-১১০ কিমি, ৮০০-১২০০ ওয়াট হাব মোটর, টপ স্পীড ৪৫-৬০ কিমি/ঘন্টা, বেসিক ডিজিটাল ড্যাশবোর্ড।
- বাস্তব অভিজ্ঞতা: ইকোনমি সেগমেন্টের শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী। মূল্য খুব আকর্ষণীয় (লিড-অ্যাসিড শুরু ৳১,২০,০০০ – ৳১,৪০,০০০, লিথিয়াম ৳১,৭০,০০০ – ৳২,০০,০০০+)। পারফরম্যান্স বেসিক, শহরের ভেতরে ঘোরাঘুরির জন্য পর্যাপ্ত। হালকা ওজনের, ম্যানুভারেবিলিটি ভালো। তবে হাইওয়ে বা দ্রুতগতির রাস্তার জন্য কম উপযোগী। রেঞ্জ লিড-অ্যাসিডে বাস্তবে ৪০-৫০ কিমি, লিথিয়ামে ৬০-৭০ কিমি। সার্ভিস নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হচ্ছে। হিরো ইলেকট্রিক বাংলাদেশ সম্পর্কে বিস্তারিত।
- সেরা কার জন্য: সংক্ষিপ্ত দূরত্বের কমিউটিং, বাজেট কনশাস ক্রেতা, দ্বিতীয় বাইক হিসেবে, ডেলিভারি পার্টনার।
বাংলাদেশের রাস্তায় আসল পরীক্ষা: সুবিধা ও চ্যালেঞ্জ
নতুন ইলেকট্রিক বাইক কিনে গ্যারেজে সাজিয়ে রাখার জিনিস নয়। এর আসল পরীক্ষা হয় আমাদের বন্ধুরাস্তা, দুর্বল বিদ্যুৎ সরবরাহ, এবং গরম-বৃষ্টির মৌসুমে। ঢাকার রাস্তায় এক সপ্তাহ ব্যবহারের অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া মূল অন্তর্দৃষ্টি:
- ট্রাফিক জ্যামে জাদুকরী স্বস্তি: পেট্রোল বাইকের ইঞ্জিন বন্ধ করে ঠেলার ঝামেলা বা আটকে থাকার সময় ইঞ্জিনের তাপের যন্ত্রণা নেই। অটো স্টার্ট/স্টপ, থ্রটল টুইস্ট করলেই নিঃশব্দে চলা শুরু। মাথাব্যথা কমে যায়! ট্রাফিক জ্যামে শক্তি অপচয় কমে বলে রেঞ্জও ভালো থাকে।
- চার্জিং ইনফ্রাস্ট্রাকচার: বড় চ্যালেঞ্জ: এটাই সবচেয়ে বড় বাধা। ফ্ল্যাট বাড়িতে গ্রাউন্ড ফ্লোরে থাকলে চার্জ দেওয়া সহজ। কিন্তু বহুতল ভবনের উপরের তলায় থাকলে ব্যাটারি খুলে বাড়িতে তোলা কষ্টকর (বিশেষ করে লিথিয়ামের তুলনায় ভারী লিড-অ্যাসিড)। পাবলিক ফাস্ট চার্জিং স্টেশন প্রায় নেই বললেই চলে। অফিসে চার্জ দেওয়ার সুযোগ থাকলে বড় সুবিধা।
- ব্যাটারি লাইফ ও প্রতিস্থাপন খরচ: লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি দীর্ঘস্থায়ী (প্রায় ৩-৫ বছর বা ৮০% ক্ষমতা পর্যন্ত), কিন্তু দামি (প্রায় ৳৫০,০০০ – ৳৮০,০০০)। লিড-অ্যাসিড সস্তা, কিন্তু আয়ু কম (২-৩ বছর), ভারী, এবং রেঞ্জ কম। ব্যাটারি প্রতিস্থাপন খরচ আগে থেকেই মাথায় রাখা জরুরি।
- বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতা: বেশিরভাগ নতুন ইলেকট্রিক বাইক আইপি রেটিং (Ingress Protection) যেমন IP65 বা IP67, যা সাধারণ বৃষ্টি ও হালকা জলাবদ্ধতা সামলাতে পারে। তবে গভীর পানিতে চালানো এড়ানো উচিত। সার্ভিস সেন্টারে নিয়মিত ওয়াটার সিল চেক করানো ভালো।
- সার্ভিস ও স্পেয়ার পার্টস: দেশীয় ব্র্যান্ড (ওয়াল্টন) বা ইস্টাবলিশড ব্র্যান্ডের (TVS, Hero) সার্ভিস নেটওয়ার্ক অপেক্ষাকৃত ভালো। তবে নতুন বা ছোট ব্র্যান্ডের ক্ষেত্রে স্পেয়ার পার্টসের প্রাপ্যতা ও দক্ষ টেকনিশিয়ান খুঁজে পাওয়া চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। ক্রয় করার আগে এলাকায় সার্ভিস সেন্টারের উপস্থিতি নিশ্চিত করুন।
কীভাবে বাছবেন আপনার জন্য সেরা নতুন ইলেকট্রিক বাইক?
সবচেয়ে দামি বা সবচেয়ে সুন্দর বাইকটি আপনার জন্য সেরা নাও হতে পারে। আপনার চাহিদা বুঝে বাছাই করাই গুরুত্বপূর্ণ:
- দৈনিক দূরত্ব: আপনার দৈনিক ভ্রমণের গড় দূরত্ব কত? বাড়ি থেকে অফিস, বাজার, বাচ্চার স্কুল – সব মিলিয়ে। বাইকের ক্লেইমড রেঞ্জের ৬০-৭০% বাস্তব রেঞ্জ ধরে নিন (ট্রাফিক, রাইডিং স্টাইল, এসি/এলইডি ব্যবহারের উপর নির্ভরশীল)। আপনার দৈনিক দূরত্বের চেয়ে কমপক্ষে ২০-৩০% বেশি রেঞ্জের বাইক বেছে নিন (চার্জ ভুলে গেলেও যেন সমস্যা না হয়!)।
- বাজেট: শুধু শোরুম প্রাইস নয়, চিন্তা করুন:
- বাইকের অন-রোড প্রাইস (রেজিস্ট্রেশন, ইনশ্যুরেন্স সহ)
- ব্যাটারি টাইপ (লিথিয়াম প্রিমিয়াম দাম, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে ভালো)
- আনুমানিক ব্যাটারি প্রতিস্থাপন খরচ (৩-৫ বছর পরে)
- রেগুলার সার্ভিসিং খরচ
- ব্যাটারি টাইপ:
- লিথিয়াম-আয়ন (Li-ion): হালকা ওজন, দীর্ঘ আয়ু (৩০০০+ চার্জ সাইকেল), ভালো রেঞ্জ, দ্রুত চার্জিং (৪-৫ ঘন্টা), উচ্চ মূল্য। সুপারিশকৃত দীর্ঘমেয়াদি ভ্যালুর জন্য।
- লিড-অ্যাসিড (Lead-Acid): ভারী ওজন, কম আয়ু (৫০০-৮০০ চার্জ সাইকেল), কম রেঞ্জ, ধীর চার্জিং (৮-১০ ঘন্টা), কম মূল্য। শুধুমাত্র অত্যন্ত টাইট বাজেটে এবং সংক্ষিপ্ত দূরত্বের জন্য।
- চার্জিং সুবিধা: আপনার বাড়ি/অফিসে চার্জ দেওয়ার সুবিধা কেমন? ব্যাটারি খুলে নেওয়া যায় কিনা? নেটওয়ার্ক সকেটের কাছে পার্কিং আছে কিনা?
- সার্ভিস নেটওয়ার্ক: আপনার বাসস্থান বা কর্মস্থলের নিকটে ব্র্যান্ডের কর্তৃক অনুমোদিত সার্ভিস সেন্টার আছে কিনা? অনলাইনে ব্যবহারকারী রিভিউ দেখুন সার্ভিসের মান সম্পর্কে।
- টেস্ট রাইড: এক কথায় অপরিহার্য! শোরুমের কথা শুনে বা স্পেসিফিকেশন দেখে কিনবেন না। অবশ্যই টেস্ট রাইড করুন। অনুভব করুন ত্বরণ, ব্রেক, আরাম, হ্যান্ডলিং, ড্যাশবোর্ডের ব্যবহার সহজ কিনা। আপনার উচ্চতা ও ওজনের জন্য সিট আর হ্যান্ডেলবার আরামদায়ক কিনা।
সরকারি নীতি ও ভবিষ্যৎ: ইতিবাচক হাওয়া
বাংলাদেশ সরকার নতুন ইলেকট্রিক বাইক সহ ইলেকট্রিক যানবাহনের প্রসারে আগ্রহ দেখাচ্ছে। ইতিমধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ:
- কাস্টম ডিউটি হ্রাস: কিছু ইলেকট্রিক বাইক ও তাদের অংশবিশেষে আমদানি শুল্ক হ্রাস করা হয়েছে, যা চূড়ান্ত মূল্য কমাতে সাহায্য করে।
- রেজিস্ট্রেশন সহজীকরণ: BRTA ইলেকট্রিক বাইকের রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া চালু করেছে, যদিও এখনও কিছুটা জটিলতা আছে। প্রক্রিয়া আরও সরলীকরণের দাবি উঠছে।
- সাবসিডি ও প্রণোদনার আলোচনা: পরিবেশ দূষণ কমাতে এবং জ্বালানি আমদানি সাশ্রয়ের লক্ষ্যে ইলেকট্রিক যানবাহনে সরাসরি ক্রেতা সাবসিডি বা প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়টি সরকারি পর্যায়ে আলোচিত হচ্ছে। এটি বাস্তবায়িত হলে দাম আরও কমবে।
বাংলাদেশে নতুন ইলেকট্রিক বাইক: সত্যিকারের সেরা পছন্দ?
তাহলে প্রশ্নে ফিরে আসি: নতুন ইলেকট্রিক বাইক কি বাংলাদেশের শহুরে যাত্রীদের জন্য সেরা পছন্দ? উত্তর এক কথায় “হ্যাঁ”, তবে শর্তসাপেক্ষে। আপনার দৈনন্দিন যাত্রাপথ যদি ৩০-৪০ কিলোমিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, বাড়িতে বা অফিসে চার্জ দেওয়ার সুব্যবস্থা থাকে, এবং আপনি লিথিয়াম ব্যাটারির দীর্ঘমেয়াদি ভ্যালু ও কম রক্ষণাবেক্ষণ খরচের সুবিধা নিতে চান – তাহলে নতুন ইলেকট্রিক বাইক আপনার জন্য একটি যুগান্তকারী এবং অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী পছন্দ হতে পারে। এটি শুধু পেট্রোলের খরচই বাঁচায় না, দূষণ কমায়, ট্রাফিক জ্যামে মানসিক স্বস্তি দেয়, এবং একটি আধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর রাইডিং অভিজ্ঞতা উপহার দেয়। তবে, দীর্ঘ দূরত্বের নিয়মিত ভ্রমণ, দুর্বল চার্জিং সুবিধা, বা ব্যাটারি প্রতিস্থাপনের উচ্চ খরচের আশঙ্কা থাকলে, এখনও পেট্রোল বাইক বা হাইব্রিড অপশনগুলো বিবেচনায় রাখতে হবে। সিদ্ধান্ত আপনার চাহিদা, জীবনযাপন এবং প্রস্তুতির উপর নির্ভর করে। একথা নিশ্চিত, নতুন ইলেকট্রিক বাইক আমাদের যাতায়াতের ভবিষ্যতকে স্পর্শ করেছে, এবং প্রযুক্তির উন্নতি ও সরকারি সহায়তা বাড়ার সাথে সাথে এটি আরও বেশি মানুষের জন্য “সেরা পছন্দ” হয়ে উঠবে।
জেনে রাখুন (FAQs)
১. বাংলাদেশে ইলেকট্রিক বাইক চালানোর জন্য কি ড্রাইভিং লাইসেন্স লাগে?
হ্যাঁ, লাগে। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (BRTA) অনুযায়ী, ৫০ সিসির উপরের যেকোনো মোটরসাইকেল (পেট্রোল বা ইলেকট্রিক) চালানোর জন্য বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকা বাধ্যতামূলক। বেশিরভাগ নতুন ইলেকট্রিক বাইক এর পাওয়ার ৫০ সিসির সমতুল্য বা তার বেশি হয়, তাই লাইসেন্স প্রয়োজন। লাইসেন্সবিহীন চালানো জরিমানাযোগ্য অপরাধ।
২. লিথিয়াম ব্যাটারি নাকি লিড-অ্যাসিড ব্যাটারি – কোনটা বাংলাদেশের জন্য ভালো?
দীর্ঘমেয়াদে লিথিয়াম-আয়ন (Li-ion) ব্যাটারিই ভালো পছন্দ, যদিও দাম বেশি। এটি হালকা, দ্রুত চার্জ হয় (৪-৫ ঘন্টা), দীর্ঘস্থায়ী (৩-৫+ বছর), বেশি রেঞ্জ দেয় এবং রক্ষণাবেক্ষণ মুক্ত। লিড-অ্যাসিড ভারী, চার্জ ধরে কম রাখে, ধীরে চার্জ হয় (৮-১০ ঘন্টা), আয়ু কম (২-৩ বছর), এবং নিয়মিত পানির লেভেল চেক করতে হয়। শুধুমাত্র অত্যন্ত সীমিত বাজেট এবং খুব অল্প দূরত্বের জন্য লিড-অ্যাসিড বিবেচনা করা যেতে পারে।
৩. ইলেকট্রিক বাইকের ব্যাটারি কতদিন টেকে? প্রতিস্থাপন খরচ কত?
লিথিয়াম ব্যাটারির গড় আয়ু সাধারণত ৩ থেকে ৫ বছর বা প্রায় ৮০,০০০ কিমি বা ২০০০-৩০০০ চার্জ সাইকেল (ক্ষমতার ৮০% পর্যন্ত)। এরপর ধীরে ধীরে রেঞ্জ কমতে থাকে। প্রতিস্থাপন খরচ বাইকের মডেল এবং ব্যাটারি ক্ষমতার উপর নির্ভর করে, সাধারণত ৳৫০,০০০ থেকে ৳৮০,০০০ (বা তারও বেশি) হতে পারে। লিড-অ্যাসিড ব্যাটারির আয়ু কম (২-৩ বছর), প্রতিস্থাপন খরচ ৳২০,০০০ থেকে ৳৩০,০০০।
৪. ঢাকার মতো শহরে ইলেকট্রিক বাইক চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা কী?
এটাই প্রধান চ্যালেঞ্জ। ফ্ল্যাট বাড়িতে গ্রাউন্ড ফ্লোরে পার্কিং থাকলে সাধারণ ২২০V সকেটে (ব্র্যান্ডের দেওয়া চার্জারে) চার্জ দেওয়া যায়। বহুতল ভবনে উপরের ফ্লোরে থাকলে ব্যাটারি খুলে বাড়িতে নিয়ে চার্জ দিতে হয় (লিথিয়াম তুলনামূলক সহজ, লিড-অ্যাসিড ভারী)। পাবলিক ফাস্ট চার্জিং স্টেশন এখনও খুবই বিরল। কিছু অফিস কমপ্লেক্সে চার্জিং সুবিধা চালু হচ্ছে। চার্জিং সুবিধা ক্রয় করার আগে নিশ্চিত হওয়া আবশ্যক।
৫. বৃষ্টি বা জলাবদ্ধ রাস্তায় ইলেকট্রিক বাইক চালানো নিরাপদ কি?
বেশিরভাগ নতুন ইলেকট্রিক বাইক এর একটি IP রেটিং থাকে (যেমন IP65, IP67)। IP65 মানে ধুলাবালি থেকে সুরক্ষিত এবং নিম্নচাপের জলধারা থেকে সুরক্ষিত (বৃষ্টি)। IP67 মানে অল্প সময়ের জন্য ১ মিটার গভীরতায় ডুবেও সুরক্ষা। অর্থাৎ সাধারণ বৃষ্টি ও ছোটখাটো জলাবদ্ধতা সামলানোর সামর্থ্য আছে। তবে, গভীর পানিতে চালানো এড়ানো উচিত এবং নিয়মিত সার্ভিসে ওয়াটার সিলিং চেক করানো উচিত। বন্যার পানি বা ডুবে যাওয়া রাস্তা এড়িয়ে চলুন।
৬. ইলেকট্রিক বাইকের পারফরম্যান্স পেট্রোল বাইকের মতো হবে কি?
ত্বরণের দিক থেকে অনেক নতুন ইলেকট্রিক বাইক (বিশেষ করে TVS iQube বা ওয়াল্টন ZS 80 এর মতো) সমপর্যায়ের পেট্রোল বাইককেও ছাড়িয়ে যেতে পারে, কারণ ইলেকট্রিক মোটর শুরু থেকেই পূর্ণ টর্ক দেয়। টপ স্পিড সাধারণত ৭০-৮০ কিমি/ঘন্টা পর্যন্ত হয়, যা শহুরে যাত্রার জন্য যথেষ্ট। তবে, দীর্ঘ হাইওয়ে ক্রুজিং বা খুব উচ্চ গতির জন্য পেট্রোল বাইক এখনও এগিয়ে। ইলেকট্রিক বাইকের শক্তি নিঃশব্দে, মসৃণভাবে পাওয়া যায়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।